এক নজরে
শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান
শেখ মুহাম্মদ ইদ্রিস
নভেম্বর ৩০, -০০০১
৩ ভাই ২ বোন
টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ
সাথী
বি এ, বি এল কলেজ, খুলনা
খুলনা মেডিকেল কলেজ
ইসলাম নামক বৃক্ষটির গোড়ায় পানি নয় বরং সত্য ও ন্যায়ের সাক্ষ্য শহীদের তরতাজা রক্ত ঢালা হয়েছে এবং তা আজও অব্যাহত আছে। ফলে তাঁর শিকড় সুগভীর তলদেশে যেমন প্রতিত, তেমনি সুবিশাল আকাশে তার শাখা প্রশাখাও সম্প্রসারিত। আর তার সুশীতল ছায়ার মায়ায় হৃদয় গলে যায়। বাংলার জমিনেও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় দ্বীন কায়েমের প্রচেষ্টায় ছাত্রশিবির সেই সুখের ছোঁয়া পায়। তাই বাতিলের জগদ্বলে চাপা পড়া দিক ভ্রান্ত মানুষেরা সে সুখ না পেয়ে ছাত্রশিবিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু তাতে বোকারা বুঝে না যে, এই আন্দোলনের কর্মীদের পিছপা হটার চেয়ে বরং তার সামনে চলার গতি আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। এমনই একজন দ্বীনি ভাই শহীদ শেখ আমিনুল বিমান। সে আওয়ামী পরিবারের হয়েও ইসলামকে নিজের সকল কাজ কর্ম ও চিন্তায় ধারণা করার কারণে অনেক ভুলপথ থেকে সরে এসে এই কাফেলার সারিতে যোগ দিয়েছিলেন, হযরত ওমর (রা:)-এর মতো।
ব্যক্তিগত পরিচয়
শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান। পিতা জনাব শেখ মুহাম্মাদ ইদ্রিস পানি উন্নয়ন বোর্ডে এমই বিভাগে চাকরি করেন। তিনি খুলনার ছোট বয়রাতে বসবাস করেন। তাঁরা ছিলেন ৩ ভাই ২ বোন। পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জে টুঙ্গিপাড়া।
শিক্ষাজীবন
শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান ওয়াপদা (খুলনা) মাধ্যমিক শিক্ষা নিকেতন থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি ও খুলনা হাজী মহসিন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। পরবর্তীতে দৌলতপুর দিবা নৈশ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। শাহাদাতকালে তিনি খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র ছিলেন।
সাংগঠনিক জীবন
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বিখ্যাত শেখ পরিবারে সন্তান হওয়ায় প্রথম জীবনে তিনি মুজিববাদী ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তাঁর পরিবার আওয়ামী রাজনীতিতে তৎকালীন সময়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ইসলামী জীবনদার্শে আকৃষ্ট হয়ে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের প্রত্যয় মুজিববাদী ছাত্রলীগকে প্রত্যাখ্যান করে, ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান করেন। তখন থেকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি ছিলেন বিদ্যুতের মত সক্রিয়। দ্রুত গতিতে আন্দোলনে এগিয়ে যান। তিনি শিবিরের সাথী পদে উন্নীত হন এবং শাহাদাতকালে বি এল কলেজ ক্যাম্পাস শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। শহীদ বিমানের চারিত্রিক গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও ইসলামী আন্দোলনের শুভাকাঙ্ক্ষীতে পরিণত হন। তিনি কখনো মাদরাসায় পড়েন নি। কিন্তু তাঁর মুখে ঘন কালো চাপদাড়ি ও বেশভূষা দেখে সবাই মনে করতেন তিনি মাদরাসায় পড়েছেন। মসজিদ ছিল তাঁর প্রিয় ঠিকানা। মানবতার শত্রুরা তাঁর এই সক্রিয়তাকে সহ্য করতে না পেরে ২৫ শে মার্চ ১৯৯২ সালে আওয়ামী কমিউনিস্ট চক্র তাকে এক নৃশংস পন্থায় খুন করে।
শাহাদাতের ঘটনা
পবিত্র রমজান মাস। ২০তম রোজার ইফতারি শেষে শহীদ বিমানসহ অফিসে তারাবির নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় একটি মশাল মিছিল, “একটা একটা শিবিরধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।” “জামায়াত শিবিরের বংশ করে দেব ধ্বংস” ইত্যাদি উস্কানিমূলক শ্লোগান দিতে দিতে খান জাহান আলী রোডস্থ ইসলামী ইসলামী ছাত্রশিবিরের অফিসের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছিল। তথাকথিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নামে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ৫ দলের সন্ত্রাসীরা এই মশাল মিছিল বের করেছিল।
মিছিলকারী দুষ্কৃতকারীদের হাতে ছিল কাটা বন্দুক রাইফেল, পিস্তল, রামদা, হকিস্টিক, লাঠি, ককটেল ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র। মিছিলটি শিবির অফিসের কাছে আসতে না আসতে শুরু হলো ককটেল, বোমা হামলা ও উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ। লোকজন ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় শিবির কর্মীরা কিছুটা হতবিহ্বল হলেও শিবির অফিস ছেড়ে যায়নি। নিরস্ত্র শিবির কর্মীরা তাদের প্রিয় সংগঠনের অফিস রক্ষার জন্যে সাহসিকতার সাথে রুখে দাঁড়ায়। খোদাদ্রোহী শক্তি আধঘণ্টা ধরে গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা চালায়।
এক পর্যায়ে হামলাকারীরা শিবির অফিসের সামনে শেখ আমিনুল ইসলাম বিমানকে পেয়ে সংঘবদ্ধভাবে রামদা, লোহার রড, হাতুড়ি দিয়ে পিটাতে থাকে। তাদের কাপুরুষোচিত হামলায় বিমানের মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে আসে। সমস্ত শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়, জ্ঞান হারিয়ে মটিতে পড়ে যান। বিমানের ওপর কুচক্রীরা তাদের উন্মাদনা মোটানোর পর নিরাপদে সরে পড়ে। মুমূর্ষু অবস্থায় শহীদ বিমানসহ আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তাররা প্রাণপণ চেষ্টা করেন বিমানকে জ্ঞান ফিরিয়ে আনার। কয়েক হাজার সিসি রক্ত দেয়া হয় তার শরীরে। কিন্তু তাঁর জখম ছিল অত্যন্ত গুরুতর। ক্রমশ তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। গভীর রাতে যখন মানুষ ঘুমে আচ্ছন্ন তখন আমিনুল ইসলাম রাত ১২টা ০৫ মিনিটে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন।
জানাযা ও দাফন
শহীদ আমিনুল ইসলাম বিমান ভাইয়ের শাহাদাতের খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। শহীদের শোকাহত সাথীরা এলাকার আপমর জনতা জানাযায় শরিক হন। পরে নামাজে জানাযার পর স্থানীয় গোরস্থানে শহীদের লাশ দাফন করা হয়।
প্রতিবাদ ও মামলা
বিমান হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র শোকের ছায়া ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এদিকে বিমান হত্যার বিরুদ্ধে ৭ জন দুষ্কৃতকারীকে চিহ্নিত করে থানায় মামলা দায়ের করা হলো। খুনিদের পক্ষে ওকালিত করার জন্য ড. কামাল ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ১৬ জুলাই ১৯৯২ সালে খুলনা যায়। মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) এর আদালত বিমান হত্যার প্রধান দু’আসামি কমিউনিস্ট পার্টি নেতা এডেভোকেট ফিরোজ আহমদ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা বেদুঈনের জামিনের আবেদন নাকচ করে জেলে প্রেরণ করা হয়। অপর ৭ জন আসামিকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। নরঘাতকরা আদালতের প্রাঙ্গণে রায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান ও ভাঙচুরের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে।
মায়ের প্রতিক্রিয়া
আমার ৫ সন্তানের মধ্যে শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান ছিল সবচেয়ে নম্র, ভদ্র এবং সবার প্রিয়। ইসলামী আন্দোলনের কাজ শুরু করার পর থেকে আমি কোন দিন দেখিনি সে কখনও কারো সাথে খারাপ আচরণ করেছে কিংবা নামাজ কাজা করেছে। সব সময় সে তার ভাই-বোন,পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুদের ইসলামের দাওয়াত দিতো এবং নিজেও সর্বদা মেনে চলতো। আমার প্রিয় সন্তান যে কাজের জন্য জীবন দিয়েছে তোমাদের প্রতি আমার একটাই চাওয়া তোমরা তা বাস্তবায়ন করবা।
শিক্ষকের প্রতিক্রিয়া
আমার শিক্ষকতার জীবনে শহীদ আমিনুল ইসলাম বিমানের মতো এতো ভদ্র শান্ত শিষ্ট ভাল ছাত্র আর দেখিনি। সে সকল শিক্ষককে সম্মান করতো। কোন শিক্ষক কিংবা কোন ছাত্র বা কর্মচারীদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে বলে আমার জানা নেই।
একনজরে শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান
নাম : শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান
পিতার নাম : শেখ মুহাম্মদ ইদ্রিস
ঠিকানা : টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ
পরিবারে ভাই-বোন সংখ্যা : ৩ ভাই ২ বোন
শহীদের অবস্থান : ৪২তম
একাডেমিক যোগ্যতা : বি এ পাস
সাংগঠনিক মান ও দায়িত্বসমূহ : সাথী ও বি এল কলেজ ক্যাম্পাস শাখার সেক্রেটারি
যাদের আঘাতে শহীদ : আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট সন্ত্রাসীদের আঘাতে
আহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ২৫ মার্চ ১৯৯২, শান্তিধাম মোড়, খুলনা
শাহাদাতের তারিখ ও স্থান : ২৫ মার্চ ১৯৯২, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ
কবরস্থান যেখানে : স্থানীয় গোরস্থানে কবর দেয়া হয়।
যে শাখার শহীদ : খুলনা মহানগরী।
“আল্লাহর জন্য শহীদের রক্ত পৃথিবীতে যতদিন
শান্তির জন্য ইসলামী বৃক্ষ ছায়া দিবে ততদিন”
শহীদ শেখ আমিনুল ইসলাম বিমান
শেখ মুহাম্মদ ইদ্রিস
নভেম্বর ৩০, -০০০১
৩ ভাই ২ বোন
টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ
সাথী
বি এ, বি এল কলেজ, খুলনা
খুলনা মেডিকেল কলেজ