শহীদ মাহমুদুল হাসান

০১ জুন ১৯৯৩ - ২৮ মার্চ ২০১৩ | ১৫৪

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

“আল্লাহ আমার হায়াতের বিনিময়ে হলেও ভাইয়াকে রক্ষা করো” ছোট বোনের আহাজারি

শহীদের পরিচিতি
রংপুর মিঠাপুকুরের পায়রাবতী গ্রামে শহীদ মো: মাহমুদুল হাসান ১৯৯৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ৩য় সন্তান। ৩ ভাই ২ বোনের সংসারে মাদ্রাসার শিক্ষক পিতা মাওলানা আব্দুল হাই সন্তানকে আলেম হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই ভর্তি করিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। সাইনাসের সমস্যার কারণে মাহমুদ মারাত্মকভাবে অসুস্থ' থাকায় ২০১২ সালে আলিম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও একটি সাবজেক্টে খারাপ করেন। গত ১ এপ্রিল ২০১৩ তিনি সেই সাবজেক্টে আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় এর এক মাস আগেই ২৮ ফেব্রুয়ারি জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে সর্বোচ্চ পুরস্কার নিতে চলে যান।

যেভাবে তিনি আল্লাহর ডাকে চলে গেলেন
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ঘটনাস্থল শহীদের নিজ বাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার। সকালে ফজরের নামাজের পূর্বেই ফোনে কর্মীদের ডেকে তুলেন। অতঃপর নামাজ শেষে কিছুক্ষণ কুরআন হাদিস পড়েন। পাড়ার ৫-৬ জন ছাত্র-বন্ধুসহ মায়ের হাতে তৈরি জীবনে শেষ খাবার খেয়ে, মাকে বলে বেরিয়ে পড়েন। ৩-৪টা সাইকেলে ২ জন করে বসে সকাল ৭টায় মিঠাপুকুরে চলে যান। সেদিন মিঠাপুকুরে বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত লোক দলবেঁধে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে কেউ রিকশা, কেউ বাইসাইকেল, মোটরসাইকেলে আবার কেউবা নসিমনে করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। সেখানে হাজার হাজার এলাকাবাসীর সাথে উল্লেখিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন তিনিও।

তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ-বিজিবি নির্বিচারে শত শত রাউন্ড টিয়ার শেল ও গুলিবর্ষণ করতে থাকে। প্রায় ৩৫-৪০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। ঘটনাস্থলেই ৫ জন শহীদ হন। বেলা ২.৪৫ মিনিটে মাহমুদ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। সাথে সাথে তার সাথীরা তাকে পাশের বাড়িতে নিয়ে রেখে তারা আবার মাঠে চলে আসে। বাড়ির মহিলারা অনেক চেষ্টা করেও তার রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারেননি। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করে কিন্তু পুলিশের ভয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে সেখানেই তিনি শাহাদাতবরণ করেন। এশার নামাজের পর বাড়ির পাশে আলুক্ষেতে জানাজা নামাজ শেষে বাড়ির পাশে মসজিদের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় প্রায় ৫ হাজার লোক হয়েছিল।

মাহমুদের শাহাদাতের তামান্না
শহীদ মো: মাহমুদুল হাসান ছাত্রশিবিরের সাথী এবং স্থানীয় উপশাখার সভাপতি ছিলেন। তিনি সমসময় দেশকে নিয়ে চিন্তা করতেন এবং সরকারের জুলুমের চেয়ে শহীদ হওয়াকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। আম্মাকে বলতেন, “আম্মা আমার জন্য দোয়া করবেন আঞ্চলিক সভাপতি আতাউর রহমান ভাইয়ের মতো কঠিন অবস্থায় যেন না পড়ি।”
আতাউর ভাই ৩ মাস জেলে ছিলেন। এ সময় পুলিশ তাকে নখ তুলে ফেলা, হাত-পায়ে শক দেয়াসহ কঠিন অত্যাচার করে। আম্মা, আমি যেন সরাসরি শহীদ হতে পারি। ২০১২ সালের ১লা জানুয়ারি রোববার অর্থাৎ ১৪ মাস আগে তার ডায়েরিতে লেখা ছিল, ‘জীবনের চেয়ে দীপ্ত মৃত্যু তখনই জানি শহীদি রক্ত হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানি।’ এবং ‘আজ যত প্রয়োজন গান গজলের আর যত প্রয়োজন শিল্পীর, তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন আজ সিংহ সাহসী কর্মীর।” ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি সোমবার তার ডায়েরিতে লেখা ছিল ‘সফল হবে তাদের আত্মত্যাগ, আজকে তাদের সব দায়িত্ব যদি, মাথায় পেতে চলি নিরবধি। তবেই সফল আজি, তাদের স্মরণ করা (মাহমুদ)।

তিনি শহীদি গান বেশি গাইতেন। যেমন, জান্নাতি বাগানে মোরা বুলবুল। শিউলি ফুল। উঠ শহীদ ওগো মুজাহিদ চলো কাফেলা ইত্যাদি।
গুলিতে তার শরীরের প্রায় সব রক্ত ঝরে গিয়েছিল। এই শাহাদাতের পর এলাকার ছাত্ররা ভয় না পেয়ে বরং আরো উজ্জীবিত হয়। কিছুদিনের মধ্যে তাদের সংখ্যা ১২ থেকে বেড়ে ২২ জনে উন্নীত হয়। যেন কবির ভাষায় ‘যে খুন ছড়াবে আগুন সবখানে।”

পরিবারের অতি প্রিয় মাহমুদ
মাহমুদ সর্বদা মায়ের খেদমতে ব্যস্ত থাকতেন। ছোট বোন ফারহানার লেখাপড়ায় তদারকি করতেন। তাকে মাদ্রাসায় সর্বদা আনা-নেয়া করতেন।
পিঠাপিঠি এই ছোট বোনের সাথে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। তার জীবনের সবকিছু অকপটে বোনের সাথে শেয়ার করতেন। কয়েকদিন আগে কথায় কথায় বলছেন, “বোন আমি আর আমার বন্ধু কাউছার (তৎকালীন তার উপশাখা সেক্রেটারি) জীবনে কখনো কবিরা গুনাহ করিনি।” কিছুদিন আগে ১টি মিছিলে যোগ দেয়ার সময় অন্যান্যদের মত তিনিও নিজের সাইকেল মাঠে রেখে যান। কিন্তু পুলিশ সব সাইকেল আটকিয়ে রাখে। কয়েকদিন পর কৌশলে পুলিশ থেকে সাইকেল নিয়ে এসে বোনকে বলেন, বোন আজকে একটি অন্যায় করে ফেলেছি। পুলিশকে ধোঁকা দেয়ার জন্য ১টি শার্ট গায়ে দিয়ে সিগারেট কিনে সামনের পকেটে রেখে সাইকেল নিয়ে এসেছি, পুলিশ সাধারণ ছেলে মনে করে ছেড়ে দিয়েছে। আর সিগারেট যাতে কেউ খেতে না পারে সে জন্য প্যাকেটটি পুকুরে ফেলে দিয়েছি। এই ঘটনা থেকে মাহমুদের বুদ্ধিমত্তা এবং তাকওয়ার পরিচয় পাওয়া যায়।
বড় বোন হুমায়রা স্বপ্ন দেখেন, একটি বিশাল ময়দানে মাহমুদ শুয়ে আছে। ঝকঝকে সে ময়দান কোন ঘাস নয় মনে হয় গালিচা বিছানো। উপরে সামিয়ানা নয় বরং আরো উন্নত, দামি কিছু। আর ভাইটার কেমন আলোঝলমল চেহারা।

গুলি লাগার খবর শুনে সবাই দিগি দিক হয়ে গিয়েছিল। ছোট বোন ফারহানা আল্লাহর কাছে আর্তনাদ করে বলেছিল, “আল্লাহ আমার হায়াতের বিনিময়ে হলেও ভাইয়াকে রক্ষা করো।” তার সে কান্না আজও থামে না, কবে থামবে কেউ জানে না।

ব্যক্তিগত প্রোফাইল
নাম : শহীদ মো: মাহমুদুল হাসান, ভাংনী মাদ্রাসা, আলিম পরীক্ষার্থী
সংগঠনের সাথী এবং ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন
জন্মতারিখ ও বয়স : ০১.০৬.১৯৯৩ ইং

আহত হওয়ার তারিখ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
আহতের ধরন ও পরবর্তী অবস্থা : পায়ের হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হন এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, কোন চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি
শাহাদাতের তারিখ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, চিরশয্যায় শায়িত হন বাড়ির নিকটেই মসজিদ পুকুরের পাড়ে
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম পায়রাবতী, ডাকঘর : হুলাশুগজ বাজার, ইউনিয়ন ৪ নং ভাংনী, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর
পিতা : এ এইচ এম আবদুল হাই (৬০), মাদ্রাসার সহকারী মাওলানা ও ইমাম।
মাতা : মরিয়ম বেগম (৫০), গৃহিণী।
ভাইবোনের বিবরণ : মু: মাহফুজুল ইসলাম, কামিল পাস, মাদ্রাসা শিক্ষক, লক্ষ্মীপুর, মু: মাসউদুর রহমান, অনার্স শেষ বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ; শহীদ মো: মাহমুদুল হাসান, হুমায়রা তাসনীম সোহাগী বিবাহিতা, জান্নাতুল ফেরদাউস ফারহানা, আলিম পরীক্ষার্থী, বালারহাট হামিদিয়া আলিম মাদ্রাসা।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মাহমুদুল হাসান

পিতা

এ এইচ এম আবদুল হাই

মাতা

মরিয়ম বেগম

জন্ম তারিখ

জুন ১, ১৯৯৩

ভাই বোন

৩ ভাই ২ বোনের মধ্যে ৩য়

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম পায়রাবতী, ডাকঘর : হুলাশুগজ বাজার, ইউনিয়ন ৪ নং ভাংনী, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ভাংনী মাদ্রাসা, আলিম পরীক্ষার্থী১

শাহাদাতের স্থান

মিঠাপুকুর


শহীদ মাহমুদুল হাসান

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মাহমুদুল হাসান


শহীদ মাহমুদুল হাসান

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মাহমুদুল হাসান