শহীদ যোবায়ের হোসাইন

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ১৫ মে ১৯৯৯ | ১০০

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

তাকে দেখিনি কোনো দিন তবু তিনি আমার আপন। তার ভালবাসা পাওয়ার সুযোগ হয়নি কোনোদিন তবু তিনি আমার ভালবসার অবলম্বন। তার সাথে কানো কাটেনি কোন প্রহর তারপরও তিনি আমার স্মৃতির মনিকোঠায় সদা বিদ্যমান। একত্রে দ্বীনের কাজ করিনি কোনো দিন তবুও তিনি আমার উৎসাহদানকারী। শহীদি মিছিলে তার সাথে শ্লোগান দিই নি কোনো দিন তবুও তিন আমার অনুপ্রেরণা। আমি শিবিরের শত শহীদ জোবায়ের ভাইয়ের কথা বলছি। যার শাহাদাতের সংবাদ শুনে ব্যাকুল হয়েছিল আমার হৃদয়, থেমেছিল ভাষা চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল দু’ফোঁটা অশ্রু।

সেদিন যা ঘটেছিল
১৫ মে ১৯৯৯ সাল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ছোট্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা দুপুরে নীরবতা ভেঙে আক্রমণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বিশ্রামরত শিবিরের কর্মীদের উপর। আক্রমণের পরও তাদের পশুত্ব বিবৃত হয়নি তারা খুঁজতে থাকে নেতবৃন্দদের। আর সেই সময ক্লাস থেকে হলে একা একা ফিরছিল শিবিরের বিশ্বববিদ্যালয় শাখার অফিস সম্পাদক জোবায়ের ভাই। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত ব্যাংকের কাছ থেকে তুলে নিয়ে যায় প্রিয় ভাই জোবায়েরকে। এই অপহরণ করার ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরকে জানানো হলেও তারা প্রশাসনের চেয়ারে বসে ছাত্রলীগের কর্মীর ভূমিকা পালন করে। শহীদের সাথীরা সারা ক্যাম্পাস খুঁজেও পেল না জোবায়েরকে। অতঃপর মাগরিবের আজান, আর ফরেস্ট্রি বিভাগের পেছনে একটি গুলি শব্দ। কিছুক্ষণ পর সংবাদ এল, শহীদের তালিকায় লেখা হল আরেকটি নাম। জেবায়ের হোসেন।

ছোট থাকব না মোরা চিরদিন, বড় হব নিশ্চয় একদিন
বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল শহীদ জোবায়ের ভাইয়ের। আর সেই স্বপ্নের ভিত গড়ে দিলেন জোবায়ের ভাইয়ের মা। তিনি তার আদরের সন্তানকে বলতেন তোমরা একটা করে বই পড়বে আর তার বিনিময়ে আমি তোমাদের দশটি করে টাকা দেব। মায়ের উদ্দেশ্য ছিল সন্তানেরা টাকার আশায় বেশি করে বই পড়বে আর তার ফলে তা জ্ঞানের রাজ্যে বিকশিত হবে। সত্যিই জ্ঞানী হয়েছিল শহীদ জোবায়ের। তার শিক্ষা জীবনের দিকে তাকালেই তার সত্যতা পাওয়া যায়। নিজে গ্রাম চৌবাড়িয়া চকদই প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে সব শ্রেণীতে প্রথম হন তিনি। প্রাইমারি ও অষ্টম শ্রেনীতে বৃত্তিলাভ এবং স্কুল শিক্ষক মহোদয়গণ তার চরিত্র, সত্যবাদিতা, ন্যায়নীতি ন্যায়পরায়ণতা ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে তাকে একটি রৌপ্য পদক দিয়ে ভূষিত করো। এসএসসি এবং এইচএসসিতে লেটার মার্কসহ ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল। শুধু তাই নয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন।

তাকওয়া
শহীদ জোবায়ের শিশুকাল থেকেই ছিল সহজ সরল। আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ছিল অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভালবাসা। জোবায়ের ভাইয়ের বাবার কাছ থেকেই শুনি সে কথা ‘শৈশবকাল থেকেই একটা সুন্দর অভ্যাস ছিল তার। আমাকে নামাজ পড়তে দেখলে আমার ডান পাশে দাঁড়িয়ে যেত। আমি একদিন বারান্দায় চৌকির উপর নামাজ পড়ছি এমন সময় জোবায়ের আমার ডান পাশে দাঁড়াল। আমি যেই জমিনে সিজদায় গিয়েছি, জোবায়েরও আমার সাথে সিজদা দিল কিন্তু ওর কপালটা চৌকির উপর না ঠেকার কারণে ধাপস করে পড়ে মাঠিতে পড়ে গেল। আমি নামাজ ছেড়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। কিছুক্ষণ পর জোবায়ের বলল বাবা! নামাজ শেষ হয়েছে? না, বলে আমি আবার নামাজে দাঁড়ালাম জোবায়েরও আমার সাথে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে বলল বাবা জোবায়ের ব্যথা পেয়েছে? জোবায়ের হাসি দিল বলল নামাজ পড়তে কি মানুষ ব্যাথা পায়।

রমজানের চাঁদ উঠেছে পশ্চিম আকাশে। রমজানের চাঁদ দেখেই যেন ঈদের আনন্দ পাচ্ছে শিশুরা আমার জোবায়ের দৌড়ে আসল তার মায়ের কাছে। বয়স তখন ৪ বছর। বলল মা আমি রোজা রাখব। ওর মা কোনো উত্তর দিল না। আমরা সেহরি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ জোবায়ের উঠে বলল মা তোমরা ভাত খেয়েছ? আমি বললাম হ্যাঁ, খেয়েছি। জোবায়ের মন খারাপ করে শুয়ে পড়ল। সকালে তার মা তাকে খাবার দিলে সে খেল না। ওর মা খাওয়ানো জন্য ওকে ছয়বার গোসল করালো। তবুও জোবায়ের খেল না রোজাও ভাঙলো না।

আমার জোবায়ের কখনো টেলিভিশন দেখতো না। তবে সাংবাদ শুনতো। আর ঘরে ভেতর সবাই টেলিভিশনে সংবাদ শুনতাম। আর আমার জোবায়ের ঘরের কাঠখড়ির বেড়ায় পাশে দাঁড়িয়ে খবর শুনতো। আমি বলতাম জোবায়ের তুমি সংবাদ দেখনা কেন? সে বলতে বাবা যে ময়েটি সংবাদ পড়ে তাকে দেখলে আমার চোখের পর্দা নষ্ট হতে পারে। এই হল আমার জোবায়ের, আমার গর্ব, আমার অহঙ্কার, আমার বিশ্বাস আমার ভালবাসা।

শাহাদাতের তামান্না
মরতেই হবে যখন শহীদি মরণ দিও আমকে এই গানটি জোবায়ের ভাই কখনো গেয়েছিল কিনা আমি জানি না তবে শুনেছিল অবশ্যই। এই গান যেমন প্রেরণা দেয় শাহাদাতের তেমনি রাসূলের হাদিসও প্রেরণা দেয় আমাদের । হয়তো শহীদ জোবায়ের এই হাদীসটি জানতো ‘রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহ নিকট শহীদের জন্য ছয়টি পুরস্কার রয়েছে সেগুলি হল : ১। প্রথম রক্ত বিন্দু ঝরতেই তাকে মাফ করা।

একদিন ফজরের নামাজের ইমামতি করছেন ছেলে জোবায়ের আর মুক্তাদি হিসেবে আছেন পিতা মাস্টার রহমতুল্লাহ। নামাজ শেষে মোনাজাতরত অবস্থায় কাতরকণ্ঠে জোবায়ের ভাই বলছেন হে আল্লাহ! আমাকে তুমি শাহাদাতের মৃত্যু দিও। মুক্তাদি হিসেবে কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই বৃদ্ধ পিতা বললেন আমিন। পিতার আমিন বলার চল্লিশ দিন পর ছেলে শহীদি কফিন উপহার হিসেবে পেয়ে ছিলেন বৃদ্ধ পিতা।


জোবায়ের ভাইয়ের আব্বা বলেন যে দিন জোবায়ের বাড়ি হতে শেষবারের মতো যায় তখন আমি বলেছিলাম, জোবায়ের! বাংলাদেশের দূর-দুরান্তর হতে শিবিরের ছেলেরা এসে লেখাপড়া করে, অনেক সময় ছাত্রলীগের শয়তানের তোমাদের মেরে ফেলে। সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত ছেলের পিতা-মাতা কিভাবে খবর পায়। সে বলল বাবা আল্লাহ পাকের রহমতে শিবিরে ভাইয়েরা সমস্ত ব্যবস্থা করে থাকেন। এ পর্যন্ত ৯৯ জন দ্বীনি ভাই শহীদ হয়েছেন। ওর কথা শেষ না হতেই আমি বললাম তুমি কি একশজন পূরণ করতে চাও? এই কথা বলার সাথে সাথে আমার অন্তর কেঁপে উঠল, আমি জোবায়েরের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম ও মিষ্টি সুরে বলল আল্লাহ পাক দয়া করে কবুল করলে।

সংগঠনের প্রতি শহীদ পরিবারের চাওয়া
শত শত শহীদের মা বলেছেন জোবায়ের আমার ত্রিশ বছরের সাধনায় সৎ, সাহসী, উদ্যমী, পরোপকারী, ও ভালবাসার হৃদয়ের অধিকারী একজন প্রকৃত মানুষ হয়েছিল। আজ ৩৪ বছরের টগবগে যুবকের নাম হচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির। এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কি পেরেছে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেরেদকে গড়ে তুলতে? যদি না পারে তবে আমাদের চাওয়া অনেক বাকি। গত ১৪.০৪.২০১১ টাঙ্গাইল শহর শাখার সেক্রেটারি রাসেল আহমেদ ভাইকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম শহীদ জোবায়ের ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে ও পরিবারে লোকজনের সাথে সাক্ষাৎ করতে। শহীদ জোবায়ের ভাইয়ের শ্রদ্ধেয় পিতা মাতাকে যদিও আমরা পাইনি কিন্তু পেয়েছিলাম তার বড় ভাই জাকির হোসেনকে। তিনি জানালেন ৯০ বছর বয়সের বৃদ্ধ পিতা এখনো বুকভরা আশা নিয়ে বেঁচে আছেন। দ্বীনে বিজয় দেখতো, এখনো দু’চোখের অশ্রু বিসর্জনে দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে সংগঠনের জন্য। শহীদ জোবায়েরের মতো লক্ষ লক্ষ সন্তানের প্রতি তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধ মা কখন তারা এই বাংলার সবুজ জমিনে নারায়ে তাকবীর শ্লোগান দিবে। তার জিজ্ঞাসা আর কত রক্ত দিয়ে এদেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হত্যার রাজনীতি বন্ধ হবে, মা হারানো তার সন্তানকে, ভাই তার বোনকে, সেদিন কবে আসবে? নাকি এই স্বপ্ন দেখে দেখেই শহীদ জোবায়ের ভাইয়ের পিতামাতাও ঘুমিয়ে যাবেন চৌবাড়িরয়ার কবরস্থানে যেখানে ঘুমিয়ে আছে শিবিরের শতশত শহীদ জোবায়ের হোসেন।

একনজরে শহীদ জোবায়ের হোসেন হোসেন
নাম : মো. জোবায়ের হোসেন
পিতার নাম : মাস্টার রহমতুল্লাহ
মাতার নাম : মোসাম্মাৎ জরিনা খাতুন।
সাংগঠনিক মান : সদস্য।
দায়িত্ব : বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অফিস সম্পাদক
সর্বশেষ লেখাপড়া : এমএসএস (শেষ বর্ষ), অর্থনীতি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব : ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি, এসএসসি ৩ বিষয়ে লেটারসহ ১ম বিভাগ, এইচএসসি ১ম বিভাগ।
জীবনের লক্ষ্য ছিল : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়া
আহত হওয়ার স্থান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের পিছনে
শহীদ হওয়ার স্থান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের পিছনে
আঘাতের ধরন : গুলি
যাদের আঘাতে শহীদ : মুজিববাদী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী
শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৫.০৫.১৯৯৯
পিতা : জীবিত (প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক)
মাতা : জীবিত (গৃহিনী)
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম+ পোস্ট- চৌবাড়িয়া, থানা- টাঙ্গাইল সদর, টাঙ্গাইল।
ভাইবোন : ৪ ভাই ৩ বোন (সর্বকনিষ্ঠ তিনি)
শহীদের স্মরণীয় বাণী : পিতা-মাতাকে বলেছিলেন; ‘৯৯ জন শহীদ হয়েছে, আমাকে দিয়ে যেন ১০০ হয়।’ ঈদুল আযহার পর বাড়িতে ফজর নামাজ পড়ে পিতাকে নিয়ে নামাজ আদায় করে মুনাজাতে বলেন, ‘আমি যেন শহীদ হই।’ পিতা বললেন; আমিন।

শাহাদাতে শহীদের পিতার প্রতিক্রিয়া
‘আমি আর কোনো ছেলের জন্য আমিন বলবো না।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ যোবায়ের হোসাইন

পিতা

মাস্টার রহমতুল্লাহ

মাতা

মোসাম্মাৎ জরিনা খাতুন।

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৪ ভাই ৩ বোন (সর্বকনিষ্ঠ তিনি)

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম+ পোস্ট- চৌবাড়িয়া, থানা- টাঙ্গাইল সদর, টাঙ্গাইল।

সাংগঠনিক মান

সদস্য

সর্বশেষ পড়ালেখা

এমএসএস (শেষ বর্ষ), অর্থনীতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শাহাদাতের স্থান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের পিছনে


শহীদ যোবায়ের হোসাইন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ যোবায়ের হোসাইন


শহীদ যোবায়ের হোসাইন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ যোবায়ের হোসাইন