শহীদ সাইফুদ্দীন আহম্মেদ

১৪ মার্চ ১৯৮৭ - ২৪ এপ্রিল ২০০৪ | ১২১

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

শহীদি ঈদগাহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। মতিহার চত্বরের রন্ধে রন্ধে মিশে আছে শহীদি খুনের নিশানা। আহত পঙ্গু-ভাইদের ত্যাগ-কুরবানি যেন আরেক বেদনার কারবালা। দিন যায় স্মৃতি থাকে। ঝরে যাওয়া বেদনার স্মৃতিবাহী নিশানা আজ একটি জীবন্ত ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সোনালী বুকে স্থান করে নিলেন দ্বীনের তলোয়ার শহীদ সাইফুদ্দীন আহমেদ। শহীদ শাব্বিরের পথ বেয়ে শাহাদাতের সিঁড়িতে (রাবির ১৫তম) শামিল হলেন তিনি। প্রেরণার মিছিলে তিনি ১২১তম শহীদ।

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
নবাগত ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতা করা শিবিরের দাওয়াতী মিশন। এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বাধিক ২ লাখ ৮ হাজার ভর্তি ফরম বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে ১ম বর্সে ভর্তি হতে পারবে মাত্র ৩৪২৫ জন শিক্ষার্থী। সুতরাং ভর্তিযুদ্ধের তীব্র প্রতিযোগিতা যেন দুনিয়াবী ফুলসিরাত। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্যে শিবিরের এই নিঃস্বার্থ মিশনে উপকৃত হয় কোমলমতি জ্ঞান-পিপাসুরা। ফলে আদর্শিক বিজয়ের দ্বার উন্মোচিত। তাইতো মানবতার দুশমন, সন্ত্রাসীরা আদর্শিকভাবে পরাজিত হয়ে খুনের নেশায় উন্মাদ হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে তারা। ফরম বিক্রির তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামলা চালায় শিবিরের টেন্ডে। ছাত্রদলের নামধারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে। সেদিন ১৩ জানুয়ারি ’০৪। কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ অধিবেশন ছিল পূর্ব নির্ধারিত। ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি, মহানগরী সভাপতিসহ নেতৃবৃন্দ ছিলেন ঢাকায়। মোবাইলে সংবাদ পেয়েই নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি শান্ত রাখা নির্দেশ দেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি রেজাউল ভাইসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে তাড়াতাড়ি রাজশাহী যেতে বলেন। ইতোমধ্যেই বিএনপি রাজশাহী মহানগরী সহসভাপতি ও জামায়াতের সেক্রেটারি আজাদ ভাইয়ের মাধ্যমে ঘটনার মীমাংসা হয়ে যায়।

আমরা রাতে ফোনে, মোবাইলে আর যেন কোন ঘটনা না ঘটে সেই ব্যাপারে ঐকমত্য হলাম। আঁধার চিরে ভোর হল, ১৪ জানুয়ারি ’০৪। সূর্যের প্রখরতা ক্রমেই বেড়ে উঠলো। ষড়যন্ত্রকারীদের খুনের নেশা তাদের দলীয় আদর্শ ও আর ছাত্রঐক্যের চলমান গতিধারাকে ম্লান করে দিল। তারা কাজলা গেটে ওঁৎ পেতে শিবির নেতা-কর্মীদের হত্যার পরিকল্পনায় প্রহর গুনত থাকলো। সকাল প্রায় ১১টা। ৫ম পরীক্ষা শেষ, ৬ষ্ঠ পরীক্ষা পরদিন। পড়াশুনা আর রেজাল্ট ফার্স্ট কাস ফার্স্ট করার চিন্তায় নোট-পত্র ম্যানেজ করতে শহীদ সাইফুদ্দীন আহমেদ ছিলেন মহাব্যস্ত। বন্ধর ভাল নোট ফটেকাপির জন্য তিনি গেলেন কাজলা গেটে। দাঁড়ি আর টুপি, পায়জামা আর পাঞ্জাবী উপরন্ত আরবী বিভাগের ১ম বর্ষের মেধাবী ছাত্র। তার গতিরোধ করেই খুনীরা উপর্যুপরি রড, হাতুড়ি আর চাইনিজ কুড়ালের আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে। রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন, বাঁচাও-বাঁচাও বলে আর্তচিৎকার করেও রক্ষা পেলেন না তিনি। লুটিয়ে পড়লেন রাস্তার উপর মাত্র ২০ গজ দূরে পুলিশ নির্বাক, নির্লজ্জ অবস্থান। কিন্তু পুলিশ অথবা শত শত দর্শক অপরিচিত হুজুর বলে মানবিক কারণেও এগিয়ে আসেনি। হায় মানুষ! হায় পুলিশ! হায় মানুষ নামের হায়েনা ছাত্রদল। একবার, দুইবার হামলার পরও যখন সাইফুদ্দীন প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর্যন্ত মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, তিনি মরেননি ভেবে ছাত্রদলের খুনীরা তৃতীয়বার রড আর হাতুড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে তার মাথাকে করে দেয় চূর্ণ-বিচূর্ণ। তার নিশ্চিত মৃত মনে করে খুনীরা পালিয়ে যায়। অবশেষে ব্যবসায়ীদের অনুরোধে পুলিশ প্রায় ১১.৩০ টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু মাথায় এত বেশি আঘাত ছিল যে সেলাই দেয়ার জায়গা ছিল না। রক্তক্ষরণ যেন মুষলধারার বৃষ্টি। হাসপাতালে সেই করুণ দৃশ্য দেখে আমরা সবাই কাঁদছিলাম। কিন্তু কী হবে আর কেঁদে, অশ্রুধারায় নিজেদের ভাসিয়ে? শোককে শক্তিতে পরিণত করে সাইফুদ্দীন বাঁচানোর শত চেষ্টা অব্যাহত থাকলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরসহ ডজনখানেক শিক্ষক ছুটে গেলেন হাসপাতালে। যত টাকার প্রয়োজন হয় তা দেয়ার প্রত্যয়, মানবিক অঙ্গীকার দিয়ে ডাক্তারকে চিকিৎসার সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালানোর অনুরোধ করলেন। এভাবে কেটে গেল প্রায় ৪০ ঘন্টা। অবশেষে শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর ভাইস চ্যান্সেলরের নির্দেশে বিমানযোগে তাকে ১৬ জানুয়ারি ’০৪ দুপুরে ঢাকা সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হল। কিন্তু প্রায় ৩৩ দিন পরও জ্ঞান ফিরলো না। আব্বা আম্মা সার্বক্ষণিক হাসপাতালে প্রিয় সন্তানের পাশে অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর হয়ে হয়ে বসে থাকতেন। কোনো মা-বাবা কী পারেন এমনি নির্মম, বেদনা-বিধুর, মর্মস্পর্শী দৃশ্য সহ্য করতে? প্রায় ৩৪ দিন পর জ্ঞান ফিরলো তার। হতাশার কুব্জটিকা ভেদ করে বিচ্ছুরিত হলো আশার প্রদীপ। এভাবে ১৬ জানুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ- ২ মাস চিকিৎসাধীন থাকলেন সামরিক হাসপাতালে। অতঃপর সর্বশেষ ঢাকার ‘হার্ট এন্ড চেস্ট’ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এপ্রিলের ২৪ তারিখে মাগরিবের আজান হলো। নামাজীরা মসজিদে নামাজরত। ঠিক এমনি মুহূর্তে সাইফ্দ্দুীন ভাই আম্মাকে শেষ সালাম দিয়ে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য পাড়ি দিলেন এ ইহজগত। হাসপাতালসহ সারাদেশে কান্নার রোল পড়ে গেল। হাহাকার আর চিৎকারের বেদনা-বিধুর সুর ধ্বনিত হল- ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন।

শহীদের মা বাবার প্রতিক্রিয়া
তিনি ছিলেন নিষ্পাপ, চরিত্রবান, অতীব আদরের মায়াকাননের এক ফুটন্ত গোলাপ। দাদী-নানীর চোখে তিনি ছিলেন কুরআনের এক মহাসাধক। মায়ের কাছে তিনিই একমাত্র সংসারের ভাসমান মাঝদরিয়ার ডুবন্ত তরীর দক্ষ নাবিক। বোনদের ভাষায় সাইফুদ্দীন ছিলেন তাদের শেষ সম্বল। কিন্তু আজ কেন তাঁর আব্বা-আম্মা, দাদী-নানী, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন বেদনার সাগরে ভাসমান?

শহীদের শিক্ষকের প্রতিক্রিয়া
জানাযা উত্তর সমাবেশে শহীদের শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান বলেন; তিনি ছিলেন সৎ, চরিত্রবান, নম্র-ভদ্র, অমায়িক মেধাবী ছাত্র। দাখিল, আলিম, ফাজিল ১ম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ তিনি ছিলেন অতীব মেধাবী। কোন ছাত্র কোন শিক্ষক তাঁর ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে বলে নজির নেই। সত্যিই যিনি শহীদ, যিনি জান্নাতের পথযাত্রী, যুগে যুগে কালে কালে সেই শহীদের জীবন ফুলের মতই আকর্ষণীয় ও পবিত্র হয়। শহীদ সাইফুদ্দীন তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

এক নজরে শহীদ সাইফুদ্দীন আহমেদ
নাম : সাইফুদ্দীন আহমেদ
পিতা : মো. মমতাজ উদ্দিন
মাতা : মোসা. হাজেরা বেগম
জন্ম তাং : ১৪ মার্চ ১৯৮৭
ঠিকানা : গ্রাম - ধাওয়াপিকশন, পোস্ট - কাহালু, থানা- বগুড়া সদর, জেলা- বগুড়া
ভাইবোন : ২ ভাই, ৩ বোন, ভাইবেনদের মধ্যে সবার বড়
শিক্ষাগত যোগ্যতা : আরবী, অনার্স ১ম বর্ষ (রাবি); দাখিল, আলিম, ফাজিল ১ম বিভাগ

সাংগঠনিক মান: কর্মী
ঘটনার বিবরণ : ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হেলিকাপ্টার যোগে ঢাকা সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৩ মাস ১০ দিন হাসপাতালে থাকার পর হঠাৎ জ্ঞান ফেরে । তার পরের দিন শাহাদাত বরণ করেন।
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রদল সন্ত্রাসী
শহীদ হওয়া তা: ২৪ এপ্রিল ২০০৪
আহত হওয়ার স্থান : কাজলা গেট রাবি।
কবরস্থান : ধাওয়া ফিকশান পারিবারিক গোরস্তান
যে শাখার শহীদ : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
শখ : পড়াশুনা (ইসলামী সাহিত্য)

শিক্ষকের মন্তব্য
দারিয়াল মহ্য়িল উলুম তাখিল মাদরসার গণিত শিক্ষক মো: মোজাম্মেল হক বলেন, যে খুবই ভদ্র, নাম্র ছিল। সে মিতব্যায়ী ছিল। অংকে খুবই ভাল ছিল সে একমাত্র অংকে লেটারকারী ছাত্র ছিল। মো: নুরুল আলম (প্রাইভেট শিক্ষক) দীর্ঘ ৪ বছরের অভিজ্ঞাতা থেকে বলেছেন, সে খুবই মেধবাী। অন্যান্য ছাত্রদের থেকে ক্ষধায়র।

মায়ের মক্তব্য
খুবই ধৈর্যশীল এস কোনদিন আমাদের প্রতিবাদ করেনি। তার শ্রদ্ধঅবোধ আমাদের কে মুগ্ধ করেতো। সে তার ভাই বোন কে খুবই আদর করতো।
মোসা: রহিমা খাতুন ভাই বোনদের মধ্যে ৩য অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী বলেছেন, সে শহীদ হওয়ার যোগ্যতা সম্পূর্ণ ছিল বিধায় মহান আল্লাহ তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন সে তার জীবনে কোনদিন কোনো অন্যায়ভাবে আমাদেরকে প্রহার করেননি। মাসা : মহসিনা খাতুন ভাইবোনদের মধ্যে ৪র্থ ফাযিল ১ম বর্ষের ছাত্রী তিনি বলেছেন আর যাই হোক আমি পৃথিবীর সর্বশেষ্ট উপহারটা পেয়েছি খোধার নিকট থেকে কারণ তিনি খুবই খোদাভীরু ছিলেন।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ সাইফুদ্দীন আহম্মেদ

পিতা

মো. মমতাজ উদ্দিন

মাতা

মোসা. হাজেরা বেগম

জন্ম তারিখ

মার্চ ১৪, ১৯৮৭

ভাই বোন

২ ভাই, ৩ বোন, ভাইবেনদের মধ্যে

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম - ধাওয়াপিকশন, পোস্ট - কাহালু, থানা- বগুড়া সদর, জেলা- বগুড়া

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

আরবী, অনার্স ১ম বর্ষ রাবি

শাহাদাতের স্থান

ঢাকা সামরিক হাসপাতাল


শহীদ সাইফুদ্দীন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ সাইফুদ্দীন


শহীদ সাইফুদ্দীন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ সাইফুদ্দীন