শহীদ আব্দুল জব্বার

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২৮ ডিসেম্বর ১৯৮২ | ৪

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

এ দুনিয়ার বুকে আল্লাহর কালিমাকে বিজয়ী করার জন্য যুগে যুগে কিছু মানুষ নিজেদের প্রাণ অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট এই দেশ বাংলাদেশেও এমন মানুষেরা ছিলেন, আছেন। শহীদি কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কিছু ত্যাগী প্রাণ সবুজ-শ্যামল এই জমিনে ইসলামের সুমহান আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। তাঁদের মধ্যে শহীদ আব্দুল জব্বার এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের চতুর্থ শহীদ।

ব্যক্তিগত পরিচয় ও শিক্ষাজীবন
তিনি নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানার চকময়রাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো: জমির উদ্দিন। আব্দুল জব্বারের ভাই-বোন ছিল ৬ জন। ভাই-বোনদের মাঝে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি চকময়রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন চকময়রাম উচ্চবিদ্যালয় থেকে। এরপর নওগাঁ নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তারপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। শাহাদাতের সময়ে তিনি রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক মানের দিক দিয়ে তিনি একজন কর্মী ছিলেন।

১৯৮২ সালের ১১ মার্চ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এ দিনটি হতে পারতো একটি প্রাণোচ্ছল দিন। এ দিন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত ছাত্রদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। সংবর্ধনায় যোগদানের জন্য নবাগত ছাত্রদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। নবীন ছাত্রদের হৃদয়ের মণিকোঠায় ইসলাম ও ইসলামী আদর্শের বিজয় মেনে নেয়ার মতো পাত্র ছিল না ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী ও ছাত্র ইউনিয়নের দুর্বৃত্তরা। কিন্তু নৈতিক শক্তি ও জনসমর্থনে দুর্বল এসব সংগঠন আদর্শিকভাবে ছাত্রশিবিরের মোকাবেলা করতে সাহস পাচ্ছিল না। ওদিকে বসে থাকার মতো ধৈর্যও তাদের ছিল না। মরণকামড় বসাতে হবে ছাত্রশিবিরের ওপর। তাই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালায় ছাত্রশিবিরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। মুহূর্তের মধ্যে হাসি আর আনন্দের পরিবর্তে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় পুরো ক্যাম্পাস। গুলি, বোমা, চাপাতি প্রভৃতি দিয়ে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর চললো সভ্যতার নৃশংসতম বর্বরতা। মুহূর্তেই থেমে গেল কয়েকটি তাজা প্রাণ। সেদিন দুর্বৃত্তদের আক্রমণের শিকার হয়ে অনেকে দীর্ঘদিন যাবৎ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আব্দুল জব্বার তাঁদের একজন। ১১ মার্চ, ১৯৮২; ছাত্রলীগ, ছাত্র মৈত্রীর সন্ত্রাসীরা তাঁর বুকের পাঁজরগুলো মর্মান্তিকভাবে থেঁতলে দেয়। অনেকদিন ধরে চিকিৎসা করালেও পৃথিবীতে এমন কোনো চিকিৎসক ছিলেন না যিনি তাঁকে আগের মতো সুস্থ করে দিতে পারেন।

দেশের প্রখ্যাত সব চিকিৎসক ব্যর্থ হলেন আব্দুল জব্বারের চিকিৎসায়। আহত আব্দুল জব্বার অসহ্য ব্যথার দরুন পরবর্তীতে আর কোনো পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। শেষে মায়ের ছেলে মায়ের কোলেই প্রত্যাবর্তন করেন। আল্লাহর কাছে যাঁর জন্য উত্তম আবাসস্থলের ব্যবস্থা রয়েছে, ক্ষণিকের এই পৃথিবীর মায়া তাঁকে ধরে রাখতে পারে না। তেমনি আব্দুল জব্বারকেও ধরে রাখা যায়নি। মায়ের স্নেহ, বাবার ভালোবাসা, পরিবারের বন্ধন, জগতের মায়া সব কিছু ছিন্ন করে ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৮২ সালে আব্দুল জব্বার পৌঁছে যান তাঁর পরম প্রভুর দরবারে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন)।

সাংগঠনিক জীবন
শহীদ আব্দুল জব্বার ছেলেবেলায় সংগঠনের সাথে পরিচিত ছিলেন না। তিনি নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে থাকাকালে আওয়ামী ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং নামাজের প্রতি খুবই যত্নশীল ছিলেন। শহীদ আব্দুল জব্বারের আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল সেটা বোঝা যেত তাঁর উঠা-বসা ও চলাফেরার মাধ্যমে। নামাজ অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন এবং মসজিদে অবস্থান করতেন। বিভিন্ন সময়ে আলাপ-আলোচনার মধ্যে আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যেত। যদিও তিনি তখন আওয়ামী ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলেন। তিনি সব সময় সমাজের দুস্থ মানুষের কথা বলতেন এবং বেশ চিন্তাভাবনা করতেন আর বলতেন, এই সমাজ পরিবর্তনের জন্য একদল কর্মীবাহিনীর দরকার যারা করতে পারে এই সমাজের পরিবর্তন। তিনি প্রায়ই একটি প্রবাদ বলতেন, ‘পৃথিবীটা বড় কঠিন, পৃথিবীকে জানা খুব কষ্ট এবং পৃথিবীর মানুষকে চেনা খুব কঠিন।’

শহীদ আব্দুল জব্বার ১৯৮০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। প্রথমে তিনি রানীনগর হামিদ বাড়ির একটি মেসে অবস্থান করতেন। পরবর্তীতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আব্দুল খালেকের আহবানে আমীর আলী হলের ১১৭ নম্বর কক্ষে তাঁর বন্ধুর সাথে অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর বন্ধু আগেই সংগঠনের দাওয়াত পেয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছায়াতলে চলে আসেন। শহীদ আব্দুল জব্বার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অবস্থায়ও প্রথমদিকে ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তাঁর বন্ধু আব্দুল খালেক সংগঠনের সাথে জড়িত হলেও তাদের মাঝে সম্পর্কের তেমন কোনো অবনতি হয়নি। আব্দুল খালেকের রুমে থাকা অবস্থায় কোনো দিন তিনি তাঁকে শিবিরের কথা বলেননি। হলে আসার পর অন্য কর্মীদের ব্যবহারের ফলে শিবিরের পতাকাতলে আসেন আব্দুল জব্বার।

তারপর তিনি বলতেন, ‘আমি অনেক আগে থেকে এ ধরনের সংগঠনের কথা চিন্তা করতাম, যারা পারবে সমাজের কুসংস্কারপূর্ণ কাঠামোর পরিবর্তন করে একটি আদর্শবাদী নতুন সমাজ গড়তে। শিবিরের ভেতর এ ধরনের গুণাবলীসম্পন্ন কর্মীবাহিনী দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।’ যে ছেলেটি এতদিন শিবিরের কথা শুনতে পারতেন না, সে-ই বলতে লাগলেন, এতদিন শিবির থেকে দূরে থেকে বড় ভুল করেছি। সংগঠনে আসার পর থেকে তিনি এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে, সবার চোখে তিনি অনুপ্রেরণার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি কয়েক মাসের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে সক্ষম হন। তিনি সবার সাথে বন্ধুসুলভ ভালোবাসা গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মাঝে যে বৈশিষ্ট্যটি বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছিল সেটা হচ্ছে নেতৃত্বের প্রতি চরম আনুগত্য ও পরস্পরের প্রতি উদার ও বন্ধুত্বসুলভ আচরণ।

তিনি সংগঠন এবং সংগঠনের ভাইদের এত ভালোবাসতেন যে, তাঁর ব্যবহারের মাধ্যমে তা ফুটে উঠতো। তবে সেটা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতেই অকালে ঝরে পড়লেন তিনি। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ একদল উগ্র ও রক্তপিপাসু কুচক্রীর হাতে গুরুতর আহত হন। এই অবস্থায় তিনি প্রায় দশ মাস চরম যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটান। দশ মাসের মধ্যে তিনি প্রায় নয় মাস হলে ছিলেন এবং একমাস মাত্র বাড়িতে ছিলেন। বুকে গুরুতর আঘাত লাগার কারণে চলাফেরা করতে পারতেন না। প্রায় সময় বিছানায় শুয়ে থাকতেন। এ অবস্থায়ও তিনি বাড়ি যাননি, বাড়ি যাওয়ার কথা বললে বলতেন যে, ‘বাড়িতে আমার ভালো লাগে না, সংগঠনের ভাইদের দেখে শান্তি পাই।’ তাঁর এ কথায় বোঝা যায় সংগঠন এবং সংগঠনের ভাইয়েরা তাঁর কাছে কত আপন ছিল।

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
আজও চোখে পানি চলে আসে সেই দিনটির কথা ভেবে। দিনটি হল ১১ মার্চ, ১৯৮২। এ দিনটি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। সারাদেশে ছাত্রশিবিরের ওপর ইসলামবিরোধী শক্তি কম-বেশি যতটুকু আক্রমণ বা চড়াও হয়েছিল তাতে শাহাদাতের মত এত বড় ঘটনা আর ঘটেনি। সেইদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামবিদ্বেষী হায়েনাদের আঘাতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের চারজন ভাই শাহাদাত বরণ করেন। তাঁরা হলেন, শহীদ সাব্বির আহমদ, শহীদ আব্দুল হামিদ, শহীদ আইয়ুব আলী ও শহীদ আব্দুল জব্বার।

মার্ক্সবাদ আর কমিউনিজমের নামে রাজনীতির কেন্দ্র ছিল রাজশাহীর মতিহার চত্বর। সত্য আদর্শের পতাকাবাহী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল ১৯৭৭ সালের পর থেকেই। বাতিল আদর্শবাদী শক্তি চেয়েছিল ইসলামের এই পতাকাবাহীদের চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দিতে। কিন্তু তারা জানত না এ দল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) আদর্শের দল। এ দলকে কোনোদিন থামানো যাবে না।

১১ মার্চ, বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নবাগত সংবর্ধনা। আগে থেকেই এ অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য প্রচারকার্য চলছে। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের দুষ্কৃতিকারীরা হেলালের নেতৃত্বে বাধা দেয় এবং প্রচারপত্র কেড়ে নেয়। প্রোগ্রামকে বাস্তবায়ন করার স্বার্থে শিবিরকর্মীরা ঘটনা সম্পূর্ণ এড়িয়ে অসীম ধৈর্যের পরিচয় দেন। কিন্তু দুষ্কৃতিকারীরা তাদের ষড়যন্ত্র থেকে পিছু হটেনি বরং শিবিরের রক্তে মতিহারকে রঞ্জিত করার নীলনকশা করে। নবাগত সংবর্ধনার দিন সকাল থেকেই শত শত সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও শিবিরকর্মী প্রোগ্রাম স্থলে ছুটে আসে।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির আজ পৌঁছাবে তাদের আদর্শের কথা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র-জনতা, শিক্ষক ও কর্মচারীর কর্ণকুহরে। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ অন্যান্য সংগঠনের সমন্বয়ে তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশে অবস্থান করতে থাকে এবং সংঘর্ষ বাধানোর চেষ্টা চালাতে থাকে। তবুও শিবিরকর্মীরা সকল হাঙ্গামা এড়িয়ে সুষ্ঠুভাবে তাদের প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে থাকেন। ইতোমধ্যেই কয়েকটি বাস বোঝাই করে পাঁচ-ছয় শত বহিরাগত গুণ্ডা এসে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করল। কাল বিলম্ব না করে, যৌথভাবে সন্ত্রাসীরা প্রথমে কেন্দ্রীয় মসজিদের গেটের সামনে উপস্থিত শিবিরকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। পরবর্তীতে তারা প্রোগ্রামস্থলের দিকে এগোতে থাকে। প্রোগ্রামস্থল তারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং নিরস্ত্র শিবিরকর্মীদের ওপর সশস্ত্র ক্যাডাররা নির্মমভাবে আক্রমণ চালায়।

প্রোগ্রাম পণ্ড হল এবং গোটা ক্যাম্পাসে মাতম উঠল। মতিহারের সবুজ চত্বর ভিজলো শিবিরকর্মীদের তাজা রক্তে। অনেকেই প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে চললেন চারদিকে। কেউ কেউ আত্মরক্ষার জন্য মেইন গেটের কাছে বিএনসিসি ভবনে ঢুকে পড়লেন এবং দরজা বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু দরজা বন্ধ করেও তাঁরা নরপশুদের অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারলেন না। নরপশুরা দরজা ভেঙে বিএনসিসি ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং বেধড়ক ছুরিকাঘাত, লোহার রড আর হকিস্টিক দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পাষণ্ডরা গোটা বিএনসিসি অফিস কসাইখানায় পরিণত করল। রক্তের ছোপ টেবিল, চেয়ার, মেঝে এবং দেয়ালে লাগল। মাথার নিচে ইট রেখে আরেকটা ইট দিয়ে শিবিরনেতা আব্দুল হামিদের মাথাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করল। আহত হলেন শিবিরের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। পুলিশ প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই ছিল। কিন্তু ‘কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেই’ এই অজুহাতে তারা হামলাকারীদের প্রতিহত করতে আসেনি।

এ হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হন সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার ভাই। তাঁদেরকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই লোমহর্ষক ঘটনার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আহতদের আত্মীয়-স্বজন হাসপাতালে এসে ভিড় জমান। এদিকে সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব হাসপাতালে শাহাদাত বরণ করেন। অন্য আহত ভাইয়েরা অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু আব্দুল জব্বার তখনও সুস্থ হয়ে উঠতে পারলেন না। তিনি সামান্য হাঁটাহাঁটি ও প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারলেও সর্বদা ক্ষত স্থানের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে থাকতেন। কিন্তু এভাবে আর কতকাল? তিনি আর বেশি দিন পৃথিবীর বুকে অবস্থান করলেন না। অবশেষে দীর্ঘ ১০ মাস যন্ত্রণা ভোগের পর ২৮ ডিসেম্বর তাঁর নিজ বাড়িতে ১১টা ৪০ মিনিটে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন এবং মহান পালনকর্তার সান্নিধ্যে হাজির হলেন। জান্নাতের পথে পা রাখলেন শহীদ আব্দুল জব্বার।

শহীদ আব্দুল জব্বারের আহত অবস্থার একটি স্মরণীয় ঘটনা
আহত অবস্থায় হলে থাকাকালে তাঁর বন্ধু আব্দুল খালেক তাঁর দেখাশোনা করতেন। একদিন তাঁর বন্ধু সংগঠনের কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। তিনি রুমে এসে দেখেন আব্দুল জব্বার রুমে নেই। রুমের এক বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করা হলো আব্দুল জব্বার কোথায়? তিনি জবাব দিলেন, আব্দুল জব্বারকে কিছুক্ষণ আগে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তাঁর বুকের ব্যথার কারণে চলাফেরা করতে পারত না, তাই সবাই উদ্বিগ্ন। বন্ধু খালেক ও আরো কয়েকজনে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। কোথাও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তখন রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। তারা খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে মসজিদে গেলেন এবং দেখতে পেলেন অন্ধকারের ভেতর মসজিদের এককোণে দুই হাত তুলে বসে ক্রন্দন করছেন তিনি। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছেন এই বলে, ‘হে আল্লাহ! আমি তো অপরাধ করিনি, আমি তো কারো ক্ষতি করিনি, কেন তারা আমার এ অবস্থা করলো? না, আমার অপরাধ আমি ঈমান এনেছি এবং ইসলামী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছি। হে আল্লাহ! তুমি এই সংগঠনকে শক্তিশালী কর। তুমি এই জমিনে তোমার দ্বীনকে বিজয়ী করে দাও এটাই আমার কামনা আর এটাই বাসনা।’ এই ঘটনা থেকে বুঝা যায় তিনি দ্বীনকে কতটা ভালোভাবে বুঝেছিলেন এবং দ্বীনের প্রতি তাঁর কতটা ভালোবাসা।

আর একদিনের ঘটনা, শহীদ আব্দুল জব্বার বুকের ব্যথায় ছটফট করছেন, তখন তাঁকে তাঁর বন্ধু বললেন, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? তখন তিনি উত্তর দেন, কষ্ট নারে কষ্ট না, এই তো আমার আত্মতৃপ্তি। আমার আত্মতৃপ্তি এই জন্য যে, আমি মহান পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি। ইসলামের দুশমনরা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এতো আমার চাওয়া, এতো আমার পাওয়া। শাহাদাত মুুমিন জীবনের কাম্য, তাইতো আমার কামনা, আমার বাসনা ছিল। এইভাবে কঠিন যন্ত্রণার মাঝে জীবন অতিবাহিত হতে থাকে, কিন্তু কোনো দিন তাঁর মাঝে কোনো হতাশা দেখা যায়নি। শহীদ আব্দুল জব্বার ভাই সকল ইসলামী কর্মী ভাইয়ের আদর্শের প্রতীক হয়ে আছেন।

জানাজা ও দাফন
পরিবারের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল আব্দুল জব্বারের বিয়োগব্যথায় চকময়রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। শাহাদাতের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে রাজশাহী ও নওগাঁর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহীদের সাথীরা এবং শোকাভিভূত জনতা শহীদের বাড়িতে এসে ভিড় করে। সেখানে জানাজা নামাজ শেষে চকময়রামপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে আব্দুল জব্বারকে দাফন করা হয়।

শহীদ হওয়ার পূর্বে তাঁর স্মরণীয় বাণী
ইসলামী আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আবদুল মালেক সমাজের পরিবর্তন নিয়ে ভাবতেন। অন্যায় এবং কুসংস্কারপূর্ণ সমাজকে কিভাবে পরিবর্তন করা যায় সেই ভাবনায়-ই লিপ্ত থাকতেন। আর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল তারুণ্যনির্ভর দল বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরই এ ঘুণে ধরা সমাজে পরিবর্তন আনতে পারবে। শহীদ আব্দুল জব্বার কবি নজরুলের “আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়.....” এই গানটি বেশি গাইতেন। বন্ধুরা তাঁকে এই গান গাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, ‘আর কতদিন বাঁচবো! কখন যে ঝরে পড়ব কেউ জানে না।’

পারিবারিক কাজে সহযোগিতায় আব্দুল জব্বার
শহীদ আব্দুল জব্বারের পরিবারের প্রধান পেশা ছিল কৃষি। তিনি পড়াশোনায় যেমন নিয়মিত ছিলেন, তেমনি পরিবারের সকল কাজে সাহায্য করতেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি এলে নিজ হাতে শাক-সবজির চাষ করতেন। পারিবারিক কৃষিকাজে কৃষকদের সাথে কাজ করতেন, আর প্রচুর মাছ ধরতেন।

ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে শহীদ আব্দুল জব্বারের চিঠি
Dear জাফর,
স্নেহাশিস রইলো। আশা করি তোমরা ভালোই আছো। তোমাদের ভর্তির নোটিশ রাবি দিয়েছে। তুমি তোমার কাগজপত্র তৈরি করে এবং টাকা-পয়সা নিয়ে আসবে অথবা খুব তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিবে। আর তুমি যে বিষয়ে ভর্তি হইবে তা ঠিক করিয়া আসিও। ৫-১২-১৯৮১ তারিখ পর্যন্ত দরখাস্ত জমা দেয়ার শেষ তারিখ। এই মাসের মধ্যে জমা দিলে বেশি বেগ পাইতে হইবে না। আর জিল্লু কোথায় এবং কী বিভাগে ভর্তি হইতেছে জানাইও। আর বাড়িতে থেকে তোমার পড়ার প্রতি মন আসে না, তাই না? ভালো করে পড়িও এবং এই বৎসর প্রতিযোগিতা হইবে। জাহানারার পড়ার প্রতি তুমি নজর রাখিও। তার পড়াশুনা কেমন হচ্ছে এবং জাহাঙ্গীরের পরীক্ষা কবে? দৈনিক বার্তায় এই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এই সংবাদ রাশিদুলকে দিবে কেমন? আমি আমার একটা ঋৎরবহফ-এর নিকট আমীর আলী হলের ১১৭ নম্বর রুমে অবস্থান করছি। আমার এই ঠিকানায় পত্র পাঠাইও। আবাদ এবং বাড়ির পরিবেশ কেমন জানাইও। মা-আব্বা এবং স্যারকে আমার সালাম দিবে এবং ছোটদের প্রতি রইলো স্নেহাশিস। সবার প্রতি রহিল সালাম। দোয়া কামনা করে শেষ করছি।
ইতি
মো: আ: জব্বার
১১৭, সৈয়দ আমীর আলী হল, রাবি
(বি: দ্র: আমার জন্য এই মাসে টাকা না পাঠাইলে পত্র পাওয়া মাত্র টাকা পাঠাইও। পরীক্ষার জন্য ডিজাইন এবং জামা তৈরি করা হইতেছে না। জাহানারার একটা বড় এবং ভালো সাইজের কামিসের মাপ পাঠাও। নানী কেমন আছে জানাইও।)

শাহাদাতের পর শহীদের পিতার প্রতিক্রিয়া
শহীদ আব্দুল জব্বারের পিতা মো: জমির উদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও আল্লাহভীরু মানুষ। তাই তিনি পুত্রকে হারিয়ে ধৈর্যহীন না হয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে ইসলামের পথে শহীদ হয়েছে এতে আমার কোন দুঃখ নেই। আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ যেন তাঁকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নেন।’ পরবর্তীতে শোকাহত বাবা পুত্রশোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিনি প্যারালাইজড হয়ে যান। অবশেষে পুত্রশোকে তিনিও পরলোকগমন করেন।

মায়ের প্রতিক্রিয়া
বড় ছেলের শাহাদাত বরণের সাথে সাথে শহীদ জননী সকিনা বিবি কান্না শুরু করে দেন। অনেক কষ্টে তিনি ধৈর্য ধারণ করেন। আল্লাহর কাছে তিনি দোয়া করেন তিনি যেন তাঁকে একজন শহীদ হিসেবে কবুল করে নেন।

ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া
শহীদ আব্দুল জব্বারের ছোটভাই জিল্লুর রহমান বলেন, সংগঠনের নেতাকর্মীরা যেন ইসলামী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সজাগ থাকে। এমন কোনো কাজ করা ঠিক নয় যা সংগঠনের সুনাম ক্ষুণ্ণ করবে।

দীর্ঘ চৌদ্দ’শ বছর আগে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মাধ্যমে হেরা গুহায় যে জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়েছিল, সেই জ্যোতিকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য সেইদিন থেকেই অপচেষ্টা চলছে। কিন্তু ইসলামের ত্যাগী কিছু সৈনিকের কারণে সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এতে প্রাণ দিতে হয়েছে অনেককেই। শহীদ আব্দুল জব্বার তাঁদের অন্যতম। তিনি ইসলামের জন্য প্রাণ দিয়ে আমাদের অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়ে আছেন। আমরা তাঁর কাছ থেকে অনেক উৎসাহ পেতে পারি।

একনজরে শহীদ আব্দুল জব্বার
নাম : মো: আব্দুল জব্বার
পিতার নাম : মো: জমির উদ্দিন
মায়ের নাম : সকিনা বিবি
পড়াশোনা : রসায়ন বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের লক্ষ্য : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া
সাংগঠনিক মান : কর্মী
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- চকময়রাম, ডাকঘর- ধামইরহাট, থানা- ধামইরহাট, জেলা- নওগাঁ
শাহাদাতের পূর্বে অবস্থান : ১১৭, সৈয়দ আমীর আলী হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আহত হওয়ার স্থান : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের অজুখানা

 

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আব্দুল জব্বার

পিতা

মোঃ জমির উদ্দিন

মাতা

সকিনা বিবি

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৮ জন

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম- চকময়রাম, ডাকঘর- ধামইরহাট, থানা- ধামইরহাট, জেলা- নওগাঁ

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

রসায়ন বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

১১৭, সৈয়দ আমীর আলী হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে হাসপাতাল


শহীদ আব্দুল জব্বার

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল জব্বার


শহীদ আব্দুল জব্বার

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল জব্বার