শহীদ মঞ্জুরুল কবির

৩০ জুন ১৯৯৭ - ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫ | ৮২

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

শহীদ মঞ্জুরুল কবীর ১৯৭৫ সালের ৩০ জুন ময়মনসিংহ জেলার মুক্তগাছা থানার অন্তর্গত বনবাংলা গ্রামের নিঝুম পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। শহীদের পিতা আবদুল করিম সরকার ১৯৮৯ সালের ১৮ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পরহেজগার ও ধর্মভীরু ছিলেন। মাতা জোবেদা খাতুন একজন ধর্মপরায়ণ আদর্শ গৃহিণী।

আব্বা, ভাই-বোন এবং মায়ের একান্ত স্নেহের পরশে মঞ্জুরুল কবীর ধীরে ধীরে বড় হন। ৫ বছর বয়সে তিনি ভর্তি হন বনবাংলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করে তিনি ভর্তি হলেন বনবাংলা ফয়জুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ে। স্কুলজীবনে তিনি ছিলেন পড়াশুনার প্রতি খুবই মনোযোগী। পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি ছিল তার প্রবল আকর্ষণ। কিন্তু তা কেবল সময়মত। খেলাধুলা তার পড়াশুনা এবং নামাজ কালামে বিঘ্ন সৃষ্টি করত না। তিনি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়েছেন। স্কুলেজীবনে বরাবরই ১ম অথবা ২য় স্থান লাভ করতেন। পিতাহারা সংসারে বিভিন্ন কাজ করেও লেখাপড়া চালিয়ে যেতেন। ১৯৯০ সালে সাধারণ গণিত ও ইসলাম ধর্মে লেটার মার্কসসহ ১ম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৯২ সালে মুক্তাগাছার শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ থেকে ১ম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। বুকে অনেক আশা নিয়ে মায়ের আদরের সন্তান মঞ্জুরুল কবীর ভর্তি হলেন কৃষি শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৩ সালে। শাহাদাত বরণ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কৃষি অনুষদের ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার্থী ছিলেন।

ইসলামের প্রতি ভালবাসায় তাকে আকৃষ্ট করলো ইসলামী ছাত্রশিবিরের পতাকাতলে। স্কুলজীবনে তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সমর্থক হন এবং কর্মী হন ১৯৯১ সালের জুন মাসে। ইসলামকে জানার, বুঝার এবং আমল করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে আর বিরত রাখতে পারল না। তিনি ১৯৯৫ সালে সাথী হলেন। নিজেকে সঁপে দিলে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত পথে। শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ফজলুল হক হল শাখার বায়তুলমাল সম্পাদক ছিলেন। অন্যভাই বোনদের প্রতি ছিল তার সব সময় নজর। মঞ্জুরুল কবীরের ভাই এ, এন, এম, বজলুর রশিদ ভাইবোনদের মধ্যে বড় এবং একজন সরকারি চাকরিজীবী। আরেক ভাই আমিরুল ইসলাম চঞ্চল ৯ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। বোনেরা হলেন মোছা. জাহানারা বেগম, মোছা. ফাহিমা বেগম ঝর্ণা (ডিগ্রি পরীক্ষার্থী), তাহমিনা বেগম শিল্পী (৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত)।

ঘটনার বিবরণ
শহীদ মঞ্জুরুল কবীর দ্বীন কায়েম আন্দোলনের একজন অগ্রসেনানি ছিলেন। মুক্তাগাছা থানার বনবাংলা গ্রামের এই অমায়িক ছেলেটিকে সবাই দারুণ ভালবাসতো। কতজনকে যে তিনি নামাজী বানিয়েছেন তার হিসাব নেই। এই প্রাণবন্ত সরল, আল্লাহপ্রেমী তরুণটিকে সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে শহীদ করেছে। অত্যন্ত মেধাবী নিষ্পাপ মঞ্জুরুল কবীরকে হারিয়ে শহীদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের শোকে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেছে। শহীদের সম্মানিত বড় ভাই বজলুর রশিদ কেঁদে কেঁদে বললেন; এ কথা ঠিক যে আমরা আমাদের সবচাইতে মেধাবী ভাইটিকে হারালাম। কিন্তু সান্ত্বনা পাই এই ভেবে যে, ওতো আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছে। মানুষতো কতভাবেই মৃত্যুবরণ করে। কেউ দুর্ঘটনায়, কেউ বা কোনো দুরারোগ্য রোগে। আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে গৌরবজনকভাবেই।

বজলুর রশিদ কাঁদতে কাঁদতে বললেন; আমি আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমার ভাইকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন। আমার ভাইয়ের শহীদ হওয়ার শখ যেন পূরণ হয়। তিনি বলেন; আমার নিষ্পাপ ভাইকে যারা হত্যা করেছে আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার বনবাংলা গ্রামের ফয়জুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ তৈয়ব উল্লাহ বলেন; মঞ্জুরুল কবীর আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিল। তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। আমার দীর্ঘ শিক্ষকজীবনে অনেক ছাত্র পেয়েছি। কিন্তু মঞ্জুরুল কবীরের মতো বিনয়ী ও ভদ্র ছেলে আর পাইনি। ক্লাসে সবসময় নিয়মিত ছিল। সে ছিল মেধাবী। সহজে যেকোনো জটিল বিষয় সহজে আয়ত্ত করতে পারতো। তার মিষ্টি ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। স্কুলেও তাকে কোনোদিন কোনো শিক্ষকের সাথে খারাপ আচরণ করতে দেখিনি। তার মত নির্মল চরিত্রের ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তারা মানুষ হতে পারে না।

ময়মনসিংহ জেলার কোতোয়ালি থানার নারিকেল বাগান এলাকার অধিবাসী মোহাম্মদ মনসুর বলেন; শিবিরের ছেলেরা ১৯৯৪ সালের শেষের দিকে হলে থাকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবার কিছুদিন পর মঞ্জুরুল কবীর আমার বাড়িতে থাকা শুরু করে। তখন থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। তার মত সুন্দর চরিত্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র দেখিনি। সে ছোট ছেলেদের চকলেট খাওয়াতে খাওয়াতে মসজিদে নিয়ে যেতো। সেই প্রথম আমাদের এলাকায় ছোট ছেলেদের মসজিদে যেতে অভ্যস্ত করে। আমার ছেলেকে সে নামাজি বানায়। নিজ হাতে আমার ছেলেকে আপন ভাইয়ের মত গড়ে তুলেছে। বাসায় ভালো খাবার দাবার না থাকলে কোনোদিন কোনো খারাপ মন্তব্য করেনি। বরং খাবার দাবার শব্দ দুটি উচ্চারণ করলে সে রেগে যেত এবং বলতো, আল্লাহ যা মিলান তাই ভাল। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল তার এমন, গভীর রাতে তাকে আমি কোরআন পড়তে, নামাজ পড়তে দেখেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। মঞ্জুরুল কবীরের শাহাদাত আমাদের মাঝে শোকের ছায়া নিয়ে এসেছে। কারও কারও বাড়িতে ঠিকমতো চুলোয় আগুন জ্বলেনি।


একনজরে শহীদ মঞ্জুরুল কবীর
নাম : মঞ্জুরুল কবীর
পিতার নাম : আবদুল করিম সরকার ওরফে দানুমিয়া
সাংগঠনিক মান : সাথী
দায়িত্ব : ফজলুল হক হলের বায়তুলমাল সম্পাদক (বাকৃবি)
সর্বশেষ পড়াশুনা : ১ম বর্ষ, কৃষি অনুষদ
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব : এসএসসি (১৯৯০) ২ বিষয়ে লেটারসহ ১ম বিভাগ,
এইচএসসি (১৯৯২) ১ম বিভাগ
আহত হওয়ার স্থান : শাহজালাল হলের সামনে
শহীদ হওয়ার স্থান : শাহজালাল হলের সামনে
আঘাতের ধরন : গুলি, হকিস্টিক এবং ইটের উপর মাথা রেখে ইট দিয়ে হত্যা
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রঐক্য
শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৬.১২.১৯৯৫
যে শাখার শহীদ : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- বনবাংলা, থানা-মুক্তাগাছা, জেলা-ময়মনসিংহ
ভাই-বোন : ৩ ভাই, ৬ বোন
পরিবারের মোট সদস্য : ১০ জন
পিতা : মরহুম
মাতা : জীবিত, পেশা- গৃহিনি

শহীদের স্মরণীয় ঘটনা
স্বপ্নে দেখেন রমজানে শহীদ হবেন। তাই শাহাদাতের কয়েকদিন পূর্বে কবরের স্থানটি বড় বোনসহ আত্মীয় স্বজনদের দেখিয়ে দেন, যেখানে বর্তমানে শায়িত আছেন।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মঞ্জুরুল কবির

পিতা

আবদুল করিম সরকার ওরফে দানুমিয়া

মাতা

জোবেদা খাতুন

জন্ম তারিখ

জুন ৩০, ১৯৯৭

ভাই বোন

৩ ভাই, ৬ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম- বনবাংলা, থানা-মুক্তাগাছা, জেলা-ময়মনসিংহ

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

১ম বর্ষ, কৃষি অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

শাহজালাল হলের সামনে


শহীদ মঞ্জুরুল কবির

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মঞ্জুরুল কবির


শহীদ মঞ্জুরুল কবির

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মঞ্জুরুল কবির