শহীদ আব্দুল মতিন

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ১১ মে ১৯৮৫ | ৬

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

আল কুরআনের সাথে মুমিনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কোনো প্রকার লোভ-লালসা, হুমকি, ষড়যন্ত্র এই সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে না। শহীদ আবদুল মতিন এমনই এক মুমিন। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ‘সাম্প্রদায়িক ও ভারত-বিরোধী বক্তব্যের দায়ে’ আল-কুরআন বাজেয়াপ্ত করার আদেশ চেয়ে দায়ের করা একটি মামলা গ্রহণ করেন আদালত। আদালতের এমন সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি এই বাংলাদেশ থেকে। এবং বাংলাদেশের কুরআনবিরোধী, মানবতাবিরোধীদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। সে সময় দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন শহীদ আবদুল মতিন।

পরিচিতি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের দ্বারিয়াপুর গ্রামে ১৯৬৯ সালে এক ধার্মিক পরিবারে শহীদ আবদুল মতিন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নূর মোহাম্মদ আর মায়ের নাম মোসাম্মাৎ মাজেদা বেগম। শহীদ আবদুল মতিনরা ছিলেন সাত ভাই এক বোন। ভাইদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল ষষ্ঠতম।

শিক্ষাজীবন
শহীদ আবদুল মতিনের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয় পরিবারে। এরপর তাঁকে দ্বারিয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। এখান থেকে তিনি পঞ্চম শ্রেণী পাস করেন। পরে তাঁকে কাশিমপুর এ.কে ফজলুল হক উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছাত্র ছিলেন। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবদুল মতিনের প্রাণোচ্ছল পদচারণা ছিল। তিনি খুব সুন্দরভাবে বক্তৃতা দিতে পারতেন। স্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।

সাংগঠনিক জীবন
ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে তাঁর ভগ্নিপতির দাওয়াতের মাধ্যমে তিনি সংগঠনের পতাকাতলে আসেন। অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি সংগঠনের কর্মী পর্যায়ে উন্নীত হন। শাহাদাতের সময় তিনি সংগঠনের ‘সাথী প্রার্থী’ ছিলেন।

জীবনযাত্রা
আজীবন শান্তশিষ্ট ও ধর্মানুরাগী শহীদ কখনো সালাত আদায়ের কথা ভুলে যাননি। আজানের সময় হলে বন্ধু মাহফুজ ও মতিনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো কার আগে কে আজান দেবে। মা যে আদেশ দিতেন তা একবাক্যে মেনে নিতেন। প্রতিবেশীর বিপদ-আপদে ছুটে যেতেন সবার আগে।

শাহাদাত
আবদুল মতিন সেদিন মিছিলের অগ্রভাগেই ছিলেন। পুলিশের হুমকি-ধমকিতেও কিশোর আবদুল মতিন ভয় পাননি। ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাননি। কুরআনের মর্যাদা রক্ষার শপথ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেদিন যিনি প্রথম আঘাত পেয়েছিলেন তিনি হলেন কিশোর আবদুল মতিন। গুলিবিদ্ধ আবদুল মতিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। শহীদের আন্দোলনের আরো ৪ জন সহযোদ্ধা ছাড়াও এই হামলায় তৌহিদি জনতার মধ্য থেকেও তিনজন শহীদ হন। তারা হলেন, শহীদ আলতাফুর রহমান (কৃষক), শহীদ মোখতার হোসেন (রিকশাচালক) ও শহীদ নজরুল ইসলাম (রেল শ্রমিক)। এ শহীদি ঘটনা প্রমাণ করে, কুরআনের মর্যাদা রক্ষায় সেদিন ছাত্রশিবিরের সাথে সাধারণ জনগণও তীব্র প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল।

জানাজা ও দাফন
শহীদ আবদুল মতিনের একাধিক নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ নিজ গ্রামে নামাজে জানাজা শেষে বাড়ির অদূরে নির্জন কবরগাহে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। শহীদ আবদুল মতিন চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। আজ পৃথিবীতে কুরআনের অপমান হলে আবদুল মতিন আসবেন না সত্য, তবে তিনি যে পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন সে পথে চলে জীবন দেয়ার মত মানুষের আজ অভাব নেই এই বাংলাদেশে।

শহীদের মায়ের প্রতিক্রিয়া
শহীদ হওয়ার পর শহীদের মা ‘আল্লাহর দেয়া জীবন তিনি তাঁর নিজের পথে নিয়ে গেছেন’ বলে ধৈর্য ধারণ করেন। নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াত করে তাঁর শাহাদাত কবুলের জন্য আল্লাহর কাছে তিনি দোয়া করেন। এখনও ১১ মে এলে কলিজার টুকরোকে ভুলে যেতে কষ্ট হয় মা মোছাম্মাৎ মাজেদা খাতুনের। তবুও তিনি ধৈর্য ধারণ করেন আর ছেলের জন্য দোয়া করেন।

এক নজরে শহীদ আবদুল মতিন
নাম : আবদুল মতিন
মাতার নাম : মোসাম্মাৎ মাজেদা বেগম
পিতার নাম : নূর মোহাম্মদ
সাংগঠনিক মান : সাথী প্রার্থী
সর্বশেষ পড়াশোনা : দশম শ্রেণী
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : কাশিমপুর এ.কে ফজলুল হক উচ্চবিদ্যালয়
শখ : ছোট ছেলেদের নিয়ে সংগঠন করা
আহত হওয়ার স্থান : ঈদগাহের দক্ষিণ গেট
শহীদ হওয়ার স্থান : রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
যাদের আঘাতে শহীদ : পুলিশের গুলিতে
আঘাতের ধরন : গুলি
শহীদ হওয়ার তারিখ : ১১ মে, ১৯৮৫
স্থায়ী ঠিকানা : দ্বারিয়াপুর, চৌহদ্দিটোলা, নবাবগঞ্জ
ভাই-বোন : ৭ ভাই, ১ বোন
ভাইদের মধ্যে অবস্থান : ৬ষ্ঠ

আল কুরআনের সমাবেশের ৫ শহীদ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হাইকোর্টের ধৃষ্টতামূলক সিদ্ধান্তের কারণে মুসলিম বিশ্ব প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের তৌহিদী জনতা ১৯৮৫ সালের ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। সে সমাবেশে যোগ দিতে চারদিক থেকে লোকেদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়।

১১ মে, ১৯৮৫; চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঈদগাহ : সমাবেশের প্রেক্ষাপট
কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হয় কুরআন বাজেয়াপ্ত করার জন্য। অভিযোগে বলা হয় কুরআনের অনেক আয়াতে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়ার কথা আছে। কলকাতা হাইকোর্ট মামলাটি গ্রহণ করে। এ খবর শুনে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা কুরআন বাজেয়াপ্ত করার অপমানজনক উদ্যোগে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের তৌহিদী জনতাও বিক্ষোভে-বিক্ষোভে সারাদেশ উত্তাল করে তোলেন। সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মত চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুসলমানরাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। প্রতিবাদ জানানো ছাড়া উপায় নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল জনাব হোসাইন আহমেদ সাহেব ডাক দিলেন প্রতিবাদ সভার।

যা ঘটেছিল সেদিন
সমাবেশের ৩ ঘণ্টা আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সভা উদ্যোক্তাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। চাপ প্রয়োগ করে সভা বাতিলের জন্য কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করলেন। বেলা তখন ১১টা, সভা শুরু হওয়ার আর বাকি ৩ ঘণ্টা। সরকারি মাইকে ঘোষণা আসতে লাগল সভা বাতিলের। দু’তিন ঘণ্টায় আর কতটুকু খবর ছড়াতে পারবে সরকার। নবাবগঞ্জের আশপাশ, শিবগঞ্জ, গোদাগাড়ী, কানসাটসহ বিশ-ত্রিশ মাইল দূরের লোকজন পূর্বেই এ সভার দাওয়াত পেয়েছিল, তারা সবাই প্রস্তুতি নিয়েছে সভায় যোগদানের।

নির্দিষ্ট সময়ে মিছিলে-মিছিলে ছেয়ে গেল সভাস্থল। পুলিশ সুপারের পক্ষে আদেশ দেয়া ছিল সহজ কাজ। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল ঠেকানো এত সহজ কাজ ছিল না। সরকারি মাইকিং-এর হলো উল্টো প্রতিক্রিয়া, শহর আর আশপাশ এলাকা থেকেও ততক্ষণে কয়েক হাজার মুসলমান এসে ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হয়েছেন। তাছাড়া ছিল দূর-দূরান্ত থেকে আসা আরো হাজার হাজার মানুষ। এদের রুখতে পারে সে শক্তি কোথায়? জনতার এ সমাবেশের খবর পেয়ে কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে ছুটে এলো পুলিশ। পুলিশের এক কথা, এখনই ময়দান খালি করে সবাইকে চলে যেতে হবে। কুরআনপ্রেমিক জনতা কুরআনের অপমানে ক্ষুব্ধ হয়ে হৃদয়ের অব্যক্ত বেদনা প্রকাশের একটু সুযোগ চাইল।

সভা আহ্বানকারী আলেমগণ এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমরা উপস্থিত জনতাকে সভা না করার ঘোষণাটি জানিয়ে দেই, আর একটু দোয়া করে চলে যাই। পাষণ্ড ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান তাও সইতে পারলো না। দম্ভ করে চেঁচিয়ে বলল, এ মুহূর্তেই এ স্থান ত্যাগ করতে হবে। নইলে গুলির আদেশ দেবো, শালা মৌলবাদীদের সাফ করে দেবো। উত্তেজিত আবেগাকুল জনতা চলে গেলেন না, তারা জানিয়ে দিলেন, গুলির ভয়ে এ স্থান ত্যাগ করা মানেই আল কুরআনের অপমান। আমরা এ স্থান ত্যাগ করবো না।

কুখ্যাত মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান নির্দেশ দিলেন গুলি চালানোর। কোন্ অপরাধে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হল? তা কেউ জানে না, বিনা উস্কানিতে এক নাগাড়ে গুলি চললো পনের মিনিট। গুলিতে একজন ঢলে পড়তে না পড়তেই আরেকজন শিকার হতে লাগল। জনতা দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল। ছুটন্ত লোকজনের পিছু ধাওয়া করে শহরের অভ্যন্তরেও গুলি চালাতে থাকে খুনিরা। টুপি, পাঞ্জাবি আর দাড়ি দেখলেই নির্মমভাবে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। যেন ভারতে নিরীহ মুসলিমরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়েছে- এমন অবস্থা সৃষ্টি হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জে!

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আব্দুল মতিন

পিতা

নুর মোহাম্মদ

মাতা

মোসাম্মাৎ মাজেদা বেগম

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৭ ভাই, ১ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

দারিয়াপুর, চৌহদ্দিটোলা, নবাবগঞ্জ

সাংগঠনিক মান

সাথী প্রার্থী

সর্বশেষ পড়ালেখা

১০ম শ্রেণী, কাশিমপুর এ, কে ফজলুল হক উচ্চ বিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

চাঁপাইনবাবগঞ্জ


শহীদ আব্দুল মতিন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল মতিন


শহীদ আব্দুল মতিন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল মতিন