২৮ অক্টোবর : যেন বদর-ওহুদের প্রান্তর
প্রত্যেকটি ঘটনার উপরে আরেকটি বড় ঘটনা তৈরি হয়। আমরা ইতিহাস থেকে হিরোসিমা-নাগাসাকির ধ্বংষযজ্ঞ ইতিহাস, এপ্রিলফুলের হত্যাযজ্ঞ ইতিহাস, আবু গারিব কারাগারের নির্যাতনের ইতিহাস, চেঙ্গিস খানের বর্বরতার ইতিহাস জানি। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ যে হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস তৈরি করেছিল তা পৃথিবীর সকল জঘন্য বর্বর ইতিহাসকে হার মানায়। যা আমাদের জাতীয় জীবনেই শুধু নয়, পৃথিবীর ইতিহাস বা মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বর্বরতম ও মর্মান্তিক কালো অধ্যায়। সেদিন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করে কিভাবে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের উপর নৃত্য প্রদর্শন করা হয়। কিভাবে একজনকে হত্যা করে তার মুখ থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দাঁতগুলোকে আলাদা করা হয়।
আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি ছিলাম। ঈদের ঠিক কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমরাও সেবার অধিকাংশ জনশক্তি ক্যাম্পসে ঈদ করেছিলাম। ২৮ অক্টোবর সকাল থেকেই আমাদের সবার মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা ছিল সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। সকাল পেরিয়ে যতই সময় এগিয়ে যাচ্ছে উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। আমরা টিভি নিউজের সামনে বসে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করছি। হঠাৎ টিভি পর্দায় ঢাকার পল্টন ময়দানের হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলো চোখে পড়তেই গায়ের লোম শিউরে উঠলো। অজানা আশক্সক্ষায় হৃদয়ে কম্পন তৈরি করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একের পর এক দীনি ভাইদের শহীদ হওয়ার ঘটনা কানে আসতে লাগলো।
কিন্তু আমরা সেদিন টিভি পর্দায় দেখেছিলাম কিভাবে বদর-ওহুদের মতো ছাত্রশিবির এবং জামায়াতের মুজাহিদ ভাইয়েরা শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন এবং মানবপ্রাচীর রচনা করে দায়িত্বশীলদের রক্ষা করেন। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি সেদিনের জামায়াতের পূর্ব ঘোষিত সমাবেশ সফলও করেছিলেন তারা। যা এখনো আমাদের বর্তমান জনশক্তির কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। শহীদ হচ্ছেন, রক্ত ঝরাচ্ছেন, গুলিবিদ্ধ হচ্ছেন, কিন্তু পল্টন ময়দানের এক ইঞ্চি জমিন বাতিল শক্তিকে দখল করতে দেননি।
কী নির্মমতা!
এক অজানা উৎকণ্ঠায় সারাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। পবিত্র মাহে রমজানের পর ঈদুল ফিতরের আনন্দ উৎসবের রেশ তখনও বিদ্যমান। দেশে যে গণতান্ত্রিক সুন্দর ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় ঈদের ৩ দিন পরই জোট সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কেয়ারটেকার সরকারের কাছে। শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন এ ঐতিহাসিক মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছে, সে সময়ই এক অজানা আশঙ্কা ভর করেছে সবার মনে। ঢাকা শহরে এক অদ্ভুত থমথমে নীরবতা, গ্রাম-গঞ্জে আটকেপড়া শহরমুখী মানুষ এক অবর্ণনীয় দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে টিভি এবং রেডিওর সামনে কী অবস্থা দেশের? রেওয়াজ অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী। ঠিক তার পরপরই পরিকল্পিতভাবে সারাদেশে সৃষ্টি করা হলো এক চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। সেই পুরনো দৃশ্য ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট ও সড়ক অবরোধ। পরদিন ২৮ অক্টোবর, সব জায়গায় থমথমে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, টিভি চ্যানেলে যখনই কোনো সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কী পরিস্থিতি তা জানার জন্য। বিকেল এবং সন্ধ্যায় প্রায় সবকটি টিভি চ্যানেলে যখন সচিত্র সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছিল কোটি কোটি মানুষের চোখ তখন স্থির। ঢাকার পল্টন মোড়ে এ কি লোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখছে তারা? লগি, বৈঠা, কিরিচ, লাঠি ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একদল উন্মত্ত মানুষ কিভাবে নির্বিচারে অত্যাচার চালাচ্ছে আরেকদল মানুষের ওপর।
আওয়ামী কালো থাবা
শেখ হাসিনার ছড়িয়ে দেয়া হিংসার অগ্নিশিখায় তখন জ্বলল পুরো বাংলাদেশ। মাত্র তিন দিনে হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য আর লুটপাটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করল কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে তারা। অবশ্য জাতি হিসেবে আমরাও ভুলে যেতে বসেছিলাম মুজিব-হাসিনার দীর্ঘ দুঃশাসনের কথা। যে দুঃস্বপ্ন আজও তাড়িয়ে বেড়ায় এ দেশের শত-সহস্র নির্যাতিত বনি আদমকে। যে দলটি ক্ষমতার শুরুতেই ১৯৭২-৭৫ সালে গণতন্ত্রকে হত্যা করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, লাল বাহিনী, নীল বাহিনী গঠন করে দেশকে নরককুণ্ডে পরিণত করেছিল, সেই দলটিকে জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেও শেখ হাসিনার মায়াকান্নায় আবেগাপ্লুত জনগণ তাদের সংশোধনের সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা আবারো তার ভয়ঙ্কর চেহারায় ফিরে আসেন। তিনি সন্ত্রাসী গডফাদার শামীম ওসমান, আবু তাহের, আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ, জয়নাল হাজারী, ডা. ইকবাল, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, হাজী সেলিম, হাজী মকবুল, বোমা মানিক আর শত শত খুনি-সন্ত্রাসীদের নিয়ে নারকীয় উল্লাসে, নতুন উদ্যমে, একুশ বছরের বুভুক্ষু রক্তলোলুপতা আর হিংস্র জিঘাংসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে।
আন্দোলনের ইতিহাস ও সেদিনের শহীদেরা
ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, চেসনিয়া, বসনিয়ায় মুজাহিদের মায়েদের ইতিহাস আমরা জানি। সেখানে এক ছেলে শহীদ হলে আরেক ছেলেকে কিভাবে জিহাদের ময়দানে লড়াই করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাদের শহীদদের মায়েদের অনুভূতি যেন ঠিক একই রকম। শহীদ মাসুম ভাইয়ের মায়ের সাথে একদিন কথা হচ্ছিল। তার কাছ থেকে মাসুম ভাই সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, মাসুম প্রায় সময়ই না বলে বাড়ি থেকে সকালবেলা বেরিয়ে যেত এবং রাতে ফিরে আসতো। আমরা সারাদিন তাকে নিয়ে খুব উৎকণ্ঠায় থাকতাম। ফিরে এলে ‘কোথায় গিয়েছিলে’ জানতে চাইলে বলত, প্রোগ্রাম ছিল, মা। বলে গেলে না কেন জিজ্ঞেস করলে বলত, প্রতিদিন তোমাদের জানিয়ে যেতে হলে হয়ত তোমরা আমাকে নিষেধ করতে। আর তখন হয় তোমার অবাধ্য হতে হতো, না হয় আমার দায়িত্বশীলদের অবাধ্য হতে হতো। দু’টিই আমার জন্য ভালো হতো না। তাই তোমাকে না বলে গেলে তোমারও অবাধ্য হতে হলো না এবং দায়িত্বশীলেরও আনুগত্য করা হলো। সে কারণেই তোমাদের না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম সাংগঠনিক কাজে।
২৮ অক্টোবরে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন তাদের মধ্যে শহীদ মুজাহিদ, শহীদ মাসুম, শহীদ শিপন, শহীদ ফয়সাল এবং শহীদ রফিক ভাইয়ের বাড়িতে একাধিক বার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে। আমি খুব কাছ থেকে শহীদের মায়েদের যে অনুভূতি দেখেছি তা আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে এবং এ আন্দোলনে কাজ করার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
শহীদ মুজাহিদ তার মাকে বলতেন, মা, মানুষতো অসুস্থ অবস্থায়ও মারা যায়, পানিতে ডুবে মারা যায়, রোড অ্যাকসিডেন্টেও মারা যায়Ñ এর থেকে কি আল্লাহর পথে লড়াই করে জীবন দেয়া অধিক শ্রেয় নয়? আল্লাহতায়ালা আমাদের এই প্রিয় ভাইটির মনের বাসনা কবুল করেছেন।
নির্যাতন ও জুলুম করে কোনো আদর্শকে নির্মূল করা যায় না। বরং ইতিহাস সাক্ষি, যুগে যুগে জুলুমবাজদেরই পতন হয়েছে। করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ২৮ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ডের নায়কদেরও কঠিন পরিণতি বরণ করতে হবে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়তো দুনিয়ার কোনো আদালতে আমরা পাবো না কিন্তু শহীদদের মায়েরা রাত জেগে জেগে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর আদালতে যে মামলা দাখিল করেছেন সেই আদালত থেকে হত্যাকারীরা কেউ বাঁচতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।
লেখক : মো: দেলাওয়ার হোসেন
কেন্দ্রীয় সভাপতি,
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির
সংশ্লিষ্ট
- ২৮শে অক্টোবর'০৬ পল্টন ট্রাজেডি দিবস উপলক্ষে আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত
- দেশ ও জাতির কল্যাণই হবে মেধাবীদের লক্ষ্য
- বদর যুদ্ধের চেতনায় ইসলামের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে
- চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে ভারি বর্ষণে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ
- ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে শিবির নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে
- নড়াইল ও যশোরে শিবির নেতাকে বারবার গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা ও রিমান্ডে নেয়ার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ
- ১৭ রমাদান, ঐতিহাসিক বদর দিবস।
- ২৮ অক্টোবরের খুনীরাই আজ সারাদেশে তান্ডব আর অরাজকতার নেতৃত্ব দিচ্ছে
- শহীদদের রক্ত ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করেছে
- শাহাদাতের সিঁড়ি যত দীর্ঘ হবে বিজয় তত নিকটবর্তী হবে -ছাত্রশিবির