শহীদ মাহমুদুল হাসান

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৯ | ১০৭

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৯। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়, রক্তাক্ত একটি স্ম"তি। এদিন পবিত্র রমজান মাস হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্বাভাবিকভাবে হলে অবস্থান করে, যার যার পড়ালেখা ও ইবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত ছিল। ঠিক সে মুহূর্তে আওয়ামীলীগের সোনার ছেলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সোহরাওয়ার্দী হল দখলের পরিকল্পনা করে। এরই অংশ হিসেবে তৎকালীন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি কলিমের নেতৃত্বে বাহার, মেজবাহ, রায়হান, তানভীরসহ চিহ্নিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা একে-৪৭, এস.এম.জি কাটা রাইফেলসহ মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল আক্রমণ করে। সেদিন শত শত পুলিশের উপস্থিতিতে তারা ফিল্মি কায়দায় ব্রাশ ফায়ার করতে করতে সোহরাওয়ার্দী হলে প্রবেশ করার চেষ্টা করে।

ছাত্রলীগের এ অভিযানে সংবাদ পেয়ে তখন আলাওল ও এ.এফ রহমান হলে অবস্থানরত ছাত্রশিবির নেতাকর্মীলা ‘নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার’ শ্লোগান দিতে দিতে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। আল্লাহর অকুতোভয় সৈনিকরা যখন সম্পূর্ণ আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ইসলামী আন্দোলনের এ ঘাঁটিকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন ঠিক তখন শয়তানের প্রেতাত্মা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিবিরের মিছিল লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষণ করতে থাকে। সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে লুটিয়ে পড়েন ইসলামী আন্দোলনের দুই মর্দে মুজাহিদ। সেদিন ঘটনাস্থলেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মেধাবী ছাত্র ফতেপুর শাখার সেক্রেটারি রহিম উদ্দীন ও ফাইন্যান্স বিভাগের মেধাবী ছাত্র মাহমুদুল হাসান। পায়ে বুলেট বিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন শিবির নেতা আবদুস শাকুর।

সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা
সেদিন চরদখলের মত ক্যাম্পাস দখলের নেশায় আবু জেহেল- আবু লাহাবের উত্তরসূরিরা ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে দুই শিবির নেতাকে। মিষ্টভাষী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল শহীদ রহিম উদ্দীন ছিলেন শান্তশিষ্ট। তিনি ইসলামী আন্দোলনের এক অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন। তার ভয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আতঙ্কে থাকতো। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিবিরের মিছিলে একে-৪৭ এবং এস.এম.জির ব্রাশ ফায়ার করে শিবিরকে নিশ্চিহ্ন করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের সন্ত্রাসের আখড়া বানাতে চেয়েছিল। তখন ইসলামের খাদেম এ দুই তরুণ নিজেদের বুক পেতে দিয়ে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করেছিল। কিন্তু আওয়ামী প্রশাসনের নির্লজ্জ হাত সেদিনও অতীতের ধারাবাহিকতায় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তারা ক্যাম্পাসবাসীকে এবং দুই শহীদের সাথীদেরকে ক্যাম্পাসে শহীদের জানাযা পর্যন্ত পড়তে দেয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের আহাজারির প্রতি কর্ণপাত করেননি কর্তৃপক্ষ।


মেধাবী ছাত্র শহীদ রহিম উদ্দীন এবং মাহমুদুল হাসান দক্ষিণাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠে এসেছিলেন সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করতে। তারা চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী অর্জন করে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করবেন। কিন্তু হায়েনাদের নির্মম ব্রাশ ফায়ার তাদের সে স্বপ্নকে ধুলিস্মাৎ করে দেয়। সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে পড়ে থাকা নিস্তব্ধ রহিম, নিথর হাসানের নির্বাক দৃষ্টিতে একটিই প্রশ্ন ছিল, কী অপরাধ আমাদের? আমরা কি সন্ত্রাসী? চোর-ডাকাত? কেন তোমরা আমাদের হত্যা করলে? আমাদেরও তো স্বপ্ন ছিল সবার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়ে মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার । জবাব চাই আওয়ামী সরকার ও প্রশাসন। আজকে রহিম, হাসান, জোবায়েরের সাথীদেরও জিজ্ঞাসা, ‘কী ছিল তাদের অপরাধ? কেন আওয়ামী দুর্বৃত্তরা বিনা দ্বিধায় পাখির মত গুলি করে তাঁদেরকে হত্যা করল?’

শহীদ মাহমুদুল হাসানের মায়ের অনুভূতি
মাহমুদ ছোটবেলা থেকে চটপটে ছিল। সবাই তাকে অনেক আদর করতো। পাড়া প্রতিবেশিদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল খুব গভীর। সে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি আসতো, আশে পাশের সবার সাথে দেখা করতো। যতদূর মনে পড়ে মাহমুদ শাহাদাতের আগে টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছিল। চিঠি পাওয়ার পর আমরা তার জন্য কিছু টাকা পাঠাই। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ভাল ছিল না। তার শাহাদাতের কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে একবার খুব আহত হয়েছিল। একটু সুস্থ হওয়ার পর বাড়িতে আসলে ছেলের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ি। ওরা আমর ছেলেকে রড দিয়ে পিঠে ও গায়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করে ফেলে। আমি তখন তাকে বলেছিলাম বাবা তুই কিছু দিনের জন্য বাড়ি আয়। তখন সে বলল রমজান মাসের ১০ তারিখে আসবে। আমি তাকে বললাম সাবধানে থাকিস। সে বলল মা শহীদের মৃত্যু সবচেয়ে মর্যাদার মৃত্যু, এই মৃত্যু কয়জনের ভাগ্যে জোটে। তুমি দোয়া করো যেন আল্লাহর পথে বীরের বেশে শহীদ হতে পারি। তার কথাগুলো শুনে আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আর ভাবলাম সত্যি সত্যিই কি সে শহীদ হয়ে যাবে? আমার বাবা ১০ তারিখে বাড়িতে এসেছে, তবে জীবিত নয় শহীদ হয়ে। আমার ছেলের কী অপরাধ? কেন তারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে? সেতো কখনো কারো সাথে খারাপ আচরণ করেনি। শুধু ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই তারা আমার মাহমুদকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে।

তার শাহাদাতের পরে তার বাবার কণ্ঠ বন্ধ হয়ে যায় এবং ৬ মাস পরে তিনি মারা যান। আমার কোনো দুঃখ নেই। আল্লাহ আমাকে মাহমুদকে দিয়েছেন আবার তাকে শহীদী মর্যাদা দিয়ে নিয়ে গেছেন এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রেরণা। আমি শহীদের একজন গর্বিত মা। দোয়া করি আল্লাহ যেন আমার ছেলের সাথীদেরকে হেফাজত করেন। আমীন !

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিমত
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের চেয়াম্যান প্রফেসর হারুনুর রশীদ শহীদ মাহমুদুল হাসানের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন; শুরু থেকে চটপটে হওয়ার কারণে কাসে অন্য কারও চেয়ে কয়েকজন ছাত্রের সাথে একটু বেশি বোঝাপড়া হয়। তাদের সাথে মাহমুদ তার স্বভাবসুলভ চঞ্চলতার পাশাপাশি ভাল ছাত্র হওয়ায় শুধু আমার কাছে নয়- পরে জানতে পারি অন্যান্য শিক্ষক ও বন্ধুদের কাছে খুবই প্রিয়। প্রথম বর্ষ থেকে একটু স্নেহ পাওয়ায় সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সকল দায়িত্ব নিজে করার কারণে ছাত্র শিক্ষক সকলের তার প্রতি আলাদা দুর্বলতা ছিল। দীর্ঘ চার বছরে হেসে খেলে সবার হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া মাহমুদ এভাবে হঠাৎ চলে যাবে ভাবতে কষ্ট হয়। মুক্তিযোদ্ধা ছিলা বলে নিজের প্রতি এতটা প্রচণ্ড ক্ষোভ জন্মাল, একটি দেশে এভাবে প্রকাশ্যে দুজন ছাত্রকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করল অথচ কোন প্রতিকার নেই, বিচার নেই। এমনকি যে ক্যাম্পাসে দীর্ঘ সময় এ ছেলেটি, সেই ক্যাম্পাসবাসীকে জানাযা পর্যন্ত পড়তে দেয়া হল না। আজও খুব কষ্ট পাই আমার প্রিয় ছাত্রটির জানাযা পড়তে পারিনি বলে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, চোখের সামনে যেন আর কোনো শিক্ষককে ছাত্রের লাশ দেখতে না হয়। এবং যারা এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তদন্তপূর্বক তাদের বিচারের মুখামুখি করতে প্রশাসন ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

এক নজরে শহীদ মু. মাহমুদুল হাসান
নাম : মু. মাহমুদুল হাসান
পিতা : মু. আবদুজ জাহের
ঠিকানা : চরমনসা, ভবানীগঞ্জ, সদর, লক্ষীপুর।
শিক্ষাগত যোগ্যতা : অনার্স চতুর্থ বর্ষ (ফিন্যান্স)
সর্বশেষ শিাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাংগঠনিক মান : সাথী
ঘটনার স্থান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শহীদ হওয়ার স্থান : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে।
আঘাতের ধরণ : মাথায় গুলি
শাহাদাতের তারিখ : ১৯.১২.১৯৯৯ ইং, রোজ রবিবার
যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
যাদের আঘাতে শহীদ : মুজিববাদী ছাত্রলীগের ব্রাশ ফায়ারে
ভাইবোন : ৩ ভাই, ৩ বোন
ভাইদের মাঝে অবস্থান : ২য়
পরিবারের মোট সদস্য : ৮ জন
পিতা : মৃত
মাতা : জীবিত।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মাহমুদুল হাসান

পিতা

মু. আবদুজ জাহের

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৩ ভাই, ৩ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

চরমনসা, ভবানীগঞ্জ, সদর, লক্ষীপুর।

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

অনার্স চতুর্থ বর্ষ (ফিন্যান্স), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে


শহীদ মাহমুদুল হাসান

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মাহমুদুল হাসান


শহীদ মাহমুদুল হাসান

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মাহমুদুল হাসান