শহীদ মু. সাইদ রুবেল

০৫ জানুয়ারি ২০০০ - ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ | ১৫১

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

“সপ্তম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র রুবেলের পড়ার টেবিলটা তার জন্মের আগেই বাবা কবিরাজ হাট থেকে কিনেছিলেন। ১৪ বছর পরে সে টেবিলের দু’টি পায়া ভেঙে গেছে। অনেক যতনে দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে তা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ঘরে আর কোন আসবাবপত্রের বাহুল্য না থাকায় মায়ের পানের বাটা-চুনের কৌটাটাও টেবিলের এক কোণে ঠাঁই পেয়েছে। হাঁড়ি-পাতিলের নিরাপদ আশ্রয় তার টেবিলের নিচেই। ছালার বস্তা দিয়ে চেয়ার বানিয়ে এই টেবিলের এক কোনায় পড়ালেখা করতেন সাঈদ রুবেল। অবশ্য টেবিলের সামনেই বাঁশের বেড়ায় আটকানো একটি ওয়ালমেট তার ঘরকে যেন আলোকিত করে রাখতো। তাতে লেখা, ‘মা-বাবার দোয়া’। বাবা-মার করুণ কান্নার সুর যেন শেষ হয় না, ‘তোর জন্য আমরা কি দোয়া করেছিলাম রে বাপ?”

শহীদের পরিচিতি
শহীদ মো: সাঈদ রুবেল ঠাকুরগাঁও জেলা সদরের চোঙ্গাখাতা গ্রামে ২০০০ সালের জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতা রুহুল আমীন ও মাতা দেলোয়ারা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট এবং একমাত্র ছেলেসন্তান ছিলেন। বিশাল এই পৃথিবীতে তাদের এক চিলতে জমিও নেই। প্রতিবেশী শহীদুল ইসলাম দয়াপরবশ হয়ে আপাতত একটু থাকার জায়গা দিয়েছেন। সেখানেই গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৮ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তুলেছেন টিনের চালা আর বাঁশের বেড়ার দু’টি ছাপরাঘর। পিতা তালা-চাবি মেরামত ও দিনমজুরি করে দিনে যা ৫০-১০০ টাকা উপার্জন করেন তাই দিয়েই একান্ত কষ্টে সংসার চালান। তাই দরিদ্র পিতা-মাতা পারেননি পড়ালেখার ভালো কোন ব্যবস্থা করতে। বহু কষ্টে বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পর গড়েয়া ফাজিল মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেধাবী ছাত্র একমাত্র ছেলে সন্তান মো: সাঈদ রুবেলকে নিয়ে ভবিষ্যৎ স্বপ্নের জাল বুনছিলেন। কিন্তু ঘাতকের বুলেটের আঘাতে মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় পিতা-মাতার সে স্বপ্ন।

যেভাবে তিনি আল্লাহর ডাকে চলে গেলেন
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে গড়েয়ার তৌহিদি জনতার পাশাপাশি হাজার হাজার সাধারণ জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভ মিছিলে যোগদান করেন। মিছিল শুরু হলে পুলিশ ও বিজিবি যৌথভাবে মিছিলে হামলা করে। তারা মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে মো: সাঈদ রুবেল গুলিতে লুটিয়ে পড়েন এবং তার পিঠের পেছনে গুলি লেগে পেটের ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। তিনি ঘটনাস্থলেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। ১ মার্চ বাদ আসর বিকেল ৫টায় গড়েয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে শহীদের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানযার নামাজে ইমামতি করেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাওলানা আবু সাঈদ। জানাজায় প্রায় ২০-২৫ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন।

সামগ্রিক ঘটনার বিবরণ
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে গড়েয়া নয়াবাজারে ঠাকুরগাঁও উপজেলার জনসাধারণ বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এদিকে গড়েয়া ইউনিয়নের স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আশরাফুল আলম মানিক ও তার ছোট ভাই যুবলীগ নেতা যাদু মিয়া, পিতা মৃত তাজিম উদ্দীন থানা পুলিশকে খবর দেয় যে, এলাকার জনসাধারণ হিন্দুদের বাসাবাড়িতে, দোকানঘর ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করছে। এরূপ মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে জনতার ওপর এলোপাতাড়ি রাবার বুলেট ও গুলি নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে পুলিশ বিজিবিকে খবর দেয়। পরবর্তীতে বিজিবি ও পুলিশের যৌথ গুলিত মারা যায় তাৎক্ষণিক ৪ জন, ৪.৩.২০১৩ তারিখ ১ জন এবং ১৪.৩.১৩ তারিখে আরো ১ জন।

জাতীয় সংবাদমাধ্যমে এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রতিবেদন আসে; যেমন, দৈনিক আমার দেশ ১ মার্চ ২০১৩ লিখে, ঠাকুরগাঁওয়ে নিহত ৭ : ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাকুরগাঁওয়ে বিক্ষুদ্ধ জনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালালে ৭ জন নিহত হয়েছে। এতে মহিলাসহ গুলিবিদ্ধ হন অন্তত ২০ জন। এ ছাড়া আরো অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। গতকাল সকাল থেকেই এলাকায় কয়েক হাজার সাঈদীভক্ত জড়ো হতে থাকেন। রায় ঘোষণার পর পরই ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা গড়েয়ায় বিক্ষুদ্ধ জনতা ব্যাপক বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এতে জনগণ আরো বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। ঘটনাস্থলে বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ সময় উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ ও বিজিবি ব্রাশফায়ার শুরু করে। এতে ঘটনস্থলেই নিরঞ্জন (২০), রুবেল (১৮), দায়মুল (২১), সুমন (২০), ফিরোজ (১৯) নামে ৪ জন নিহত হন। মনির (১৮) নামে অপর একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে নিলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। সংঘর্ষের সময় মহিলাসহ আরো ২৫ জন গুলিবিদ্ধ হন, আহত হন আরো অর্ধশতাধিক। আহতদের অনেককেই ঠাকুরগাঁওসহ রংপুর ও দিনাজপুর মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে দুলাল ইসলামের (২০) অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের সার্জারি চিকিৎসক সুপেন্দ্রনাথ রায়। প্রায় ২ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ ও বিজিবি পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে এলাকার বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা নিহতদের লাশ ও আহতদের উদ্ধার করেন গ্রামবাসী। পুলিশের গুলিতে মহিলাসহ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বল জানা গেছে। হঠাৎ এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ায় এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিহতদের বাড়ি বাড়ি নেমে আসে কান্নার রোল।

সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ৮ মার্চ ২০১৩ জানাজার নামাজ নিয়ে একটি রিপোর্ট ছাপে যার শিরোনাম ছিল, ‘ঠাকুরগাঁওয়ে নিহতদের জানাজায় জনতার ঢল’।
ঠাকুরগাঁও : গড়েয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে শহীদদের জানাজায় মানুষের ঢল
মাওলানা সাঈদীকে ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে ঠাকুরগাঁওয়ে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে নিহতদের জানাজা নামাজে জনতার ঢল নামে। গত শুক্রবার বিকেলে নিহতদের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ এলাকায় পৌঁছলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিকেল ৫টায় গড়েয়া কেন্দ্রীয় ঈদগা ময়দানে এক এক করে নিহতদের লাশ জানাজার জন্য আনা হয়। কিন্তু জনতা বাড়তে থাকলে সেখানে জায়গার সঙ্কুলান না হওয়ায় পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় গড়েয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে। সেখানে হাজার হাজার মুসল্লির অংশগ্রহণে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

মা-বাবার দোয়া
তেরো বছরের সাঈদ রুবেল কেবল জোহরের নামাজ শেষ করেছেন। মা একান্ত আদরের একমাত্র ছেলেটির জন্য ভাত বাড়ছেন। বাইরে মিছিল আর শ্লোগানের ধ্বনি শোনা গেল। ‘আম্মা এসে দু’জনে একত্রে খাবো’ বলে ছুটে গেল ছেলেটি। বাবা দিনমজুর হিসেবে ভুট্টাক্ষেতে কাজ করছেন। তিনি এসেই গুরুটাকে গোছল দিয়েছেন। মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘বাবুটা ঐদিকে গেছে ডেকে নিয়ে এসো।’ কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। স্থানীয় গফুর ডাক্তারের কাছে নেয়া হয়েছিল। একটু পানি খাওয়ার চেষ্টা করেছিল, তারপর সবশেষ।
স্থানীয় মুরুব্বি আব্দুল মজিদ সাক্ষ্য দিলেন, ছেলেটির ভাষা খুবই মার্জিত ছিল। আর কেমন করে ওর ব্যবহার দ্বারা সবার মনে স্থান করে নিত। চাচা বলেন, ছেলেটি নিজেও নামাজে যেত আর সবাইকে ডাকাডাকি করতো। বাবার পেছন পেছন মাঠে কাজ করতো।

সপ্তম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র রুবেলের পড়ার টেবিলটা তার জন্মের আগেই বাবা কবিরাজ হাট থেকে কিনেছিলেন। ১৪ বছর পরে সে টেবিলের দু’টি পায়া ভেঙে গেছে। অনেক যতনে দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে তা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ঘরে আর কোন আসবাবপত্রের বাহুল্য না থাকায় মায়ের পানের বাটা-চুনের কৌটাটাও টেবিলের এক কোণে ঠাঁই পেয়েছে। হাঁড়ি-পাতিলের নিরাপদ আশ্রয় তার টেবিলের নিচেই। ছালার বস্তা দিয়ে চেয়ার বানিয়ে এই টেবিলের এক কোনায় পড়ালেখা করতেন সাঈদ রুবেল। অবশ্য টেবিলের সামনেই বাঁশের বেড়ায় আটকানো একটি ওয়ালমেট তার ঘরকে যেন আলোকিত করে রাখতো। তাতে লেখা ‘মা-বাবার দোয়া’। বাবা-মার করুণ কান্নার সুর যেন শেষ হয় না, ‘তোর জন্য আমরা কি দোয়া করেছিলাম রে বাপ?”

বর্তমান বাড়িঘরের অবস্থা
বাঁশের বেড়া ও টিনের চাল দিয়ে তৈরি দু’টি ছাপরাঘর। নিজেদের বসতবাড়ি নেই, অন্যের জমিতে ছাপরাঘর করে বসবাস করেন। পৈতৃকবাস এমনকি নিজেদের কোন কৃষিজমি নেই। পিতা দিনমজুরি করে (তালা-চাবি বানান) দিন আনে দিন খান।

ব্যক্তিগত প্রোফাইল
নাম : শহীদ মো: সাঈদ রুবেল

মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিলেন
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সমর্থক ছিলেন।
জন্মতারিখ ও বয়স : ৫ জানুয়ারি ২০০০

আহত হওয়ার তারিখ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ’১৩
শাহাদাতের তারিখ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ’১৩

স্থান : গড়েয়া নয়াবাজার। দাফন করা হয় কবরস্থানে

স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : চোঙ্গাখাতা, ডাকঘর : নয়া গড়েয়া, ইউনিয়ন : ১৩ নং গড়েয়া, উপজেলা : ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা : ঠাকুরগাঁও
পিতা : মো: রুহুল ইসলাম, বয়স : ৫০ বছর, পেশা দিনমজুর
মাতা : দেলোয়ারা বেগম, বয়স ৪০ বছর, গৃহিণী
ভাইবোনের বিবরণ : মোছা: নিলুফা ইয়াসমিন, বিবাহিতা, গৃহিণী, বয়স ২৪ বছর, মোছা: আক্তার বানু, বিবাহিতা, গৃহিণী, বয়স ২১ বছর, শহীদ মো: সাঈদ রুবেল

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মু. সাইদ রুবেল

পিতা

মো: রুহুল ইসলাম

মাতা

দেলোয়ারা বেগম

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ৫, ২০০০

ভাই বোন

২বোন ১ভাই সবাইর ছোট

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম : চোঙ্গাখাতা, ডাকঘর : নয়া গড়েয়া, ইউনিয়ন : ১৩ নং গড়েয়া, উপজেলা : ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা : ঠাকুরগাঁও

সাংগঠনিক মান

সমর্থক

সর্বশেষ পড়ালেখা

মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিলেন

শাহাদাতের স্থান

গড়েয়া নয়াবাজারে


শহীদ মু.সাইদ রুবেল

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মু.সাইদ রুবেল


শহীদ মু.সাইদ রুবেল

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মু.সাইদ রুবেল