শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ০৪ জানুয়ারি ১৯৮৬ | ১২

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

নাজিরহাট-ফটিকছড়ি এলাকার প্রথম শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর। ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামের সাজেদা বেগম ও আবুল হাশেম চৌধুরীর সন্তান। তিনি ৫ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন।

শিক্ষাজীবন
মেধাবী ছাত্র সেলিম জাহাঙ্গীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে সচেতন ছাত্র ছিলেন। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার পাশাপাশি এসএসসি পরীক্ষায় ৪টি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। নাজিরহাট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর একই কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। শাহাদাত বরণকালীন সময়ে তিনি বি.এ পরীক্ষার্থী ছিলেন।

অতুলনীয় দাওয়াতি চরিত্র
আল্লাহর পথের তেজোদীপ্ত কাফেলার এ সৈনিক শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের জন্য যেমন ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, তেমনি অকুতোভয়। শিশু-কিশোর, সমবয়সী যুবকদের আল্লাহর পথের দিকে আহ্বানই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য-লক্ষ্য। সদা বন্ধু-বৎসল, মিষ্টভাষী, বিনয়ী ও বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটি রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা সত্ত্বেও সবার কাছে পরিচিত ও গ্রহণীয় ছিলেন। কারণ তাঁর সদাতৎপর চলাফেরা, সাংস্কৃতিক কার্যাবলিতে সংশ্লিষ্টতা এবং সব সহপাঠীর উপকারে তাঁর অকৃত্রিম উদ্যোগ তাঁকে ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখদের শীর্ষে আসীন করেছিল। পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের কাজের ব্যাপারে ছিলেন একেবারেই নিবেদিতপ্রাণ এবং আপসহীন। তাঁর এই সুন্দর ও মহৎ গুণাবলি এবং কার্যাবলিগুলো সহ্য হয়নি রক্তপিপাসু ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের।

শাহাদাতবরণ
উত্তর চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ “নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজ”, ইসলামী ছাত্রশিবিরের জন্মের এক বছর কাল যেতে না যেতেই শুরু হয় ইসলামী আন্দোলনের কাজ। ছাত্রশিবিরের দাওয়াতি তৎপরতার ফলে ছাত্ররা আসতে থাকে এ কাফেলার সাথে। অনেক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে ইসলামী আন্দোলনের শিশু বৃক্ষটি। ইসলামী আন্দোলনের এই তৎপরতা সঙ্গত কারণেই সহ্য করতে পারেনি দেশ ও মানুষের শত্রু রক্তলোলুপ ছাত্রলীগ।

১৯৮০ সালে নাজিরহাট বাজার ইসলামী ছাত্রশিবিরের অফিসে প্রকাশ্য দিবালোকে অগ্নিসংযোগ করে, কুরআন, হাদিস ও ইসলামী সাহিত্য পুড়িয়ে ফেলে তারা। কিন্তু তাতে শহীদি কাফেলার যাত্রা থেমে থাকেনি। শত্রু-মিত্র নির্বশেষে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সবাই দেখল যে, শত বাধা-বিপত্তির মুখেও ক্রমান্বয়ে ছাত্রশিবির হয়ে উঠছে এক জনপ্রিয় আন্দোলনের নাম। এবার তারা ভিন্ন পথ ধরল। হত্যা আর সন্ত্রাসের চরমতম পথ। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৮৫ সালের ১১ আগস্ট তারা একটি মিছিলের আয়োজন করে। মিছিলের এক পর্যায়ে বিনা উসকানিতে সশস্ত্র অবস্থায় ক্লাসে ঢুকে শিবিরকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। এ সময় কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শিবিরকর্মী জমির উদ্দিন জোহরের নামাজের জন্য অজু করছিলেন, মুজিববাদী ছাত্রলীগের বাহিনী তাঁর ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে পুকুরে ফেলে দেয়। আর একজন ছাত্রকে আক্রমণ করার সময় তাকে রক্ষা করতে কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এগিয়ে এলে ছাত্রলীগ তাঁকেও লাঞ্ছিত করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে সম্মানিত কলেজ শিক্ষকবৃন্দ কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেন। অতঃপর কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে। এ ঘটনার পরও ছাত্রলীগ বিভিন্নভাবে ছাত্রশিবিরের কর্মীদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে।

২০ ডিসেম্বর, ১৯৮৫। ছাত্রশিবিরের নাজিরহাট শহর শাখার সভাপতি শামছুল আলম বাহাদুরকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় তারা। ২১ ডিসেম্বর বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রশিবিরের কর্মী নাসির উদ্দীনকে মারাত্মকভাবে আহত করে। সূর্য উদিত হলো ২৬ ডিসেম্বরের। কলেজ খোলার দিন আজ। একই দিনে এইচএসসি নির্বাচনী পরীক্ষাও শুরু। ছাত্রলীগের অব্যাহত সন্ত্রাসের কারণে এবং নিরাপত্তার অভাবে অনেক ছাত্রশিবির কর্মী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এমন অবস্থার পরও যাঁরা সাহস সঞ্চয় করে পরীক্ষা দিচ্ছিল তাঁরা ৩১ ডিসেম্বর পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আসার সময় ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রুপের শাহজাহান, রশিদ, হেলাল ও শওকত চক্র পরিকল্পিত হামলা চালায়। এতে শিবির নেতা সেলিম জাহাঙ্গীর, শওকত উল্লাহ, দিদার ও সফিসহ বেশ কয়েকজন ছুরিকাহত হন। এদের মধ্যে আল্লাহর পথের সাহসী সৈনিক সেলিম জাহাঙ্গীর ও শওকত উল্লাহ ছুরিকাহত হওয়ার পরও সে স্থান এক হাতে চেপে ধরে অপর হাত উঁচু করে কলেজ ক্যাম্পাসে স্লোগান দিয়েছিলেন, নারায়ে তাকবির/আল্লাহু আকবর, ইসলামী ছাত্রশিবির/জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ, মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী/আমরা সবাই মরতে রাজি, রক্তের বন্যায়/ভেসে যাবে অন্যায়, বিপ্লব বিপ্লব/ইসলামী বিপ্লব।

আহত হওয়ার পর স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তার তাঁদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। বেবিট্যাক্সিযোগে তাঁদেরকে হাসপাতালে নেয়ার পথে খুনি ছাত্রলীগ চক্র ফরহাদাবাদ নুর আলী মিয়ার হাটে ব্যারিকেড দিয়ে ট্যাক্সি থামিয়ে আহতদের ওপর পুনরায় হামলা করে। খুনের নেশায় উন্মত্ত রক্তখেকো আওয়ামী ও ছাত্রলীগের গুণ্ডাবাহিনী রামদা ও কিরিচ দিয়ে হাত ও পায়ের শিরা ও রগ কেটে দেয় এবং সেলিম জাহাঙ্গীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ব্যান্ডেজ তুলে নিয়ে ক্ষতস্থানে পুনরায় ছোরা ঢুকিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। যার ফলে সেলিম জাহাঙ্গীরের প্লিহা, ফুসফুস ও যকৃত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। অতঃপর স্থানীয় লোকজন তাঁদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। ডাক্তারগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করে সেলিমকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। শিবিরকর্মীরা প্রিয় নেতাকে বাঁচানোর জন্য একের পর এক রক্ত দিতে থাকে। দুইবার অপারেশন ও প্রচুর রক্ত দেয়ার পরও কোনো ফল হলো না। হাসপাতালে চারদিন ছিলেন তিনি। তারপর ১৯৮৬ সালের ৪ জুন বেলা ১১টায় তিনি শাহাদাত বরণ করেন এবং তাঁর বন্ধুর সান্নিধ্যে চলে যান।

শহীদের বিদায়
সেলিম জাহাঙ্গীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পর শত শত শোকার্ত সাথী ও আত্মীয়স্বজনের আর্তনাদে সেদিন হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। দুপুর বেলায় লালদীঘি ময়দানের বিশাল জানাজার নামাজ অনুষ্ঠানের পর শহীদের কফিন নিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আবু তাহেরসহ শিবিরের নেতাকর্মীরা ফটিকছড়ির বাবু নগরে শহীদের নিজ বাড়িতে যান। সেখানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে পুনরায় জানাজার নামাজের পর বাড়ির সম্মুখস্থ মসজিদ সংলগ্ন পুকুরের পশ্চিম প্রান্তে তাঁকে দাফন করা হয়।

পিতার বক্তব্য
‘আমার ছেলে ইসলামের জন্য জীবন দিয়েছে। আমার কোনো আফসোস নেই। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা সবাই আমার ছেলে। আপনারা ইসলামের জন্য কুরবানি আর লড়াই অব্যাহত রাখবেন। সেলিম জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে ইসলামী আন্দোলনের কাজ থেমে থাকবে না বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাবে এ আন্দোলনের কাজ। আপনারা ইসলামী আন্দোলনের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করুন। কাপুরুষের মত মৃত্যুবরণ করে লাভ নেই, শাহাদতের মৃত্যুই হচ্ছে উৎকৃষ্ট পথ।’

শহীদের মায়ের প্রত্যাশা
শহীদ হওয়ার পর তাঁর মা বলেন, ‘যে ইসলাম ও ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আমার কলিজার টুকরা জীবন দিয়েছে, সে ইসলাম সেই শিবির যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। শিবিরের দায়িত্বশীলরা যেন আরও দায়িত্ববান হয়ে আমার পুত্র ও অন্যান্য শহীদদের রক্তদানকে সার্থক করে। শহীদের মা হিসেবে আমি গর্ব করি।’

একনজরে শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর
নাম : সেলিম জাহাঙ্গীর
মায়ের নাম : সাজেদা বেগম
বাবার নাম : আবুল হাশেম চৌধুরী
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- বাবুনগর, থানা- ফটিকছড়ি, জেলা- চট্টগ্রাম
ভাই-বোন : ৫ ভাই, ২ বোন
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান : তৃতীয়
পরিবারের মোট সদস্য : ৯ জন
সাংগঠনিক মান : কর্মী
পড়াশোনা : বি.এ দ্বিতীয় বর্ষ
কৃতিত্ব : এসএসসি ৪টি লেটারসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ, অষ্টম এবং পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ
আহত হওয়ার স্থান : ফটিকছড়ি ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাস
আঘাতের ধরন : বুকের বাম পাশে ছুরির আঘাত। অতঃপর কিরিচ ও রামদা দ্বারা রগ ও শিরা কর্তন
যাদের আঘাতে শহীদ : রক্তপিপাসু ছাত্রলীগ
শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
শাহাদাতের তারিখ : ৪ জানুয়ারি, ১৯৮৬

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর

পিতা

আবুল হাশেম চৌধুরী

মাতা

সাজেদা বেগম

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৯ জন

স্থায়ী ঠিকানা

ফটিকছড়ির বাবুনগর গ্রামে

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

বি.এ, নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজ

শাহাদাতের স্থান

ফটিকছড়ি


শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর

ছবি অ্যালবাম: শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর


শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর

ছবি অ্যালবাম: শহীদ সেলিম জাহাঙ্গীর