শহীদ জাফর জাহাঙ্গীর

১৯ জানুয়ারি ১৯৬৩ - ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ | ১৪

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

“সেলিম জাহাঙ্গীরের মত যদি জাফর জাহাঙ্গীরও শহীদ হত!” শাহাদাত মুমিন জীবনের কাম্য। সেই কামনা থেকেই এই উক্তিটি করেছিলেন জাফর জাহাঙ্গীর; সেলিম জাহাঙ্গীরের শাহাদাতের পর। তাঁর এই কামনাকে মহান আল্লাহ কবুল করেন সেলিম জাহাঙ্গীরের শাহাদাতের মাত্র ৪০ দিন পর।

ব্যক্তিগত পরিচিতি
আবু জাফর মুহাম্মদ মনসুর (জাফর জাহাঙ্গীর) ১৯৬৩ সালের ১৯ জানুয়ারি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মা আনোয়ারা বেগম ও বাবা আবুল বাশার। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

শিক্ষাজীবন
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-এর যন্ত্রকৌশল বিভাগের চূড়ান্ত পর্বের ছাত্র ছিলেন।

সাংগঠনিক পরিচয়
শহীদ জাফর জাহাঙ্গীর বাংলাদেশ কারিগরি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। শাহাদাতকালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ‘সাথী’ জাফর জাহাঙ্গীর চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখার ক্রীড়া সম্পাদক ও ক্যাম্পাস বিভাগের সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

শাহাদাত
স্বৈরাচারী এরশাদের লেলিয়ে দেয়া জাতীয় ছাত্রসমাজের সশস্ত্র গুণ্ডাদের নিষ্ঠুর বুলেটে জীবন দেন আল্লাহর দ্বীনের পতাকাবাহী এই তরুণ ১৯৮৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ইসলামী আন্দোলনের অব্যাহত অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার হীন মানসে পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের চিরন্তন আদর্শ ও কর্মীদের আকর্ষণীয় চারিত্রিক গুণাবলির কারণে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সাধারণ ছাত্ররা দলে দলে ছাত্রশিবিরের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। কয়েক বছরের ব্যবধানে ইসলামী ছাত্রশিবির সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্রসংগঠনে পরিণত হয়। ছাত্রদের সমর্থন নিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির পরপর কয়েক বছর পলিটেকনিক কলেজ ছাত্র-সংসদে কখনো আংশিক আবার কখনো পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয়। খোদাদ্রোহী অপশক্তির কাছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের এই অগ্রগতি ও জনপ্রিয়তা সহ্য হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে শিবিরের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার অপপ্রয়াস চালায়। আর এই হীন উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজ নামধারী দুর্বৃত্তদের হাতে তুলে দেয়া হয় অর্থ ও অস্ত্র।

১৪ ফেব্রুয়ারি ঘটনার দিন সাধারণ ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে হোস্টেলে অবস্থান করছিলো, কাপুরুষের দল রাতের অন্ধকারে হামলা করে। রাত নয়টা থেকে দুর্বৃত্তরা ব্যাপক বোমাবাজি ও গুলি ছুড়ে ভয় আর আতঙ্ক সৃষ্টি করে। জাতীয় ছাত্রসমাজ নামধরাী এ সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে সাধারণ ছাত্ররা। ছাত্ররা রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়ে সন্ত্রস্ত অবস্থায় প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। দুর্বৃত্তরা কক্ষে কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে টার্গেটকৃত ছাত্রদের খুন করতে উদ্যত হয়। ১ নম্বর হোস্টেলে জাফর জাহাঙ্গীর অন্যান্য কর্মীদের নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসীরা জাফর জাহাঙ্গীরের দিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় জাফর জাহাঙ্গীরের সতেজ দেহ। তখন রাতের নীরবতার সাথে সাথে সমস্ত এলাকাজুড়ে নেমে আসে আতঙ্ক আর নিস্তব্ধতা। টগবগে এক তরুণের জীবনপ্রদীপ ঘটনাস্থলেই নিভে যায়, আর মহান আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যান তিনি শহীদের মর্যাদা নিয়ে। নরপিশাচরা খুনের পিপাসা মিটিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে চলে যায়।

ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ে শিবির নেতার শাহাদাতের খবর। শিবিরকর্মীরা তাদের সতীর্থকে হারানোর ব্যথায় কান্নায় ভেঙে পড়ে। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এই হত্যাকাণ্ড চললেও পুলিশ তার চিরায়ত রূপ বজায় রাখে। তারা এসে এই বীর শহীদের লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

লাশ দেখার সুযোগ পেল না শহীদের সাথীরা
জালেম সরকার এই শহীদের লাশ কাউকে দেখার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। শহীদের সাথীরা তাদের প্রিয় ভাইকে সামনে নিয়ে জানাজা পড়তে পারেননি। শহীদ জাফর জাহাঙ্গীরের পরিবারবর্গ বাস করেন চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনিতে কিন্তু তাদের কাছে লাশ হস্তান্তর না করে তাঁর গ্রামের বাড়ি ছাগলনাইয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হয় কড়া পুলিশ পাহারায়। শোকার্ত পিতা-মাতা ও ভাই-বোনকে শেষবারের মত তাদের প্রিয় জাফর জাহাঙ্গীরের পবিত্র মুখখানি পর্যন্ত দেখতে দেয়নি সরকার। এই নিষ্ঠুর খুনের পর দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শহীদের অনুগামীরা নেমে আসেন রাজপথে। ১৫ তারিখ রাজধানীতে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বিনা উস্কানিতে কাঁদুনে গ্যাস শেল ফাটায় ও ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। জালেমের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের লাঠির আঘাতে ছাত্রশিবিরের অনেক কর্মী সেদিন আহত হন। কক্সবাজারেও একই ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করে।

শাহাদাত ছিল কাম্য যাঁর
শহীদ জাফর জাহাঙ্গীর শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা মনে প্রবলভাবে পোষণ করতেন। শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীরের দাফন শেষে রুমমেটদের তিনি বলেছিলেন, ‘সেলিম জাহাঙ্গীর শহীদ হয়, সব জাহাঙ্গীর শহীদ হয় অথচ আল্লাহ আমি জাফর জাহাঙ্গীরকে কেন শহীদ হিসেবে কবুল করে না!’ শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী পরিবেশের কারণে মা জাফর জাহাঙ্গীরকে শিবির করতে নিষেধ করলে তিনি মাকে বলতেন, ‘আমি শাহাদাত বরণ করলে এদেশে ইসলামী বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হবে।’ আল্লাহপাক সত্যিই জাফর জাহাঙ্গীরের কামনাকে কবুল করে নিলেন। মূলত প্রতিটি ঈমানদারেরই শাহাদাত কাম্য হতে হবে। ঈমান গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য পরম করুণাময়ের সন্তুষ্টি অর্জন করা। শত-সহস্র সমস্যার আবর্তে জড়িত এ পৃথিবীতে সহজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও বিনা হিসাবে যারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট আল্লাহও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, “যাঁরা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাঁদেরকে তোমরা মৃত বল না বরং তাঁরা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ নিজের অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তার প্রেক্ষিতে তাঁরা আনন্দিত।” (সূরা আলে ইমরান : ১৯, ১৭০)

ইসলামী বিপ্লবকে শহীদ জাফর জাহাঙ্গীর নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাই শাহাদাতের প্রবল আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও তাঁকে শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন। শহীদের কামনা ছিল, “ইসলামী বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হবে” তাঁর শাহাদাতের কারণে। কথাটিতে এক বিরাট তাৎপর্য লুকিয়ে আছে। দুনিয়ায় আল্লাহর দ্বীন কায়েম হবে শহীদের খুনের নজরানার বদৌলতে অথচ সেই দুনিয়াবি ফল ভোগ করার জন্য দুনিয়ায় থাকবে না। কত বড় ত্যাগ! এ ত্যাগের পুরস্কার তো এমন যা দেখে অন্য সকল ঈমানদার লোভাতুর হবেন। দুনিয়ার সর্বস্ব যিনি একমাত্র আখিরাতের কল্যাণে ত্যাগ করতে পারেন তিনি কতো বড় আল্লাহপ্রেমিক এটা তাঁর শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রমাণ মেলে।

একনজরে শহীদ আবু জাফর মুহাম্মদ মনসুর (জাফর জাহাঙ্গীর)
নাম : আবু জাফর মুহাম্মদ মনসুর (জাফর জাহাঙ্গীর)
মায়ের নাম : আনোয়ারা বেগম
বাবার নাম : আবুল বাশার
ভাই-বোন : ২ ভাই ও ২ বোন
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান : দ্বিতীয়
জন্ম তারিখ : ১৯ জানুয়ারি, ১৯৬৩
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- লক্ষ্মীপুর, ডাকঘর- শান্তিরহাট, ৬ নং ওয়ার্ড, ৮ নং ইউনিয়ন, থানা- ছাগলনাইয়া, জেলা- ফেনী
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাস
শাহাদাতের তারিখ : ১৪ ফেব্র“য়ারি, ১৯৮৬ সাল
সাংগঠনিক মান : সাথী
দায়িত্ব : শাহাদাতের সময় চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখার ক্রীড়া সম্পাদক ও ক্যাম্পাস সহকারী পরিচালক ছিলেন
বিশেষ উক্তি : “সেলিম জাহাঙ্গীরের মত যদি জাফর জাহাঙ্গীরও শহীদ হত!”

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ জাফর জাহাঙ্গীর

পিতা

আবুল বাশার

মাতা

আনোয়ারা বেগম

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ১৯, ১৯৬৩

ভাই বোন

দুই ভাই দুই বোন মাঝে দ্বিতীয়

স্থায়ী ঠিকানা

লক্ষ্মীপুর, শান্তিরহাট, ৬ নং ওয়ার্ড, ৮ নং ইউনিয়ন, ছাগলনাইয়া, ফেনী।

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট

শাহাদাতের স্থান

চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট


শহীদ জাফর জাহাঙ্গীর

ছবি অ্যালবাম: শহীদ জাফর জাহাঙ্গীর


শহীদ জাফর জাহাঙ্গীর

ছবি অ্যালবাম: শহীদ জাফর জাহাঙ্গীর