শহীদ রবিউল হোসাইন

২৭ মার্চ ১৯৮০ - ২৬ মার্চ ১৯৯৮ | ৯৪

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

একটি সুন্দর ও নিষ্কুলুষ বলিষ্ঠকণ্ঠ আজ আর স্মৃতিগোচর হয় না। সেই সুন্দর নিষ্পাপ অবয়ব দীপ্তিমান হাস্যোজ্জ্বল চেহারার প্রিয় ভাইটির নাম মুহাম্মদ রবিউল হুসাইন। যিনি আর কখনো আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না।
‘চলে গেছে ওপারে সুন্দর জীবনে
বসন্ত ফিরে তবু ওরা ফেরে না।’

শহীদ রবিউল ছিলেন অসংখ্য ফুটন্ত গোলাপের মাঝে অত্যুজ্জ্বল সৌরভ বিলানো অনন্য এক নাম। দেশ ও জাতি সকলের প্রত্যাশার পদ্ম, পলাশ, জুঁই, চামেলি, হাসনাহেনা। তিনি ছিলেন হাজারো নক্ষত্রের মাঝে বাছাইকৃত একটি নক্ষত্র। তার প্রাণবন্ততা, আত্মবিশ্বাস, চারিত্রিক বলিষ্ঠতা, জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও তীক্ষ্ম মেধাবী ছাত্র, যুবক ও তরুণদের মোহিত করেছিল। কিন্তু সেই আশার গোলাপটি আজ আমাদের মাঝে নেই। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বর্বরতার শিকার হন সম্ভাবনাময় তরুন রবিউল হুসাইন। খুনিদের নির্মমতা দেখে সেদিন ছাত্র, শিক্ষক-কর্মচারী, শহীদের সাথীসহ অসংখ্য মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।

ঘটনার সূত্রপাত
আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বাজারে ট্যাক্স আদায়সহ নানা অপকর্ম বাড়িয়ে দেয়। তারা মীরস্বরাইয়ের মিঠাছড়া বাজারে চাঁদাবাজি ও ট্যাক্স আদায়ের জন্য অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ব্যবসায়ীদেরকে লুটপাট ও জীবন নাশের হুমকি দেয়। ছাত্রলীগ তাদের এ অপকর্মের জন্য ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অন্তরায় হিসেবে মনে করেছিল। কারণ, সেখানে ছাত্রশিবিরের প্রভাব ছিল বেশি। ফলে তারা ইসলামী ছাত্রশিবিরকে উৎখাত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তৈরি করে এবং শিবিরের কয়েকজন নেতাকর্মীকে হত্যা করার গোপন পরিকল্পনা করে।

শাহাদাতের ঘটনা
২৬ মার্চ ১৯৯৮। ইসলামী ছাত্রশিবির মীরসরাই থানার উদ্যোগে মিঠাছড়া মাদ্রাসার ক্যাম্পাসে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা ছিল। আলোচনা সভা শেষে মিছিল বের করে। মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ার পর শিবির অফিসে রাতের শববেদারি বাস্তবায়নের জন্য কর্মী ভাইদের নিয়ে একটি প্রোগ্রাম চলছিল। কিছুক্ষণ পর খবর আসলো মিঠাছড়া বাজারে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা শিবির কর্মী আশরাফকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। সাথে সাথে দায়িত্বশীলগণ কর্মীদের নিয়ে ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আশরাফ ভাইকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে যান। বাজার কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি বেরিয়ে আসলেন। কিন্তু ছাত্রলীগের খুনিরা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ শুরু করলো। গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান শহীদ রবিউল হুসাইন। খুনিরা উল্লাস করতে করতে পালিয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে মীরসরাইসহ সারা চট্টগ্রামে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো। শহীদের লক্ষ লক্ষ সাথী বিক্ষোভে ফেটে পড়ল।

৪ দফা নামাজে জানাযা
পরদিন ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষে শহীদের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে। ২য় জানাযা অনুষ্ঠিত হয় মিঠাছড়া উচ্চবিদ্যালয় ময়দানে। উভয় জানায় মানুষের ঢল নামে। জানাযা শেষে হাজার হাজার শোকাহত জনতা খুনীদের বিচারের দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলে। শহীদ রবিউলের ৩য় বারের মত জানাযা অনুষ্ঠিত হয় তার প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবু তোরাব মাদ্রাসার ময়দানে। ৪র্থ দফা (সর্বশেষ) জানাযা অনুষ্ঠিত হয় শহীদ রবিউলের পারিবারিক কবরস্থানের পাশেই।

পুত্রহারা মায়ের আহাজারি
২৭ মার্চ সকালে শহীদ রবিউলের মা প্রথমে শুনেছিলেন যে, রবিউল অসুস্থ। কিন্তু সকাল বেলায় যখন রবিউল ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে তার মাকে জানানো হল, আপনার রবিউল শাহাদাত বরণ করেছে, তখন তাঁর বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলো। মা তাঁর প্রিয় রবিউলকে হারিয়ে বাকহীন হয়ে গেলেন। শহীদ রবিউলে ভাইদের আর্তনাদ এবং আত্মীয় স্বজনের করুণ আহাজারিতে সেদিন আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। তার মাকে সান্ত্বনা দেয়ার কিছুই ছিল না। তিনি নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। রবিউলের গর্বিত মা সেদিন বলেছিলেন; ‘আমার রবিউল আমাকে বলেছিল-মা আমি শাহাদাত বরণ করলে আমার জন্য কাঁদবে না।’ আমার ছেলে শহীদ হয়েছে এটা আমার সান্ত্বনা।

শাহাদাত ছিল যার প্রত্যাশা
শহীদ রবিউল ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। তার অমায়িক ব্যবহার, চারিত্রিক মাধুর্য ও বলিষ্ঠতা তার শিক্ষক মহল থেকে শুরু করে সকলকে আকৃষ্ট করে তুলেছিল। তিনি সর্বদা শাহাদাতের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি দায়িত্বশীলদের প্রায়ই বলতেন, ‘আমি যখন শাহাদাত বরণ করব তখন আমার পোস্টমর্টেম করবেন না।’ তার লেখা, তার আলাপ-আলোচনা সব কিছুর মধ্যে শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয়ে উঠতো। রবিউল ভাই শাহাদাতের পূর্বে তার মাকে বিভিন্ন শহীদের ঘটনা তুলে ধরে ধৈর্য ধারণ করার জন্য বলতেন।
রবিউল ভাই সদস্য হবার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন বিষয়ে ১৬টি নোট, অসংখ্য দারসে কোরআন ও হাদিস তৈরি করেছিলেন। তার নোট বইয়ের কভারে রবউিল ভাই যে স্টিকারটি লাগিয়েছিলেন তাতে লেখা আছে-
‘শহীদের যত খুন ঝরবে
সব খুন মিশবে এ মাটিতে
পরিণত করে দেবে দেশটা
আমাদের মজবুত ঘাঁটিতে।’

শহীদের রক্ত যায় না বৃথা
ঘাতকদের বিবেকহীন বুলেটের নির্মম আঘাতে রবিউলের জীবনপ্রদীপ নিভে গেল। সন্ত্রাসীরা রবিউলের প্রাণ কেড়ে নিয়ে গেছে। মানবরূপী পশুদের গুলি তার বুক ছিদ্র করে দিয়েছে। কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি তার লক্ষ্য, তার চোখের ভাষা। রবিউল ভাই যেন সেই মুহূর্তেও আমাদের ডেকে বলছেন; ‘আমি চলে যাচ্ছি জান্নাতের ওপারে, তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তোমাদের আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রদত্ত বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।’

একনজরে শহীদ মুহাম্মদ রবিউল হুসাইন
নাম : মুহাম্মদ রবিউল হুসাইন
পিতা : মুহাম্মদ শহীদ উল্লাহ
মাতা : মুছা. বিবি ছরুরা
ঠিকানা : পুর্ব মায়ানী, মীরসরাই চট্টগ্রাম
ভাই বোনদের সংখ্যা : ৩ ভাই ১ বোন
শহীদ অবস্থান : ২য়
জন্মতারিখ : ২৭-০৩-১৯৮০
একাডেমিক যোগ্যতা : ফাজিল অধ্যয়নরত
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : মিঠাছড়া মাদরাসা
সাংগঠনিক মান : সাথী দায়িত্ব আবু তোরাব মাদরাসা সভাপতি
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রলীগ গুণ্ডা
আহত হওয়ার তারিখ : ২৬-০৩-১৯৮৮ ইং বিকেল সন্ধ্যা: ৭০০ স্থান মিঠাছড়া বাজার
কবর যেখানে : পারিবারিক করবস্থান
যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম উত্তর জেলা
শহীদের শখ : পরিস্কার পরিচ্ছন্নভাবে চলা দওয়াতি কাজ করা
প্রাথমিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান : ১. আবু তোরাব সিনিয়র (ফাজিল) মাদ্রাসা
২. সর্বশেষ মিঠাছড়া ইসলামীয়া ফাজিল মাদরাসা

আম্মুর প্রতিক্রিয়া
শহীদ রবিউল ভাইয়ের আম্মা জানান, সে সবসময় ইসলামী আন্দোলনের কাজ করতো। বাধা দিয়ে কখনো বিরত রাখা যেত না। একদিন বকাবকি করলে সে একজন শহীদের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলে এক মায়ের এক সন্তান ছিল সে আল্লাহর দ্বীনের কাজ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে তার মা ছেলে মৃত্যুর খবর শুনে বলল আল হামদুলিল্লাহ। আমার কোন দুঃখ নেই। রবিউল এই ঘটনা বলে তার মাকে বলল আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন আল্লাহর দ্বীনের জন্য শহীদ হতে পারি, আমি শহীদ হওয়ার পরে এই মায়ের মতো আপনি কাঁদবেন না। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবেন।
উল্লেখ্য, রবিউল ভাইয়ের শাহাদাতের পর থেকে তার আম্মা শোকে শারীরিক ভাবে অসুস্থ।

আব্বার প্রতিক্রিয়া
শহীদ রবিউল ভাইয়ের আব্বা বলেন, রবিউল সবসময় পরকালকে প্রাধান্য দিত। দুনিয়ার জীবনের কোনো কিছুর প্রতি তার লোভ ছিল না। বাড়ির নতুন ঘর বাঁধতে সময় তার বাবা তাকে ঘরের কাজ দেখতে বললে সে বলত ঘর বাড়ি এগুলো আপনিতো দেখেন এগুলো আমার জন্য নয় আমি পরকালে পেতে চাই। তার পিতা চিহ্নিত খুনিদের দ্রুতবিচার দাবি করেন। দীর্ঘদিন বিচার না হওয়ার হতাশা ব্যক্ত করেন।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ রবিউল হোসাইন

পিতা

মুহাম্মদ শহীদ উল্লাহ

মাতা

মুছা. বিবি ছরুরা

জন্ম তারিখ

মার্চ ২৭, ১৯৮০

ভাই বোন

৩ ভাই ১ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

পুর্ব মায়ানী, মীরসরাই চট্টগ্রাম

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ফাজিল অধ্যয়নরত, মিঠাছড়া ইসলামীয়া ফাজিল মাদরাসা

শাহাদাতের স্থান

মিঠাছড়া বাজার


শহীদ রবিউল হোসাইন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ রবিউল হোসাইন


শহীদ রবিউল হোসাইন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ রবিউল হোসাইন