শহীদ রফিকুল ইসলাম

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ০৮ জুন ২০০১ | ১১৪

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

প্রত্যেক মানুষকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, এ কথাটা অবশ্যম্ভাবী সত্য। তার হাত থেকে কেউই রেহাই পায়নি, পাবে না। কিন্তু কোনো কোনো মানুষ স্মৃতি-বিস্মৃতির রোমাঞ্চের মাঝে টিকে আছে এ পৃথিবীতে। শহীদ রফিক তেমনি একটি নাম। একটি স্মৃতি, একটি প্রাণ, একটি প্রতিভা, একটি নক্ষত্র, একটি আদর্শ, একটি মাসতুল, কিংবা একটি ফুটন্ত গোলা। যা বারবার দোলা দেয় অসংখ্য ব্যথাতুর হৃদয়কে। যার মনে আল্লাহর ভয় ছাড়া কোনো ভয় ছিল না, যে সংগঠনের কাজ ছাড়া অন্য কাজ বুঝতো না। সে জীবনে শাহাদাতের স্বপ্ন ছাড়া কোনো স্বপ্ন কল্পনা করতো না। যার সকালে ঘুম ভাঙতো ফজরের আযান ও সংগঠনের কাজ নিয়ে। আবার রাত কাটতো সংগঠনের অকুতোভয় আল্লাহর সৈনিক হিসেবে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সংগঠনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

শৈশব জীবন
শহীদ রফিক সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি থানার লাঙ্গলদাড়িয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পর থেকে শৈশব পর্যন্ত নিজ গ্রামে আব্বা-আম্মা, চাচা-চাচী, ভাই-বোনের আদর স্নেহে বড় হতে থাকেন। তারা তিন ভাই ছিলেন খলিল, মালেক, রফিক। রফিক ছিলেন অন্য দু’জনের চেয়ে একটু চঞ্চল ও আমোদপ্রিয়। ফলে সকলের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। বিশেষ করে ছোট বেলায় তাকে টুনু নামে ডাকত সবাই। আর সেই নামে আত্মীয় স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরাও চিনত। শৈশব থেকে তিন ভাই এক সাথে ঘুমানো, খাওয়া, গোসল, খেলাধুলা, স্কুলে যাওয়া এমন সব কিছুই এক সাথে করতেন। ছোট বেলা থেকে রফিক ছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদ কারী, ডানপিঠে ও বন্ধুপ্রিয়।

শিক্ষাজীবন
শহীদ রফিক শৈশবে কুরআন শিক্ষা লাভ করেন তার পিতান নিকট। আবক্ষা ও চাচারা পারিবারিকভাবে ধর্মভীরু থাকার ফলে প্রাইমারি স্কুলে না পাঠিয়ে শহীদ রফিককে বাল্যকাল থেকে গ্রামের পার্শ্ববর্তী গাজীপুর কুড়িগ্রাম ইসলামীয়া সিদ্দিকীয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। রফিক প্রথম শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত ভাল ছাত্র হিসেবে পড়ালেখা করতেন। সেই মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ তার গর্বিত পিতা মাওলানা মো. সাইদুর রহমনা। শৈশব থেকে যেখন তিনি কৈশোর জীবনে পদার্পণ করেন তখন তার সঙ্গী-সাথী ছিল অনেক, যাদেরকনে নিয়ে সবসময় খেলাধুলা, চলাফেরা করতেন। গ্রামের তার চাচাত ভাই ও ভাগ্নে মিলে ৬/৭ জনের একটি খেলার টিম ছিল। যে টিমের সদস্য ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সেক্রেটারি রবিউল বাশার। তিনি সম্পর্কে ছিলেন তার ভাগ্নে। তিনি ভাল লেখা পড়া করার জন্য ঐ মাদ্রাসা থেকে সাতক্ষীরা শহরের পাশে খানপুর দাখিল মাদ্রাসায় এসে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখান থেকে সুনামের সাথে ১৯৯০ সালে দাখিল পাশ করেন এবং অত্র প্রতিষ্ঠানের সকল ছাত্র-শিক্ষক এবং গ্রামের লোক জনের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠেন। এরপর আলিম পড়ার জন্য চলে আসেন যশোর জেলার শার্শা থানার বাগআঁচড়া ফাজিল মাদ্রাসায়। সেখানে একটানা চার বছর শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করে আলিম ও ফাজিল কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন।


তারপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৪ সালে ভর্তি পরীক্ষা দেন এবং দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তির সুুযোগ পান। ভর্তির সুযোগ পেয়েও তাকে সাংগঠনিকভাবে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি। তখন তার সাংগঠনিক মান ছিল যশোর শহরের খাজুরা শাখার সদস্য প্রার্থী। যার ফলে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। পারিবারিকভাবে চাচাত ভাই আবদুল্লাহ ও ভাগ্নে রবিউল বাশার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীস ও দাওয়াহ বিভাগের ছাত্র ছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে আবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান। ২০০০ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে অনার্স পাশ করেন। ২০০১ সালে ৮ জুন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনের সর্বোচ্চ ডিগি মাস্টার্স পরীক্ষার একটি মাত্র কোর্স বাকী থাকতে আল্লাহর জমিনে দ্বীন কায়েমের দৃঢ় শপথে বলিয়ান হয়ে শহীদ মালেকের বজ্রকণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মেলাতে মেলাতে শহীদী ঈদগাহে জমাযেত হলেন শিবিরের ১১৪ তম শহীদ মু. রফিকুল ইসলাম। ঐ দিন তিনি জীবনের সর্বোচ্চ ডিগি শহীদ উপাধি লাভ করেন এবং মহান আল্লাহ পাকের দরবারে চলে যান।

সাংগঠনিক জীবন
শহীদ রফিকের সাংগঠনিক জীবনের শুরু হয় ১৯৮৬ সালে যখন তিনি ৭ম শ্রেণীর ছাত্র। গ্রামের মাদ্রাসায় পড়ালেখা করার সময় পাশের গ্রামের নজরুল ইসলাম নামের এক ভাইয়ের মাধ্যমে দাওয়াত পান। এর পরে শহীদ রফিক বাগআঁচড়া মাদ্রাসার আলিম কাসের ছাত্র থাকার সময় ১৯৯২ সালে সাথী শপথ নেন। ১৯৯৪ সালে সংগঠনের সদস্য প্রার্থী হন এবং ১৯৯৮ সালে সংগঠনের সর্বোচ্চ স্তর সদস্য শপথে নিজেকে দৃঢ় করার যোগ্যতা অর্জন করেন। সদস্য হওয়ার পর তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একটি উপশাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে নতুন সাংগঠনিক বিন্যাসে তাকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুব ও ক্রীড়া সহসম্পাদক পদের দায়িত্ব দেয়া হয়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, ১০ হাজার শির্ক্ষার্থী ও ৩ শত কর্মকর্তা-কর্মচারী এক নামে চিনতেন শহীদ মু. রফিকুল ইসলামকে। তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, সদালাপী, মিষ্টভাষী, মিশুক, সংগঠনের প্রিয় ও পরোপকারী। ছোটদেরকে ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন বড়দের। এমন দূর থেকে সালাম দিতেন তিনি যা আজও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রোমন্তন করেন।

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
৭ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিকেল পাঁচটার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। সমস্যা সমাধানের প্রসেসিং করতে রাসেল ভাইয়ের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যান তিনি। সেখানে কামাল ভাইয়ের মেসে শিবির এবং জামায়াত নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। সিদ্ধান্ত হয় যে, বিকাল ৪ টায় সমঝোতা বৈঠকে ইবি সেক্রেটারি মোস্তাফিজ ভাই এবং রফিক ভাই যাবেন। এর পূর্বে রফিক ভাই সহ ৭/৮ জন ভাই জুমার নামায শেষে মন ডাঙার কামাল ভাইয়ের মেসে খাবার খেতে যান। ঠিক তখন জাসদ ছাত্রলীগের ক্যাডাররা আওয়ামী ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ মদদে মেসটি ঘিরে ফেলে। তাৎক্ষনিকভাবে মেস ছেড়ে দিয়ে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত হলে সবাই চলে গেলেও প্রিয় রফিক ভাই একটু পেছনে পড়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়া বিভাগের দায়িত্বশীল হিসেবে তিনি সবাইকে পাঠিয়ে নিজে পিছিয়ে যান। হায়েনার প্রিয় রফিক ভাইকে ধরে ফেলে এবং জিগা গাছের মোটাডাল দিয়ে মাথায় আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। হায়েনারা এতেও ক্ষান্ত না হয়ে লোহার হাতুড়ী দিয়ে প্রিয় রফিক ভাইয়ের মাথায় এতো জোরে আঘাত করে যে তার মাথার স্পাইরাল রগ ছিঁড়ে যায়। দ্রুত হায়েনারা পালিয়ে যায় কিন্তু ততক্ষণে প্রিয় ভাই শহীদ রফিক জান্নাতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসার পর কর্তব্যরত ডাক্তার-নার্সরা দ্রুত রক্ত দেয়ার পরামর্শ দেন। তার সাথীরা রক্ত দিলেন। ততক্ষণে ডাক্তার এসে রাসেল ভাইকে লক্ষ্য করে আস্তে আস্তে বললেন; ‘This patien is out of treatment’। ডাক্তাররা রফিক ভাইকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন। একটু পরেই সংবাদ এলো, আমাদের প্রিয় ভাই জান্নাতের বাসিন্দা হয়ে গেছেন।

একনজরে শহীদ মু. রফিকুল ইসলাম
নাম : মু. রফিকুল ইসলাম
পিতার নাম : মাওলানা সাইদুর রহমান
সাংগঠনিক মান : সদস্য
সর্বশেষ পড়াশোনা : দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ (মাস্টার্স পরীক্ষার্থী)
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
আহত হওয়ার স্থান : ঝিনাইদহের মদন ডাঙার একটি সাংগঠনিক মেস
শহীদ হওয়ার স্থান : ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল
আঘাতের ধরন : লাঠি, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, হাতুড়ী
যাদের আঘাতে শহীদ : আওয়ামী ছাত্রলীগের মদদপুষ্ট জাসদ ছাত্রলীগ
শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৮.০৬.২০০১ ইং
যে শাখার শহীদ : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
পিতা : জীবিত,
পেশা- ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম ইসলামিয়া সিদ্দিকীয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, গাজীপুর, সাতক্ষীরা।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ রফিকুল ইসলাম

পিতা

মাওলানা সাইদুর রহমান

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

স্থায়ী ঠিকানা

সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি থানার লাঙ্গলদাড়িয়া গ্রাম

সাংগঠনিক মান

সদস্য

সর্বশেষ পড়ালেখা

দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ (মাস্টার্স পরীক্ষার্থী), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল


শহীদ রফিকুল ইসলাম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ রফিকুল ইসলাম


শহীদ রফিকুল ইসলাম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ রফিকুল ইসলাম