বুধবার, ১৬ আগস্ট ২০২৩

ইসলামী শিক্ষা দিবস উপলক্ষ্যে ‘শিক্ষা সেমিনার ২৩’ অনুষ্ঠিত

জাতীয় শিক্ষাক্রম বিষয়ে ছাত্রশিবিরের ১৭ দফা প্রস্তাবনা পেশ

ইসলামী শিক্ষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে ‘শিক্ষাব্যবস্থার অতীত, বর্তমান ও প্রত্যাশার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক শিক্ষা সেমিনার ২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি জেনারেল মঞ্জুরুল ইসলামের সঞ্চালনায় অনলাইনে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ কুরবান আলী। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. আ জ ম ওবায়দুল্লাহ।

অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক ড. শামিম উদ্দিন। প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রব, আমেরিকার নর্দান অব মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম আযম।
এতে সারা দেশের সকল দায়িত্বশীল এবং জনশক্তিরা অনলাইনে অংশগ্রহণ করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ কুরবান আলী বলেন, "দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন অব্যাহত রয়েছে। নাস্তিক্যবাদ ও একটা বিশেষ ধর্মবিশ্বাসকে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় প্রমোট করা হচ্ছে। পাঠ্যবই থেকে ইসলামী ভাবধারার লেখকদের লেখা বাদ দিয়ে সেখানে সেক্যুলারিজম ও একটি বিশেষ ধর্মবিশ্বাসী লেখকদের লেখা যুক্ত করা হয়েছে।

পরীক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষাকে ঐচ্ছিক করার মধ্য দিয়ে চূড়ান্তভাবে ইসলামকে শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। যার ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে। স্পষ্টতই চলমান শিক্ষাব্যবস্থা সার্বিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছে এবং ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাকে অনিবার্য করে তুলেছে।

সুতরাং আজ আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, শহীদ আব্দুল মালেক যে স্বপ্ন নিয়ে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করেছিলেন, সেই শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন আমরাই করব। শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চাইলে আগে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন দরকার, সেই পরিবর্তনে শহীদ আব্দুল মালেকের উত্তরসূরি হিসেবে ছাত্রশিবিরকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।"

প্রধান বক্তার বক্তব্যে সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. আ জ ম ওবায়দুল্লাহ বলেন, "শিক্ষাকে কেউ পণ্য বানাচ্ছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষাকে শুধু ক্যারিয়ার হিসেবে দেখছে। অথচ মানুষের দেহ, মন আত্মার সমন্বিত উন্নতিই হলো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। শহীদ আব্দুল মালেক এমনই একটা শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করেছিলেন, যার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান নানা ধর্মবর্ণ ও জাতিসত্তার বিকাশ সাধনে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইসলামী শিক্ষাব্যস্থা প্রণয়নই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু সেই শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য আব্দুল মালেক ভাইকে সেক্যুলারদের বিভৎস আঘাতে শহীদ হতে হয়েছিল।

শিক্ষাকমিশন মূলত এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে, যার আলোকে একদল কেরানি তৈরি হচ্ছে, যারা সেক্যুলার দর্শনের আলোকে দেশ পরিচালনা করছে। আদর্শহীন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ইসলামবিমুখ করা হচ্ছে।

সুতরাং এর বিপরীতে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করতে চাইলে প্রথমেই রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। কেননা, রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া এই ব্যবস্থা পরিবর্তনের আর কোনো উপায় নেই।"

সভাপতির বক্তব্যে কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিবুর রহমান বলেন, আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্বারোপ না দিয়ে সেখানে বৃটিশ মূল্যবোধকে অন্তর্ভুক্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্রশিবির তার নিয়মতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখবে। আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ রক্ষায় ছাত্রশিবির সব সময় কাজ করে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

কেন্দ্রীয় সভাপতি জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ বিষয়ে ছাত্রশিবিরের ১৭ দফা প্রস্তাবনাসমূহ পেশ করেন। প্রস্তাবনাগুলো হলো :

১. শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের সম্মিলনে শিক্ষা কমিশন গঠন করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ঈমান-আকিদা ও মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা।

২. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা (৭ম অধ্যায়) অনুযায়ী সর্বপর্যায়ে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা ও স্ব-জাতীয় মূল্যবোধের শিক্ষার বাস্তবায়ন করা।

৩. দেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের জন্য আলেমদের সমন্বয়ে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করা। পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসার গুণগতমান বজায় রাখার ওপর জোর প্রদান করা।

৪. মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া। বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দক্ষ করা, বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করা, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সকল বৈষম্য দূর করা। মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ভর্তি করার জন্য অভিভাবকদের উৎসাহদান করা। মাদ্রাসায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা। ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোকে সরকারিকরণ করা।

৫. শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যেক স্তরে কুরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সর্বস্তরের পাঠ্যক্রমে কুরআন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে কুরআন শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা।

৬. সাধারণ শিক্ষাধারার মাধ্যমিক স্তরে ঐচ্ছিক বিষয়ের তালিকায় পালি ও সংস্কৃতির পাশাপাশি উর্দু ও ফারসির সংযোজন করা। উর্দু ও ফারসি ভাষা এ অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় এগিয়ে থাকার জন্য স্প্যানিশ বা ফেঞ্চ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৭. দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর অশিক্ষিত অথবা স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তি দ্বারা গঠিত নিয়ন্ত্রক পরিষদের কুপ্রভাব শিক্ষা কার্যক্রমের একটি অন্তরায়। তাই উচ্চশিক্ষিত উপযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রক পরিষদ গঠন করা প্রয়োজন।

৮. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর ২৮তম অধ্যায়ে শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে গৃহীত বিশেষ পদক্ষেপসমূহের মধ্যে ১৫ ও ১৬ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত এবং উচ্চশিক্ষা অধ্যায়ের ১১নং কৌশল অনুযায়ী বাংলাভাষার যথাযথ মান বজায় রাখা ও উন্নয়নে সুপারিশকৃত পদক্ষেপসমূহের বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এর পাশাপাশি ইংরেজি ও আরবি ব্যবহার অব্যাহত রাখা এবং তা যাতে বাংলার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা।

৯. উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে দিনব্যাপী ক্লাস এবং প্রতিদিন পরীক্ষা নেওয়ার মতো অকার্যকর, অযৌক্তিক পদ্ধতি বাতিল করে কৌশলগত স্বাভাবিক কার্যকর পদ্ধতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কর্মদক্ষ নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে চাহিদার আলোকে দেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ অবকাঠামোগত কৌশল বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

১০. উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো। বর্তমানে আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতের বাজেটের দিকে নজর দিলে দেখতে পাই—এ খাতে বা জেটের হার খুবই কম। উন্নতবিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য গবেষণা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাজেটের একটা বড় অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যয় করতে হবে।

১১. বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। সকল প্রকার দলীয় নিয়োগ পরিহার করা, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন নিশ্চিত করা। মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা। সরকারের প্রতি আহ্বান—শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটা মনিটরিং করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

১২. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা অধ্যায় মোতাবেক দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের কৌশলসমূহ বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

১৩. জাতীয় শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনার জন্য রিসার্চ-স্কলারসহ দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও চিন্তাবিদদের নিয়োজিত করা।

১৪. দেশ-কাল, ধর্মীয় আদর্শ, চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধের আলোকে বাংলা, ইংরেজি, আরবি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরির জন্য শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, লেখক, চিন্তাবিদদের নিয়োজিত করা।

১৫. পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষার্থীদের জন্য এমনভাবে গল্প ও কবিতা রচনা করতে হবে, যেন শিশুদের মাঝে এই শিক্ষা প্রতিবেশী ও বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ বৃদ্ধি করে। পিতামাতা ও গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে উদ্বুদ্ধ করে। এটি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সৃষ্টির মহামানব নবীদের (আ.) প্রতি, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি এবং ধর্মপরায়ণ নারী-পুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ উজ্জীবিত করবে। মানুষ ও আল্লাহর প্রতি নিজ নিজ কর্তব্যে সচেতন করবে। তাদের সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মত্যাগের শিক্ষা দেবে। এই সব গল্প প্রধানত নবীর সিরাত ও হাদিস এবং প্রখ্যাত মনীষীদের জীবনী থেকে নিতে হবে।

১৬. স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকগণ এমনভাবে মনোবিজ্ঞান, কলা ও সমাজবিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন, যাতে তারা ইসলামি তত্ত্ব প্রত্যয়ের সাথে ব্যাখ্যা করতে পারেন। তাদেরকে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতার কারণগুলো সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে। এভাবে শিক্ষার তত্ত্ব ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কিত নির্দেশ প্রদানে তারা বিশেষ গুরুত্বারোপ করবেন। শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে মুখস্থ, ধারাবিবরণী অথবা নোটবই এবং আধুনিক সমতুল্য একক শিক্ষা এবং মূল্যায়ন ইত্যাদির বিষয়াদি জানার জন্য তাদেরকে মূল বইয়ে উৎসাহিত করতে হবে।

১৭. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে Guidance বিভাগ থাকতে হবে। এই বিভাগ গভীর আত্মবিশ্বাস ও যোগ্যতাসম্পন্ন এমন ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, যারা ছাত্রদের ব্যক্তিগত, শিক্ষাগত, মনস্তাত্ত্বিক ও অন্যান্য বিষয়ে উপদেশ প্রদান ও পরিচালনায় সহায়তা করতে পারবেন।