শহীদ মহিবুল করিম সিদ্দিকী

২৫ নভেম্বর ১৯৭২ - ২৫ মে ১৯৯৯ | ১০১

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

‘ময়দানে মোকাবেলায় ভীত হয়ে দুর্গের মধ্যে আত্মগোপন করা কাপুরুষতার সুস্পষ্ট নিদর্শন। আল্লাহ এ জমিনকে কাপুরুষদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি করেননি।’ -মোহতারাম মাওলানা মওদূদীর এ বক্তব্যকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়ে যে মুজাহিদ বাতিলের বিরুদ্ধে অকুতোভয় লড়াই করে শহীদ হয়েছেন তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের ১০১ তম শহীদ মুহিবুল করিম সিদ্দিকী। চট্টগ্রামের জনপদে মজলুমের আর্ত-চিৎকার যখন আকাশে বাতাস ভারী করে তুলছিলো, মহল্লাতে আওয়ামী-ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে জনজীবন যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলো, ঠিক তখন তীব্র গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন শহীদ মুহিবুল করিম। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও সাহসী উদ্যোগের ফলে বিশেষ বিশেষ কয়েকটি এলাকাতে আওয়ামী সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

যেখানেই কোন অন্যায় সংঘটিত হত, সেখানেই তাঁর প্রতিরোধের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত। দলমত নির্বিশেষে বিপদে যেই পড়েছে, তার জন্যে প্রাণও দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে দীর্ঘ ৪/৫ ঘন্টা অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে ছাত্র-জনতার উদ্ধার অভিযানে শহীদ মহিবুলের নেতৃত্ব ছিলো অগ্রগণ্য। তার জীবনে এ জাতীয় ঘটনা অনেকবার ঘটেছে যা সত্যিই অকল্পনীয়।

সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা
শহীদ মুহিবুল করিম সিদ্দিকীর পিতা আলহাজ্ব আনোয়ারুল কাদের সিদ্দিকী, মাতা শাহানারা কাদের সিদ্দিকী। শহীদ মুহিবুল হাটহাজারী থানার অন্তর্গত এনায়েতপুর গ্রামের একমাত্র আদর্শবাদী ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তান। এ এলাকার মির্জাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনে প্রবেশ। শৈশব থেকে বক্তৃতা-বিতর্ক প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। ৭ম শ্রেণীতে থাকতেই বাবরী মসজিদ ইস্যু নিয়ে স্কুলের নির্ধারিত বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। এ বালকের বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্যে সবাই হতবাক হয়েছিলেন। মির্জাপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করে চট্টগ্রাম ক্যান্টম্যান্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাশ করে চট্টগ্রামের ফয়েজলেকে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে ফার্মেসী বিভাগে ভর্তি হন। অধ্যয়নরত শেষ বর্ষে থাকাকালে শাহাদাত বরণ করেন মুহিবুল। ৭ম শ্রেণীতে শিবিরের কর্মী হয়ে পরবর্তী সময়ে সাথী শপথ নেন মুহিবুল। পরিবারের সবাই ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। বাবা আলহাজ্ব আনোয়ারুল কাদের সিদ্দিকী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার। কুয়েতে তিনি জামায়াতের রুকন শপথ নেন। মা জামায়াতের মহিলা উত্তর জেলার রুকন এবং জেলা জামায়াতের মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি। বড় ভাই একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে আমিরকায় কর্মরত। আমেরিকার ইসলামী সংগঠনের সদস্য। বড় বোন গণিতে সম্মান পাস। ছাত্রী সংস্থার সদসপ্রার্থী ছিলেন, বর্তমানে মহিলা জামায়াতের রুকন। মেঝবোন অর্থনীতিতে মাস্টার্স।


শহীদ মুহিবুল বরাবরই একজন জনপ্রিয় ছাত্র ছিলেন। বাবা মা অতি আদর করে ডাকতেন ‘খুকুমণি’। তাই তার সহপাঠী ও বন্ধুদের কাছে তাদের প্রিয় ‘খুকুভাই’ হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের কাছে অতি সুপরিচিত ও প্রিয় ছিলেন বলে তিনি ইউএসটিসিতে ছাত্র সংসদের এজিএস নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন। অমায়িক ব্যবহার ও অত্যুজ্জ্বল সাংগঠনিক যোগ্যতার অধিকারি ‘খুকুমণি’ তার সংস্পর্শে যে একবার এসেছে সে তার ভক্ত না হয়ে পারেনি। এ জন্যে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, ডাকাতরা তাদের অন্যায় কাজের প্রধান বাধা মনে করে তাকে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে যাওয়ার পথে কয়েকবার হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও খুনিরা খুনের নেশায় সব সময় তার পিছনেই লেগেছিল। সহজেই ঘায়েল করতে পারবে না বলে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছিল। অবশেষে জালেমদের পরিকল্পনাই সফল হলো, ২৫ মে ’৯৯ রাত ১০.৪৫ টায়। প্রকৃতির সাথে মানুষগুলোও নীড়ে ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। চারদিকে অমানিশার নিস্তব্ধতা-এমন রাতে গাছের ডালপালা ভাঙাও ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। কিন্তু মনুষ্যত্বহীন নরাধমগুলো লোক সমাজ বোঝে না, প্রকৃতির নিয়ম বোঝেনা, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে অক্ষম। শহীদ মুহিবুল করিম খালাত বোনের বাসায় তখণ। সন্ত্রাসীরা কাপুরুষের মত বন্ধু পরিচয় দিয়ে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে ব্রাশ ফায়ার করে। সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পথেই তিনি আকাঙ্খিত শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন, জান্নাতের উদ্দেশ্যে ত্যাগ করেন এ সাজানো জগত। শহীদের লাশ হাসপাতালের ইমার্জেন্সী বিভাগে নেয়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎবেগে এ খবর সারা শহরময় ছড়িয়ে পড়ে। সকাল না হতেই ছাত্র-জনতার ভীড় সৃষ্টি হয়ে যায়। শহীদের লাশ দেখে সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।


বিকাল ২টায় শহীদের প্রথম জানাযা ঘোষণা করা হয় ঐতিহাসিক প্যারেড ময়দানে। হাজারো ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে জানাযায় ইমামতি করেন বর্ষিয়ান জননেতা মাওলানা শামছুল ইসলাম। জানাযা শেষে শহীদের কফিন কালেমা শাহাদাত পড়তে পড়তে বিশাল মিছিল সহকারে শহীদের অনতিদূরের নিজ বাড়িতে রওয়ানা হয়। কফিন শহীদের স্মৃতি বিজড়িত মির্জাপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিকাল ৪টায় যখন পৌঁছে তখন সেখানে অপেক্ষমাণ হাজারো জনতা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ৫.৩০ টায় দ্বিতীয় জানাযার পূর্বে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শহীদের পিতা বলেন, শাহাদাত প্রত্যেক মুমিনের জন্য কাম্য হওয়া উচিত। আমার সৌভাগ্যের বিষয়। আমার প্রিয়তম সন্তানকে শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন আল্লাহ। এ জন্যে আমি গর্বিত। কফিন শহীদের বাড়িতে রাখা হলে অসংখ্য মহিলা-পুরষ শহীদের চেহারা মোবারক এক নজর দেখার জন্য ভীড় জমান। শহীদের মায়ের, বোনের ও স্বজনদের বুকফাটা কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। শহীদের আম্মা বারবার মূর্ছা যেতে থাকেন। কারো অশ্রু বাঁধ মানছিল না যেন। এ দৃশ্য সবাইকে নির্বাক করে দেয়। সকলের মমতা, ভালবাসা, আবেগ আর চোখের পানিকে পিছনে রেখে চিরন্দ্রিায় যখন প্রিয় মুহিবুলকে শায়িত করা হচ্ছিল, সূর্য তখন পৃথিবীকের বিদায় জানাচ্ছিল। বড় বেদনাবিধূর সেই বিদায়!

‘মাগো! তোমার দু’ছেলে। বড় সন্তান আমেরিকায়। পরিবারের দেখাশুনা ও টাকা রোজগারের জন্য সেই যথেষ্ট। আমাকে আল্লাহর দ্বীনের জন্য ছেড়ে দাও। বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতেই যেন আমি আমার প্রভুর দরবারে হাজির হতে পারি। আম্মা! আমার জন্য দোয়া করো; আল্লাহ যেন আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন। এ কথাগুলো শহীদ মুহিবুল করিম শাহাদাতের কয়েকদিন পূর্বে তার প্রাণপ্রিয় আম্মাজানকে আবেগ ভরা কণ্ঠে বলেছিলেন। শাহাদাতের প্রতি তার কী যে আবেগ ও আকাড়া ছিল এ কথাগুলো থেকেই তা ফুটে উঠেছে। তিনি তাঁর আম্মাকে প্রায় বলতেন, তসবীর নিচে বেহেশত নয়, তরবারির নিচে বেহেশত। সন্ত্রাসের জনপদ থেকে তাকে যখন বিদেশে চলে যাবার জন্য বলা হলো, তখন তিনি বলেছিলেন- দ্বীনের কটিন জিম্মাদারী ফেলে বিদেশে আরাম আয়েশের জিন্দেগী বরণ করতে পারি না। সত্যিই স্বমহিমায় ভাস্বর ছিলেন সকলের প্রিয় ‘খুকুমণি’। ইউএসটিসি’র শিক্ষক জনাব মহিউদ্দিন সাহেব বললেন; ‘এরকম ছাত্র এর পূর্বে আমি পাইনি। চলে গেছে মুহিবুল কিন্তু আজও তার অসমাপ্ত কাজ শেষ হয়নি। থামেনি বাতিলের চক্রান্ত। বাস্তবায়িত হয়নি তার স্বপ্ন। বাংলাদেশের সবুজ জমিনে তার স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়ন হবেই ইনশাআল্লাহ!

এক নজরে শহীদ মুহিবুল করিম সিদ্দিকী
নাম : মু. মুহিবুল করিম সিদ্দিকী (খুকুমণি)
পিতা : আলহাজ্ব আনোয়ারুল কাদের সিদ্দিকী 
মাতা : শাহানারা কাদের সিদ্দিকী
স্থায়ী ঠিকানা : এনায়েতপুর, সরকার হাট, হাটাহাজারী, চট্টগ্রাম
ভাই বোন : ২ ভাই ৩ বোন (তিনি ৪র্থ)
জন্ম তারিখ : ২৫ নভেম্বর ১৯৭২ ইং
জীবনের লক্ষ্য : ডাক্তার হওয়া
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি অব চিটাগাং এর ফার্মেসি বিভাগের শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত
সাংগঠনিক মান : সাথী
যাদের আঘাতে শহীদ : ঘাতক ছাত্রলীগ
আঘাতের ধরন : ব্রাশ ফায়ার
যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম মহানগরী
আহত হওয়ার তারিখ : ২৫ মে ১৯৯৯ ইং
স্থান : চট্টগ্রাম শহরের মদুনাঘাট, তার খালাতো বোনের বাসায়

শাহাদাতে শহীদের পিতার প্রতিক্রিয়া
‘আমাদের ছেলের দুনিয়াবী রক্তের বদলা নেয়ার দরকার নেই, বরং আমাদের ছেলের রক্তের বিনিময়ের ফল হিসেবে ইসলামী আন্দোলন প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা দেখে যেতে চাই!’

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মহিবুল করিম সিদ্দিকী

পিতা

আলহাজ্ব আনোয়ারুল কাদের সিদ্দিকী

মাতা

শাহানারা কাদের সিদ্দিকী

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ২৫, ১৯৭২

ভাই বোন

২ ভাই ৩ বোন (তিনি ৪র্থ)

স্থায়ী ঠিকানা

এনায়েতপুর, সরকার হাট, হাটাহাজারী, চট্টগ্রাম

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি অব চিটাগাং এর ফার্মেসি বিভাগের শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত

শাহাদাতের স্থান

চট্টগ্রাম শহরের মদুনাঘাট, তার খালাতো বোনের বাসায়


শহীদ মহিবুল করিম সিদ্দিকী

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মহিবুল করিম সিদ্দিকী


শহীদ মহিবুল করিম সিদ্দিকী

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মহিবুল করিম সিদ্দিকী