বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ ২০২৩

"আহলান সাহলান মাহে রমাদান"

মাহে রমাদান। মুসলমানদের জন্য এক পবিত্র মাস। বছর ঘুরে রহমত বরকত আর মাগফিরাতের বার্তা নিয়ে হাজির হয় এই মাসটি। এই মাসের প্রসঙ্গে মহান রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন -
“রমাদান মাস, এ মাসে অবতীর্ণ হয়েছে আল-কুরআন— যা মানুষের জন্য সৎ পথের দিশারি, সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম সাধনা করে।” (সূরা বাকারা : ১৮৫)

অন্যত্র তিনি বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য সিয়ামকে ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (সূরা বাকারা : ১৮৩)

দেখুন, আল্লাহ রব্বুল আলামিন কী উদ্দেশ্যে রমাদান মাসের রোজাকে ফরজ করেছেন? উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা।

এখন আসুন দেখি, তাকওয়া কী? তাকওয়া শব্দের অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, ভয় করা, নিজেকে রক্ষা করা। শার'ঈ পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার ভয়ে যাবতীয় অন্যায়, অপরাধ ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলা হয়। অন্যকথায় সকল প্রকার পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করাকে তাকওয়া বলা হয়।

সম্ভবত তাকওয়ার সবচেয়ে সুন্দর সংজ্ঞাটা দিয়েছেন উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহিমাহুল্লাহ। তিনি বলেন, রাত-জেগে সালাত পড়া আর দিনভর সাওম আদায় করার পর হালাল হারামকে মিশিয়ে ফেলার নাম তাক্বওয়া নয়। তাক্বওয়া হলো, আল্লাহর আবশ্যকীয় বিধান মেনে-চলা এবং তার নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে বেঁচে থাকা। এর পাশাপাশি কোনো (নেক) আমল করলে, সেটা তো আরও ভালো।

যিনি তাকওয়া অবলম্বন করেন তাঁকে বলা হয় মুত্তাকি। আর রমাদান আসেই মানুষকে মুত্তাকি বানাতে। যার কারণেই মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাঁর বান্দাদের জন্য এই মাসে নাজিল করেছেন আল-কুরআন। দিয়েছেন এই মাসে অবারিত রহমত ও বরকত। এবং এই মাসেই রেখেছেন হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ একটি রাত। যাকে আমরা লাইলাতুল কদর নামে আমরা চিনি। পবিত্র কুরআনুল কারিম আমাদেরকে জানাচ্ছে - لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَہۡرٍ অর্থাৎ,
‘লাইলাতুল-কদর’ হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম। ( সূরা কদর : ০৩)

এই মাসের ইবাদাতে রেখেছেন অন্যান্য মাসের চাইতে দ্বিগুণ তিগুণ নয়, সত্তর থেকে সাতশোগুণ বেশি সাওয়াব। দু'আ কবুলের সুমহান সুযোগগুলো সবচেয়ে বেশি রাখা হয়েছে এ মাসেই। এ মাসের প্রতিটি ক্ষণই দু'আ কবুলের সময়। গুনাহ মাফ করে নিষ্কলুষ, নিষ্পাপ আর পবিত্র হয়ে যাবার সবচেয়ে সেরা মাস হলো এই রমাদান। বিশ্বাসী আত্মাগুলোর জন্য এক সুবিশাল সুবর্ণ সুযোগ সিয়ামের মাস রমাদান।

এই সিয়াম-সাধনার মাহে রমাদানকে কেউ কাজে লাগায় পূর্ণরূপে। দিনের বেলায় সিয়াম সাধনায় আর রাতের বেলায় ক্বিয়ামুল্লাইলের মাধ্যমে তাকওয়ার পারদটা তাদের আরো উপরে ওঠে। আল্লাহর রঙে জীবনকে করে তোলে তারা রঞ্জিত। বিপরীতে কেউ থেকে যায় দূর্ভাগা ও হতভাগা। এমন হতভাগা —স্বয়ং জিব্রাইল (আ.) এবং নবি করিম (সা.) এর অভিশাপে অভিশপ্ত তারা! একজন মুসলিমের জন্য এরচেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে, ভাবতে পারেন?

এই যে পৃথিবীর বুকজুড়ে রমাদান আসে রমাদান যায়। আমাদের অধিকাংশ লোকের এবং যারা ইসলামের সুমহান বাণী মানুষের কর্ণকুহরে পৌঁছিয়ে দেয়, তাদেরও আদত-অভ্যাস, আচার-আচরণ, ঈমান-ইয়াক্বিনের কোনো পরিবর্তন আসে কি? এই আত্ম-জিজ্ঞাসাটা আমাদের প্রত্যেক মুমিনের করা উচিৎ।

রমাদান তো চায়-ই মূলত বিশ্বাসী চেতনায় পরিবর্তনের ফল্গুধারা বইয়ে দিতে। সংযমের মাধ্যমে মানুষের ভোগবাদী চেতনাকে ঝলসে দিতে। গর্ব-অহংকার, হিংসা-হীনমন্যতা, অন্যায়-অমানবিকতা ও জুলম-অপবাদের শিকড় কেটে উপড়ে ফেলতে। আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার রাশ টেনে ধরে সামষ্টিক-উম্মাহ কেন্দ্রিক চিন্তার বিকাশ ঘটাতে।

মূলত রমাদান হলো মুমিনদের জন্য এক প্রশিক্ষণের মাস। রমাদানে সারা দুনিয়ার মুসলমানগণ আল্লাহর দেওয়া বিধানের যেভাবে পরিপূর্ণ অনুসরণ করে, সময়কে যেরকম সচেতনভাবে ব্যবহার করে, সারা বছরও যদি সেভাবেই অনুসরণ করা যায়, তাহলে প্রত্যেক মুসলিম হয়ে উঠবে একজন সুশৃঙ্খল আদর্শ মুসলিম।

রমাদানে সহজতার নামে, একটু ছাড়ের নামে যেভাবে সময়ের এক মিনিট আগেও আমরা ইফতার করি না৷ আবার এক মিনিট পরেও সাহরি করি না। সেভাবেই আল্লাহর বিধানের পরিপূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে আমাদের বাকি এগারোটি মাসও পরিচালিত হোক, তাহলেই আমাদের জন্য রমাদানের সিয়াম সাধন সার্থক হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করবে; তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে’ (সহীহ্ বুখারি : ৩৪)।

ধুলোজমা পত্র-পল্লব, রোদ্রের উত্তাপে মলিন হয়ে যাওয়া গাছগাছালির ডালপালা, গুল্ম-লতা ও পত্রপল্লব বৃষ্টির পর যেভাবে আপন রূপ-রস-রঙ-গন্ধ ফিরে পেয়ে সতেজ আর সজীব হয়ে উঠে। তদ্রূপ রমাদানটাও আমাদের পাপের ভারে মলিন হয়ে যাওয়া জীবনটাকে, রমাদানের সিয়াম-কিয়াম, ইবাদাত-বান্দেগির মাধ্যমে আমাদের জীবনের পাপের সকল মলিনতা, আমাদের সকল কদর্যতা দূর আমাদের ঈমানের পত্রপল্লবকে সবুজ সতেজ করে দিক। রমাদান শেষে আমরা যেনো পরিপূর্ণ এক সতেজ আর সজীব ঈমানের অধিকারী হয়ে উঠি। রমাদানের শিক্ষাটা কাজে লাগিয়ে আমরা যেনো জুলুমমুক্ত আদালত ও ইনসাফের পৃথিবী গড়তে পারি। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন।

কবি ও গীতিকার শ্রদ্ধেয় নুরুজ্জামান শাহের লেখা গানের কথা অনুযায়ী আমরাও বলে উঠি-
কান পেতে শোনো গায় সাত আসমান
খোশ আমদেদ এলো রমাদান!

সকলকে জানাই মাহে রমাদানের শুভেচ্ছা।