শহীদ মুন্সী আব্দুল হালিম

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ | ৫৮

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

প্রলয়ঙ্করী বজ্র যদি ফুলে ফুলে সুশোভিত একটি সাজানো বাগানে উপর্যুপরি আঘাত হানতে থাকে তাহলে মুহূর্তেই ফুলের পাপড়িরা যেমন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে ধুলিতে গড়াগড়ি খায়, স্বর্ণালি গানের পাখিরা যখন ঝলসে ছিটকে পড়ে মাটিতে, বন্ধ হয়ে যায় পাখিদের সুললিত কণ্ঠের গান। ২০ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসীদের পৈশাচিক ছোবল ঠিক একইভাবে হাজারো ছাত্র-ছাত্রীদের দীপ্ত পদচারণায় মুখরিত খুলনা বিএল কলেজে পরিবেশকে বিধ্বস্ত ও ক্ষতবিক্ষত করে পরিণত করে একটি সাক্ষাৎ ধ্বংসস্তুপে। সেখানকার সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলো আজ স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর। প্রতিটি প্রাণই শঙ্কিত, সন্ত্রাসীরা আবার না জানি কখন নারকীয় তাণ্ডবে ঝাঁপিয়ে পড়ে এখানকার শান্তি প্রিয় শিক্ষার্থীদের ওপর। একই পরিবেশ বিদ্যমান দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান খুলনা আলিয়া মাদরাসাতেও।

সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা
১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ক্ষমতাসীন বিএনপি’র মদদপুষ্ট জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও তাদের দোসররা সারা মহানগরীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সন্ত্রাসের লীলাভূমিতে পরিণত করে। সন্ত্রসীরা বিএল কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস ও কলেজ শাখার নির্বাচিত শাখার সভাপতি মুন্সী আবদুল হালিম, সাহিত্য সম্পাদক রহমত আলী ও খুলনা আলিয়া মাদরাসা ছাত্র আমানুল্লাহকে প্রকাশ্যে দিবালোকে বর্বরোচিতভাবে খুন করে হত্যা ও সন্ত্রাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করে। খুনিদের নীরব তান্ডব ২০ সেপ্টেম্বর দুপুর চূড়ান্ত রূপ লাভ নিলেও ১৯ তারিখ সন্ধ্যায় তাদের অপতৎপরতার সূত্রপাত ঘটে। ঐদিন সন্ধ্যায় ছাত্রদল ও ছাত্র মৈত্রীর পেশাদার সন্ত্রাসীরা শিবির নেতা ও দৌলতপুর কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জিএস কামরুল ইসলাম এবং বিএল কলেজে ছাত্র সংসদের সদস্য আবদুল মোমেনের ওপর হামলা চালায়। সন্ত্রসাীরা হাতুড়ি ও ইট দিয়ে তাদের মাথায় আঘাত করে রক্তাক্ত এবং আঙ্গুল দিয়ে চোখ তুলে নেবার চেষ্টা চালায়।

ঐ ঘটনা যখন ঘটছিল তখন জাতীয় সংসদের হুইপ আশরাফ মাত্র ১০০ গজ দুরে বিএল কলেজের জায়গায় অবৈধভাবে নির্মিত বিএনপি অফিসে অবস্থান করছিলেন। হামলা শেষে সন্ত্রাসীরা বিএনপি অফিসে আসলে হুইপ তাদের ধন্যবাদ জানান। ২০শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালের ঘটনা। অন্যান্য দিনের মত সেদিনও কলেজ শান্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে তার কার্যক্রম শুরু করে। কলেজ শাখায় ছাত্র-ছাত্রীদের সমাগম ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় কম। অফিসের কাজে যারা এসেছিলেন তারা দুপুর দেড়টা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান ছাত্র সংসদের কর্মকর্তা ও হাতেগোণা কয়েকজন শিক্ষার্থী ছাড়া হোস্টেলও ছিল প্রায় ফাঁকা। দুপুর দেড়টার দিকে হলে অবস্থানরত ছাত্ররা নামাজ পড়তে মসিজদে যাচ্ছিলেন আর অন্যান্যরা ডাইংয়ে দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিলেন।

কর্মনিষ্ঠ জিএস তখনও খাবার খেতে পারেননি। কলেজের কাজ নিয়ে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মহানগরী কলেজ জোনের পরিচালক ও ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস আবদুর রহিম ও সাহিত্য সম্পাদক শেখ রহমত আলী আহত আবদুল মোমেন ও কামরুল ইসলামকে দেখে হাসপাতাল থেকে ফিরছিলেন। হঠাৎ করে মিছিল আসছে ছাত্রদল, ছাত্র মৈত্রী ছাত্র ইউনিয়ন ও যুবদলের আর্মস ক্যাডারসহ ২০০/৩০০ বহিরাগত পেশাদার গুণ্ডা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিএল কলেজ ঘিরে ফেলেছে। শিবির নেতা অবদুল হালিম খবর পেয়ে ফিরে আসেন তিতুমীর হলে। ৩০/৪০ জন শিবির কর্মীকে তিনি হল মসজিদে সমবেত করে জীবনের শেষবারের মত হিদায়াতি বক্তব্য প্রদান করেন।

তিনি তার বক্তব্যে বলেন, সন্ত্রাসীরা চিরতরে কলেজ থেকে ইসলামের আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আমাদের জীবন দিয়ে হলেও বিএল কলেজে ইসলামী আন্দোলনকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চাই। এজন্য যদি কাউকে শাহাদাত বরণ করতে হয় তবে জেনে রাখবেন সে হবে মুন্সী আব্দুল হালিম। সমাবেশ শেষে শিবির কর্মীরা নিচে নেমে আসেন। ইতোমধ্যে পেশাদার সন্ত্রাসীরা ১ম গেট ২য় গেট, প্রাইমারি স্কুল গেট, সুবোধচন্দ্র ছাত্রাবাস প্রভৃতি জায়গা থেকে এক যোগে বৃষ্টির মতো বোমা ও গুলিবর্ষণ করতে করতে তিতুমীর হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

এ সময় শিবির কর্মীরা জীবন বাজি রেখে ইট, পাথর ও লাঠি সংগ্রহ করে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। গুলিকে উপেক্ষা করে এমনকি কেউ কেউ আহত হওয়া সত্ত্বেও খালি হাতে সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন। এই জানবাজ কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে ২য় ও প্রাইমারি স্কুল গেটে সন্ত্রাসীরা পলায়নে বাধ্য হয়। ১ম গেটেও একই অবস্থা বিরাজ করছিল। এ সময় সন্ত্রসাসীরা আরো অধিক সংখ্যক অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ১ম গেট দিয়ে হামলা চালায় তৎকালীন মহানগরীর ছাত্রকল্যাণ সম্পাদক ও ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পায়ে তিনদফা গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় তাকে কলেজ মসজিদে নেয়া হয়। আহত ভাইকে একা ফেলে না গিয়ে হালিম ভাই এবং অপর কর্মী হাফিজুর রহমান মসজিদে প্রবেশ করেন। তাদের আশা ছিল আল্লাহর পবিত্র ঘর মসজিদ সকলের জন্য নিরাপদ।

রক্ত পিপাসু খুনিরা অন্তত মসজিদে রক্ত ঝরাবে না। কিন্তু খুনিরা মসজিদের মধ্যে গুলি ও বোমা বর্ষণ করতে থাকে এবং রামদা দিয়ে জানালার গ্রিল কাটার চেষ্টা করে। এতে ব্যর্থ হয়ে তারা মসজিদের সামনের দিকে বারান্দায় উঠে আসে এবং বোমা মেরে আল্লাহর পবিত্র ঘরে দরজাকে উড়িয়ে দেয়। এ সময় ক্ষুধার্ত, শ্রান্ত-ক্লান্ত শিবিরের কর্মীরা খুনিদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষরূপী বর্বর পশুরা প্রথমে শিবির কমী হাফিজুর রহমানকে পেটে গুলি করে মসজিদের মেঝেতে ফেলে দেয়। এ সময় নরপশুরা বন্দুক, রামদা দিয়ে মু. হালিমের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুলিবিদ্ধ হালিম ভাই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লে তারা রামদা দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে। পরে তারা হালিম ভাইকে মৃত ভেবে মসজিদের সামনে পুকুরে ফেলে রাখে। পানিতে তার শরীর নড়াচড়া করছে দেখে হিংস্র হায়েনারা তাকে পুকুর থেকে তুলে আনে। এ সময় তিনি পানি চান। কিন্তু তারা তাকে পানি না দিয়ে মসজিদের সামনে কসাইয়ের মত জবাই করে। তারা তাকে জবাই করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং নরকীটরা, ছাত্রদলের খুনিরা হালিম ভাইয়ের হাত পায়ের রগগুলোও কেটে দেয়। খুনের নেশায় উন্মত্ত বিএনপি ও ছাত্রদলের রক্তপিপাসু পিশাচরা রহমত আলী ভাইকে গুলি করে ফেলে দেয়। তারপর একই কায়দায় রামদা, চাইনিজ কুড়াল এবং গুলি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

একনজরে শহীদ মুন্সী আবুল হালিম
নাম: মুন্সী আব্দুল হালিম
পিতার নাম: মুন্সী মুহাম্মদ
অন্যান্য কৃতিত্ব: খুলনা বিএল কলেজে নির্বাচিত জিএস।
যাদের হাতে: ছাত্রদল, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য।
শহীদ হওয়ার তারিখ : ২০.০৯.১৯৯৩
আঘাতের ধরন : গুলি ও জবাই
স্থায়ী ঠিকানা : মশিয়ালী, থানা- খানজাহান আলী, জেলা খুলনা।

শিক্ষাজীবন
মশিয়ালী পূর্বপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। দামোদর এমএম উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৮৭ সালে দৌলতপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। শাহাদতকালে খুলনা বিএল কলেজে ম্যানেজমেন্ট ২য় বর্ষে পড়ছিলেন।

সাংগঠনিক জীবন
১৯৮৭ সালের অক্টোবর কর্মী, ১৯৮৯ সালের ১৮ আগস্ট সাথী এবং ১৯৯১ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর সংগঠনের সদস্য হন। তিনি খুলনা মহানগরীর শিবিরের সদস্য ছিলেন।

শাহাদাতে পিতার প্রতিক্রিয়া
মুন্সী আব্দুল হালিমের পিতা মুন্সী মোহাম্মদ। তিনি তার সন্তানকে হারিয়ে শোকাভিভূত নন বরং তিনি একজন গর্বিত শহীদের পিতার ন্যায় সম্মানিত বোধ করেন। তার কথায় সন্তান হারানোর ব্যথার চেয়ে ইসলমী আন্দোলনের জন্য তার পেরেশানি। মূর্ত হয়ে উঠেছে অধিক মাত্রায়। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে ইসলামের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে তাতে ইসলামী আন্দোলনের কার্মীদের তাদের শহীদ ভাইদের কথা মনে করে শোকাভিভূত হলে চলবে না। বরং শোক যেন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মদদ জোগায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্বাস দৃঢ় রাখতে হবে। তবেই সফলতা আসবে।

তিনি বলেন, হালিম ছিল অত্যন্ত বিচক্ষণ ছেলে। রমজান মাসে ইফতারির জন্যে যে আজান দিত তা আমরা তন্ময় হয়ে শুনতাম। তার আজান শুনে গ্রামের লোকেরা ইফতারি করত। শহীদ হালিমের স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রফুল্ল কুমার চট্টোপাধ্যায় ও সহকারী শিক্ষক সন্তোষ কুমার বিশ্বাস তাদের ছাত্রের জন্যে গর্ব অনুভব করেন। তারা বলেন, সত্যবাদী ও অসাধারণ ব্যত্বিসম্পন্ন একজন ছাত্র ছিল হালিম, আমরা তার জন্যে গর্বিত।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুন্সী আব্দুল হালিম

পিতা

মুন্সী মোহাম্মদ

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

স্থায়ী ঠিকানা

মশিয়ালী, থানা-খানজাহান আলী, জিলা- খুলনা

সাংগঠনিক মান

সদস্য

সর্বশেষ পড়ালেখা

ম্যানেজমেন্ট ২য় বর্ষ, খুলনা বি এল কলেজ

শাহাদাতের স্থান

কলেজ মসজিদ