শহীদ মুস্তাফিজুর রহমান

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ০৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ | ৫৪

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

বাংলার বুকে সত্যের কাফেলা তৈরির একমাত্র সফল সংগঠনের নাম ইসলামী ছাত্রশিবির। শিবির অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যেমন সফল প্রতিবাদী কণ্ঠ, তেমনি দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদের নজরানা পেশ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাইতো তার শহীদি রক্ত আজও প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিদিনের মত সূর্য উদিত হলো এই বাংলার অনন্য নৈসর্গিক ছায়াঘেরা ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সূর্যের তীক্ষ্ম রশ্মিকে ম্লান করে দিয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দুর্বৃত্তদের মুহুর্মুহু বোমা বারুদ আর ককটেলের কালো ধোঁয়ায়। সেদিন জাতির বুক ভারী করেছে ছাত্রশিবিরের দু’জন তরতাজা তরুণ যুবকের প্রাণ কেড়ে নিয়ে।

সেই মর্মান্তিক ঘটনা
সেদিন ছিল বাংলাদেশের পথহারা তরুণ সমাজের পথের দিশা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। রাবি ছাত্রদের নিকট প্রিয় ছাত্রসংগঠনটি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে। এটি সংগঠনের অতীত ঐতিহ্য। কিন্তু হায়েনাদের সহ্য হয় না ইসলামী ছাত্রশিবিরকে। তাই তারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শিবিরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নামে শিবিরের উপর আক্রমণ করে। রাজনৈতিক তৎপরতা কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ করায় সেদিন শিবির কোন প্রোগ্রাম করেনি। নিজেদেরকে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছিল। প্রসারিত করেছিল সেবার হাত নবীনদের জন্যে শহীদ মুস্তাফিজ ভাইসহ ১০/১২ জন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে ভর্তিচ্ছুদের সার্বিক সহযোগিতায়সহ সংগঠন প্রকাশিত ভর্তি গাইড বিক্রি করেছেন। এমন সময় ছাত্রদলের নেতৃত্বে ছাত্র ঐক্যের কর্মীরা শিবির কর্মীদের উপর হামলা করে। লাইব্রেরির উত্তর পাশে নির্মমভাবে গুলি করে শিবির নেতা মোবাশ্বিরকে। তার কোমরের পাশ দিয়ে গুলি প্রবেশ করে কণ্ঠনালী দিয়ে গুলি বেরিয়ে যায়। পুরো ক্যাম্পাসে গোলাবারুদ আর অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে শহীদ হাবিবুর রহমান হলের সামনে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে শিবির নেতা মুস্তাফিজকে।

ইসলামী আদর্শের প্রতি অনুরাগী মুস্তাফিজ
নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করেছিলেন শহীদ মুস্তাফিজ। আর তাই আমরা দেখতে পাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহীদ হন। শুধু তাই নয় যশোর এম এম কলেজে ভর্তি হবার পর ১ম বর্ষ ব্যতীত অন্য বর্ষের ক্লাস গুলোতে পারেন নি শিবির করার অপরাধে। ছাত্র মৈত্রীর ঘোষণা ছিল মুস্তাফিজ কলেজে আসাতে পারবে না যদি আসতে হয় তাহলে শিবির ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। পর্দা নারী পুরুষ সবার উপর ফরজ। মুস্তাফিজ ভাই সৃষ্টি করেছিলেন পর্দা পালনের অনুপম দৃষ্টান্ত যা আমাদের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।

একবার তিনি তার ভাইদের সাথে তার নানা বাড়ি গিয়ছিলেন। একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সবাই আনন্দ ফুর্তিতে ব্যস্ত। অথচ মুস্তাফিজ ভাই এক রুমে বসেছিলেন। একবারের জন্যও বাইরে বের হননি। কারণ বাইর মেয়েরা ঘুরাফিরা করছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। সবার খাবার শেষ। অথচ মুস্তাফিজ ভাই রুমে বসে আছেন। অবশেষে তার নানা বাড়ির লোকজন জিজ্ঞেস করেন খাবার খেয়েছে কিনা। না তার খাওয়া হয়নি। কারণ বাইরে বেরুতে পারেননি পর্দা লঙ্ঘন হবার ভয়ে । তাই তার জন্য রুমেই খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। সেদিনেই অপর একটি ঘটনা। নানা বাড়িতে সবার শোবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু মেয়েদের সংখ্যা বেশি হবার কারণে মুস্তাফিজ ভাই ঘরে প্রবেশ করতে পারেননি এবং জানতে পারেননি কোথায় শোবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তাই তিনি প্রচণ্ড শীতের ভেতর চাদর মুড়ি দিয়ে বাড়ির বাইরে বসে থাকেন। তার ছোট ভাই বাড়ির বাইরে আসলে এ অবস্থা দেখে হতবাক হন। বসে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করেন। প্রতি উত্তর তিনি বলেন মেয়েদের কারণে বাড়ির ভেতর যেতে পারছি না। শহীদ মুস্তাফিজ অনেক সুন্দরভাবে নামাজ পড়তেন। ৪ রাকাত নামাজ পড়তে তার ৮/১০ মিনিট সময় লাগত। মায়ের কথা সব সময় মানতেন। কোথাও যেতে মাকে বলে যেতেন।

সবার প্রিয় মুস্তাফিজ
প্রতিবেশীরা শহীদ মুস্তাফিজকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। আদর্শ ও ভদ্র ছেলে হিসেবে সর্বস্তরে তার সুখ্যাতি ছিল। শত্রু মিত্র সবাই তাকে আপনজন মনে করত। পাড়াপড়শিরা শহীদ মুস্তাফিজকে আপন ছেলের চেয়ে বিশ্বাস ও কাজে কর্মে বেশি ভরসা করত বিদ্যুত বিলসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহে প্রতিবেশীর মুস্তাফিজের শরণাপন্ন হত। বিপদগ্রস্তদের সহায়তার জন্য তার হৃদয়ছিল ব্যাকুল। পাড়া প্রতিবেশীদের ধারণা ছিল এমন ছেলে হারিয়ে তার মা বাঁচবে না। সবার প্রিয় মুস্তাফিজকে স্মরণে রাখার জন্য গ্রামবাসী তাদের সড়কের নাম রেখেছে শহীদ মুস্তাফিজ সড়ক।

শহীদের উল্লেখযোগ্য বক্তব্য
৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩। শিবিরেরর উপর সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলার সময় তার আশপাশের সঙ্গীদের বলেন, চলেন আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। লতিফ ভাই বললেন আপনি ক্যাম্পাসে নতুন, অপরদিকে ওদের রয়েছে গুলি, বোমা। সুতরাং আমাদের ওদের সামনে খালি হাতে মোকাবেলা করতে যাওয়া ঠিক হবে না।

একনজরে শহীদ মুস্তাফিজুর রহমান
* নাম : মু. মুস্তাফিজর রহমান
* পিতার নাম : মোঃ আব্দুল জলিল
* সাংগঠনিক মান : সদস্য
* সর্বশেষ পড়াশুনা : এমএসএস. শেষ বর্ষ অর্থনীতি বিভাগ
* জীবনের লক্ষ্য : অধ্যাপনা
* শহীদ হওয়ার স্থান : রাবির শহীদ হাবিবুর রহমান
* আঘাতের ধরন : গুলি, চাইনিজ কুড়াল, রামদা
* কাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রদলের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য
* শহীদ হওয়ার তারিখ : ৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩
* স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- ছোট গোপাল পুর, ডাক: তালবাড়ী, থানা ও জেলা: যশোর।
* ভাই-বোন : ৬ জন
* ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান : ২য়
* পরিবারের মোট সদস্য : ৯ জন

শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী
শহীদ মুস্তাফিজ বলেছিলেন,“আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করেছি। সভাপতি ও কর্মীভাইদেরকে আমার সালাম পৌঁছাবেন।”

শহীদের মায়ের প্রতিক্রিয়া
শহীদ মুস্তাফিজের শাহাদাতের দীর্ঘদিনের ব্যবধানেও স্বাভাবিক হতে পারেননি। শহীদের আম্মা বলেছিলেন, “মুস্তাফিজ যে কেমন ছিল তা বলে পারা যাবে না। ওকে হারিয়ে কোন মা-ই বেঁচে থাকতে পারে না।”

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুস্তাফিজুর রহমান

পিতা

মোঃ আব্দুল জলিল

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৬ জন

স্থায়ী ঠিকানা

ছোট গোপালপুর, তালবাড়ি, যশোর

সাংগঠনিক মান

সদস্য

সর্বশেষ পড়ালেখা

এম এস এস, শেষ বর্ষ, অর্থনীতি

শাহাদাতের স্থান

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়