বুধবার, ১৮ জুলাই ২০১৮

মুহাম্মদ বদিউল আলম

অক্ষয়-অবিনাশী আত্মার পাখি

সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। বাতিল শক্তি কখনো সত্যের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনি। যেখানেই উত্থিত হয়েছে সত্যের নিশান, সেখানেই তারা ছুড়ে মেরেছে বিষাক্ত বাণ। কিন্তু ইসলামের অকুতোভয় মুজাহিদরা এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি, ভীত-সন্ত্রস্ত হয়নি। আল্লাহর ওপর অবিচল বিশ্বাস ও ভরসা রেখে তারা ছুটে চলেছে দুর্গম পথ দিয়ে। তাদের মুখে বারবার ধ্বনিত হয়েছে- আমাদের প্রত্যয় একটাই, আল্লাহর পথে মোরা চলবোই। তারা কুরআনুল কারিমের অমিয় বাণীর সত্যায়ন করেছে, ‘‘নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন-মরণ সব কিছু বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।’’

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এ বাণীকে হৃদয় কোটরে আঁকড়ে ধরে শাহাদাতের প্রত্যয় নিয়ে যুগ যুগ ধরে ইসলামী আন্দোলনের সৈনিকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাগুতের বিরুদ্ধে। লতা-পল্লবে সুশোভিত হজরত খান জাহান (রহ), হজরত শাহজালাল (রহ), হজরত শাহ মাখদুম (রহ) ও হজরত শাহ আমানত (রহ)-এর পদধূলিতে ধন্য লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৬ বছরের ইতিহাস নিশ্চয়ই বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের জন্য এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এই ইতিহাস সৃষ্টির পেছনে যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তথা যারা ইসলামী ছাত্রশিবির নামক প্রাসাদের ভিত রচনা করতে কংক্রিটের ভূমিকা পালন করেছেন তারা হলেন আমাদের শহীদানেরা। ইতোমধ্যে ১৩৮(বর্তমানে ২৩৪) জন শহীদ ভাই তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলার জমিনকে সিক্ত করেছেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত সত্যের অতন্দ্র প্রহরী মেধাবী ছাত্রনেতা শহীদ মাসুদ বিন হাবিব ও শহীদ মুজাহিদুল ইসলাম তাদেরই অন্যতম।

১৯৮৬ সালের ২২ মার্চ হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জের এক দুর্গম এলাকায় শহীদ মাসুদের জন্ম। মাওলানা হাবিবুর রহমানের ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের সুখের সংসারে ছেলেদের মধ্যে সর্বশেষ শহীদ মাসুদ। প্রখর মেধাবী শহীদ মাসুদ প্রাথমিক শিক্ষা স্কুলে শেষ করার পর পিতা অনেক বড় আলেম বানানোর স্বপ্নে তাকে নিয়ে ভর্তি করেছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নরসিংদীর জামেয়া কাসেমিয়া মাদরাসায়। সেখান থেকে দাখিল ও আলিমে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে দেশ ও জাতির অনেক বেশি সেবা করার ইচ্ছা নিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে। দাখিল পরীক্ষার পূর্বে পিতা যখন তাকে বলেছিলেন তোমাকে পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেতে হবে, তখন শহীদ মাসুদ বললেন, আব্বু আমি স্কুল থেকে এসে মাদরাসায় ভর্তি হয়েছি, আমি কি জিপিএ ৫ পাবো? তখন পিতা তাকে বলেছিলেন, জিপিএ ৫ মানুষই পায়, তাই তোমাকেও জীবনের সব জায়গায় জিপিএ ৫ পেতে হবে। সত্যি শহীদ মাসুদ সব পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন। তাই পিতা তার সন্তানের লাশকে সামনে নিয়ে বলেছিলেন,

‘আমার সন্তান দুনিয়ায় যেমন জিপিএ ৫ পেয়েছে শাহাদাতের মাধ্যমে আখিরাতেও জিপিএ ৫ পেল।’

শহীদ মাসুদ ও মুজাহিদ ভাইয়ের শাহাদাতের কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে একটা সংঘর্ষ হয় ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে। তার কয়েক দিন পর ৮ ফেব্রুয়ারি নবীনবরণ অনুষ্ঠানের দাওয়াত দেয়া নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ প্রক্টর ও শিক্ষকদের সামনে শিবিরের ভাইদেরকে মারধর করে। এরপর সাধারণ ছাত্রসহ শিবিরকর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তুললে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের নিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে নিরীহ শিবিরকর্মীদের ওপর দুপুরে হামলা চালায়। হামলার খবর যখন আমি জানতে পারলাম তখন মৌলভীবাজার জেলায় সফরে ছিলাম। প্রোগ্রাম থেকে দুপুরে খাওয়ার বিরতির সময় জানলাম মুজাহিদ ভাই নামে একজন শাহাদাত বরণ করেছেন। এর কিছুক্ষণ পর হবিগঞ্জ জেলা সভাপতি নজরুল ভাইয়ের ফোনের মাধ্যমে জানতে পারলাম অন্য আরেকজন ভাই মাসুদ বিন হাবিব শহীদ হয়েছেন। তার বাড়ি হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলায়। আল্লাহর কাছে দোয়া করার পাশাপাশি বিভিন্ন দায়িত্বশীলকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম।

শহীদের জানাজা ও দাফন : রাতে কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক আতিকুর রহমান ভাই ফোনে জানালেন যে, আগামীকাল কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আপনাকে শহীদের বাড়িতে যেতে হবে এবং এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সভাপতি আপনার সাথে বিস্তারিত কথা বলবেন। পরক্ষণে কেন্দ্রীয় সভাপতি ফোন করে যখন বিষয়টি আরো বুঝিয়ে বললেন, তখন এক অজানা ভয় আমায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। এক অজানা শিহরণ সৃষ্টি করেছিল আমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে। সাংগঠনিক জীবনে বিভিন্ন শহীদ ভাইয়ের ওফাতের ঘটনার প্রতিবাদে অনেক মিছিল করেছি কিন্তু কখনো এ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি যে, একজন শহীদ ভাইয়ের লাশ নিয়ে সন্তানহারা পিতামাতার সমীপে যেতে হবে। বিবেকের দোরগোড়ায় বারবার দংশন করেছিল, যদি শহীদের পিতা-মাতা আমার কাছে প্রশ্ন করেন, কী ছিলো তার অপরাধ? কেন তাকে ছিনিয়ে নিলে আমাদের নিকট থেকে?

পূর্ব থেকেই আমি মৌলভীবাজার শহর শাখায় সফরে ছিলাম। তাই পরবর্তী দিন সকালে নাশতা সেরে শহর ও জেলা শাখার দায়িত্বশীলদের সাথে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে রওনা হলাম শহীদের বাড়ির দিকে। ইতোমধ্যে মোবাইলে জানতে পারলাম নিকটবর্তী অনেক জেলা শাখা থেকেও ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ছুটে আসছেন শহীদের বাড়িতে। সত্যিই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পরিচয় তো তারা আল্লাহর পথে সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো যুদ্ধ করে। হৃদয়পটে তখন ভেসে ওঠে ইন্নামাল মুসলিমুনা ইখওয়া- নিশ্চয়ই মুসলমানেরা ভাই ভাই। তাইতো এক ভাই আরেক ভাইয়ের শাহাদাতের খবর শুনে স্থির থাকতে পারেনি। বিদায়লগ্নে একটি বার দেখার জন্য ছুটে আসছে শহীদের বাড়িতে।

চট্টগ্রাম থেকে হবিগঞ্জ জেলা সেক্রেটারি খলিল ভাইয়ের নেতৃত্বে পুলিশ প্রোটেকশনে শহীদের লাশ আসছে। পথিমধ্যে প্রায় ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হলো কিন্তু শহীদ ভাইকে গোসল ও কাফন পরানো হয়নি। মনে মনে ভাবছিলাম কুমিল্লাতে গোসল ও কাফন পরানোর কার্যক্রম শেষ করা যায় কি না। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সভাপতির অনুমতি নিয়ে কুমিল্লা মহানগরী সভাপতি কামরুজ্জামান সোহেল ভাইকে ফোন করলাম। তিনি এতে রাজি হলেন এবং ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু সরকারের তল্পিবাহক পুলিশ তা করতে দিলো না। বরং আমাদের ভাইদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনগুলো ছিনিয়ে নিল।

আমাদের গাড়ি হবিগঞ্জ পার হয়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্রাম বানিয়াচংয়ের ভেতর দিয়ে ক্রমশ এগিয়ে চলছে। দুই পাশে খোদার সৃষ্টির অপরূপ দৃশ্যাবলি চোখে পড়তেই অন্তর আমার কেঁপে উঠলো। হয়তো কতবার শহীদ মাসুদ এ পথ দিয়ে গিয়েছেন। কিছু সময়ের মধ্যে গাড়ি আজমিরীগঞ্জে পৌঁছে গেল। এখানে জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করে আমরা শহীদের বাড়ির দিকে পায়ে হেঁটে অগ্রসর হচ্ছিলাম। উপজেলা সদরের মধ্যেই বাড়ি। প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর শহীদের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। দুই-একজন ভাই আমাকে কয়েকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় মেহমান বলে। প্রথমেই সাক্ষাৎ হলো শহীদ মাসুদ ভাইয়ের গর্বিত পিতা মাওলানা হাবিবুর রহমানের সাথে। নিজেকে আমার বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। কিন্তু সারাক্ষণ যে চিন্তা আমায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল শহীদের পিতার সাথে সাক্ষাতে সে চিন্তার বাঁধ ভাঙে। যখন দেখলাম পুত্রহারা পিতার চোখে কোনো অশ্রু নেই বরং আমাদের হাসিমুখে বরণ করে নিলেন এবং কেমন আছেন প্রশ্ন করতেই জবাব দিলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’ এখানেই শেষ নয়, শহীদের পিতা আরো বললেন,

‘আমি সত্যিই গর্বিত একজন শহীদের পিতা হতে পেরে। আল্লাহর নিকট দোয়া করি তিনি যেন আমার সন্তানের জীবনের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের আশু মুক্তির ব্যবস্থা করেন। অতঃপর তিনি তুলে ধরলেন মিসরের ইসলামী আন্দোলনের কথা। মিসরে ইসলামী আন্দোলনের জন্য অসংখ্য তরুণ প্রাণ দিয়েছিলো, তাই একই উদ্দেশ্যে আমার ছেলেও জীবন দিয়েছে এতে ক্ষতি কোথায়? বরং তার জীবনের বিনিময়ে যদি এ দেশে ইসলামী বিপ্লব হয় তাহলেইতো সার্থকতা।’

শহীদের গর্বিত পিতার এ কথাগুলো শুনে আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কোনো সন্তান হারা পিতার বক্তব্য এমন হতে পারে! মাসুদ ভাইয়ের গর্ভধারিণী মাতার কণ্ঠেও একই বিষয় প্রতিধ্বনিত হলো। তিনি বললেন, ‘আমার সন্তানের শাহাদাতের বিনিময়ে যেন আল্লাহতায়ালা সাবেক আমীরে জামায়াতের মতো বৃদ্ধ মানুষসহ সকলকে মুক্তির ব্যবস্থা করেন।’

এই এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত। তাই শহীদের বাড়িতে অনেক হিন্দু পুরুষ-মহিলাকেও চোখে পড়লো। অনেককে কাঁদতেও দেখলাম। তাদের মুখে একটি উক্তি- ছেলেটি খুবই ভালো ছিল। আমরা অন্য ধর্মাবলম্বী হলেও সে আমাদের খোঁজখবর নিতো। শহীদ মাসুদ বিন হাবিব যে দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রিয় ছিলো তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পেলাম জানাজার নামাজে। দুর্গম পথ পড়ি দিয়ে রাত সাড়ে ৯টার সময়ও হাজার হাজার লোকের উপস্থিতি। অনেকের মুখের কথা- আজমিরীগঞ্জে ইতঃপূর্বে এতো বড় জানাজা কারও হয়নি।

জানাজার আগে শহীদের লাশ বাড়িতে আনা হলে আমি তার মুখের কাপড় সরিয়ে একটিবার দেখে নিই। তার মুখদর্শনে আমার মনে হচ্ছিল শহীদ মাসুদ-তো ঘুমিয়ে আছেন। এইতো এখনি বুঝি ঘুম ভাঙবে। মনে পড়ে গেল আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা, ‘আল্লাহর রাস্তায় যারা প্রাণ দেয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত।’ সত্যিই শহীদ মাসুদ যেন আমার চোখে জীবন্ত রূপেই ধরা দিলেন। প্রাথমিক কাজ সমাধা করে শহীদের কফিন জানাজার জন্য উপস্থিত করা হলে এমতাবস্থায় এই জানাজা-পূর্ব সমাবেশে বক্তব্য প্রদান করলেন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সিলেট মহানগরী জামায়াতের আমীর অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা ফরিদ উদ্দীন, শহীদের গর্বিত পিতাসহ আরও অনেকে। অতঃপর শহীদের দাফনের ব্যবস্থা করা হলো। অন্তিম শয্যায় শায়িত হলেন শহীদ মাসুদ বিন হাবিব।

শহীদ মাসুদ বিন হাবিব অন্যান্য শহীদের সাথে অক্ষয়-অবিনাশী আত্মার পাখি হয়ে থাকলেন চিরকাল বেহেশতী কাননে। আর চাপিয়ে দিয়ে গেলেন আমাদের ঘাড়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব।
হে আল্লাহ! এই কঠিন দায়িত্ব আমাদের পালন করার তৌফিক দাও। আমিন।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়