সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭

রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনায় প্রয়োজন নৈতিকতাসম্পন্ন, দক্ষ ও পেশাগত নেতৃত্ব

নেতৃত্ব একটি শিল্প। সমাজের প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথে নেতৃত্বের সম্পর্ক ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। দক্ষ এবং নৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া সুন্দর সমাজ পরিচালনা দুরূহ ব্যাপার। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, বাণিজ্যিক এবং পেশাগতসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সমভাবে সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নেতৃত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ Leadership (লিডারশিপ)। ইংরেজি ‘‘Lead’’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘‘To guide, conduct, Direct and Precede’’ অর্থাৎ পথ প্রদর্শন করা, চালনা করা, নির্দেশ দেয়া ও অনুগামী হওয়া। নেতা হলেন যিনি একদল মানুষকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিচালনা করেন। তাই Leadershipবা নেতৃত্ব বলতে পথপ্রদর্শন বা পরিচালনার কলাকৌশলকে বোঝায়। Napoleon Bonaparte এর মতে “A leader is dealer of hope” দক্ষ নেতৃত্ব মানেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বোপরি একটি দেশ বা জাতি হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা অর্জন করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অদক্ষ, আনাড়ি।

নেতৃত্বের ব্যাপারে যে কথাটি আসে তা হলো, ‘মানুষ পরিচালনা করা’। এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে মানুষকে পরিচালনা করবেন? মানুষ পরিচালনার পাঁচটি উপায় আছে-

মানুষকে প্রলুব্ধ করার মাধ্যমে : ব্যক্তির অবস্থান, অর্থ-সম্পদ, পরকালীন মুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে প্রলুব্ধ করা যায়।

ভীতি প্রদর্শন করে : মানুষকে ভয় দেখিয়ে কিংবা হুমকি দিয়ে তাদের ওপর নেতৃত্ব ফলানো সম্ভব। যেমন, কেউ বলতে পারেন, আপনি যদি আমার নির্দেশিত কাজটি না করেন তাহলে আপনাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। এটা ঠিক, মানুষ হুমকির মুখে বাধ্য হয়ে কারো পক্ষে কাজ করে থাকে।

বক্তৃতা দেয়ার মাধ্যমে : কারো যদি আকর্ষণীয় বক্তব্য দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করার যোগ্যতা থাকে তাহলে তারা নেতৃত্ব দিতে অনেক বেশি সক্ষম।
মানুষকে প্ররোচিত করার যোগ্যতা দিয়ে : নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এই যোগ্যতাটি অনেক বেশি কার্যকর এবং অনেক বেশি স্থায়ী।

অনুসরণের জন্য আদর্শ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে : মানুষের মাঝে নিজেকে অনুসরণ এবং অনুকরণের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব।

নৈতিকতা
নৈতিকতা হচ্ছে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ। যেমন কেউ সততাকে মূল্য দেয়। যেকোনো মূল্যে সততা ধরে রাখতে চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে সততা হচ্ছে তার নৈতিকতা। একতা ধরে রাখাকে যে গুরুত্ব দেয়, একতা ও ঐক্য হচ্ছে তার নৈতিকতা। ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নৈতিকতা নেতৃত্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই নৈতিকতা সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া এবং কার্যপদ্ধতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। নৈতিকতা কোনটির চেয়ে কোনটি প্রাধান্য পাবে তা ঠিক করতে হবে। তা না হলে সঠিক পথ পাওয়া যাবে না; বরং পথ হারাতে হবে। যেমন ঐক্য আর ন্যায়পরায়ণতার মাঝে যদি ন্যায়পরায়ণতাকে প্রাধান্য দেয়া না হয়, তবে ভুল সিদ্ধান্ত এবং ভুল কার্যকলাপে জড়িত হওয়া অবধারিত।

নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নৈতিকতা
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে নৈতিকতা : ন্যায়বিচার না করলে ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না। আর ঐক্য না থাকলে লক্ষ্য অর্জনও সম্ভব হবে না। তাই ন্যায়বিচারকে সবসময় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে নেতৃত্বের তিনটি প্রধান দায়িত্ব লক্ষ্য অর্জন, ঐক্য বজায় রাখা এবং প্রত্যেক সদস্যের চাহিদা পূরণ হবে না।

জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে নৈতিকতা : স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য জবাবদিহিতা জরুরি। অনুসারীদের যেকোনো প্রশ্ন ও কৌতূহলের সন্তোষজনক জবাব দিতে হবে। শুধু তাই নয়, কী কী বিষয়ে অন্যদের জানার আগ্রহ থাকে সেসব বিষয় নির্ধারণ করে তার তথ্য আগে থেকেই সবাইকে জানানোই নেতার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করবে।

সততার ক্ষেত্রে নৈতিকতা : নেতা সততা বজায় না রাখলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না; ফলে নেতৃত্বের প্রভাব থাকবে না।
স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে নৈতিকতা : কাজে কর্মে স্বচ্ছতা বজায় না রাখলে নেতার সততা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হবে। নেতার কার্যকারিতা কমে যাবে। বিশেষ করে অনুসারীদের মধ্যে পদ, দায়-দায়িত্ব ও অর্থ বণ্টনের ব্যাপারে স্বচ্ছতা জরুরি।

ঐক্যের ক্ষেত্রে নৈতিকতা : নেতাকে ঐক্যের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঐক্য নির্ভর করে লক্ষ্যের ওপর। কোনো বিশেষ লক্ষ্য অর্জনে যারা একমত হয়, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। লক্ষ্য পূরণে কাজ করলে এমনিতেই ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐক্য হচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টার স্বতঃস্ফূর্ত ফলাফল। ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আলাদাভাবে কিছু করত হয় না। তবে ঐক্য বজায় রাখার জন্য ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা হচ্ছে পূর্বশর্ত।

সহযোগিতার ক্ষেত্রে নৈতিকতা : ভালো নেতা হতে হলে পারস্পরিক সহযোগিতাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে, সহযোগিতার নীতি মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। কারণ সহযোগিতা করলে দুইজনের পক্ষেই একা কাজ করার থেকে বেশি কাজ করা সম্ভব হয়। ফলে দুইজনেই লাভবান হন।

শৃঙ্খলাবোধে নৈতিকতা : নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত জীবনের যে দিকটির দিকে নজর দেয়া হয় তা হচ্ছে তার শৃঙ্খলাবোধ। ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে আবার ঘুমোতে যাওয়ার পুরু সময়টাতেই শৃঙ্খলা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত জীবনে শৃঙ্খলা ছাড়া ভালো নেতা হওয়া অসম্ভব। বিখ্যাত মনীষী জে জে রুশো বলেছিলেন, “Man is born free, but he is chained everywhere.

উৎকর্ষতায় নৈতিকতা : যেকোনো কাজ করতে গেলে নেতাকে কাজের মানের উৎকর্ষতাকে গুরুত্ব দেয়ার নীতি গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে মানসম্মত এবং টেকসই কোনো কাজ হবে না। ফলে সমাজ, সংগঠন, দেশের সন্তোষজনক উন্নয়ন হবে না।

সময়ের সঠিক ব্যবহার : যেকোনো মানুষের জন্য সবচেয়ে সীমিত সম্পদ (Most Limited Resourse) হচ্ছে সময়। এটাকে বাড়ানোর কোনো উপায় নেই। কারো পক্ষেই একদিনকে ২৪ ঘণ্টার চেয়ে বড় করা সম্ভব না। কারো কাছ থেকে কেনা সম্ভব না, ধার করা সম্ভব না; জোর করে আনা সম্ভব না। ইমাম শাফেয়ী (রহ)-এর মতে, You don’t cut it, it will cut you.

সম্পর্কের ক্ষেত্রে নৈতিকতা : মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারলে তাকে প্রভাবিত করা যায় না। যত বেশি মানুষের সাথে সম্পর্ক গভীর হবে, তত বেশি মানুষকে প্রভাবিত করা যাবে। তাই নেতাকে মানুষে মানুষে সম্পর্ককে খুব গুরুত্ব দিতে হবে। সম্পর্ক তৈরি করা এবং তা বজায় রাখার নীতি মেনে চলতে হবে। তবে মূল্যবোধের ধারাবাহিকতায় ন্যায়পরায়ণতাকে ওপরে রাখতে হবে। কারো সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য ন্যায়পরায়ণতায় ছাড় দেয়া যাবে না।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব
দক্ষতার সাথে রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনা করতে হলে বিভিন্ন সেক্টরে যোগ্য নেতৃত্ব অপরিহার্য। একটি রাষ্ট্রের অনেকগুলো সেক্টর বিদ্যমান। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলো হচ্ছে- প্রশাসনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, বাণিজ্যিক ও পেশাগত সেক্টর।

ব্যক্তিগত নেতৃত্ব : নিজের জীবনকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার দায়িত্ব প্রত্যেকেরই নিজের কাঁধে বর্তায়। এটাই ব্যক্তিগত নেতৃত্ব। কেউই ব্যক্তিগত নেতৃত্ব থেকে মুক্ত নয়। যেসব ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে, তাদের ক্ষেত্রে বলা হয় ‘লাইফ লিড’ করছে (Leading life)। আর যাদের জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, তারা ‘জীবনযাপন’ করছে ((Leading life)। লক্ষ্য ছাড়া জীবন ঠিক মাঝি ছাড়া নৌকার মতো।

পারিবারিক নেতৃত্ব : একটি সুখী সমৃদ্ধ পরিবার গড়ে তোলার দায়িত্ব সবারই। এমনকি কেউ যদি নিজে বিয়ে করে পরিবার গঠন নাও করে, তবুও তার নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে হয়। যে পরিবারে তার জন্য জন্ম, সে পরিবারে অবশ্যই তার নেতৃত্বের দায়িত্ব রয়েছে। ছোট হোক, বড় হোক দায়িত্ব রয়েই যায়। পারিবারিক নেতৃত্ব যত সুদৃঢ় ও দক্ষ হয়, সে পরিবার ততবেশি গোছানো হয়।

পেশাগত নেতৃত্ব : পেশা হচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের উপায় ও মাধ্যম। বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন পেশা নির্ধারণ করতে হয়। যেমন- ডাক্তারি, শিক্ষকতা, প্রকৌশলী, সাংবাদিকতা ইত্যাদি। সাফল্য অর্জনের জন্য যেকোনো পেশায় নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত জীবনে নেতৃত্বের মূল প্রভাবক অত্যন্ত দৃশ্যমান। যে পেশায় যত বেশি নেতৃত্বের অনুশীলন হয়, সে পেশায় তত বেশি ফলাফল পাওয়া যায়।

সামাজিক নেতৃত্ব : সমাজে অনেক স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ হয়। এর জন্য বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে। কেউ ইচ্ছা করলে এসব সংগঠনে নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে নিতে পারে। এ ধরনের সংগঠনে কাজ করে পাওয়া নেতৃত্ব গুণ অনেক কার্যকর হয়। কারণ, এখানে নেতার প্রভাবের উৎস হচ্ছে ব্যক্তিগত চরিত্র ও দক্ষতা।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব : সমাজ পরিচালনায় আদর্শ ও নৈতিকতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ প্রয়োজন। কারণ আদর্শ রাজনীতি ছাড়া কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই অর্থে এক ধরনের সামাজিক নেতৃত্ব। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত এবং সামাজিক জীবনের নেতৃত্ব তথা লক্ষ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে।


প্রশাসনে নেতৃত্ব : প্রশাসনিক নেতৃত্ব দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যারা প্রশাসনে কাজ করেন তাদের ওপরে নিচে চারপাশে অনেক লোক কাজ করে। তাদেরকে পরিচালনা করার কাজই নেতৃত্বের দায়িত্ব, অধীনস্থদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার দায়িত্ব বাড়ে। যেমন- একজন জেলা প্রশাসককে ইউএনও বা উপজেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে যাবতীয় কাজ করিয়ে নিতে হয়। একজন জেলা প্রশাসক জেলার প্রশাসনিক নেতা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলাসহ সব ধরনের প্রশাসনিক কাজের দিকনির্দেশনার দায়িত্ব একজন জেলা প্রশাসককে বহন করতে হয়। তাই একটি জেলার সার্বিক পরিস্থিতি জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বের মানের ওপর নির্ভর করে।

ব্যবসায় নেতৃত্ব : ব্যবসায় ভালো করতে হলে, বড় ব্যবসায়ী হতে হলে নেতৃত্বের গুণাবলি খুব জরুরি। জন্মসূত্রে, পরিবার পরিবেশ থেকে দেখে, শুনে সবাই কম-বেশি নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করে বলেই নেতৃত্ব বিষয়ক পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই অনেকেই ভালো ব্যবসা করে। এরপরও এই নিয়ে পড়াশোনা করলে নেতৃত্বের মানের আরও উন্নয়ন হতে পারে এবং ব্যবসায়ও উন্নতি হতে পারে। যারা পরিবার পরিবেশ থেকে অবচেতনভাবে প্রাপ্ত নেতৃত্বের সামর্থ্য দিয়ে ব্যবসায় ভালো করতে পারে না, তাদেরকে পড়তে হবে; প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। বিশ্বের সব বিলিয়নেয়ার ধনীরা নিয়মিতই পড়াশোনা করেন। বিল গেটস সপ্তাহে অন্তত একটি বই পড়েন।

শিল্প প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব : নেতৃত্বের সামর্থ্য ছাড়া সফল শিল্পপতি বা উদ্যোক্তাও হওয়া যায় না। আমাদের যেসব শিল্পপতি প্রায় শূন্য থেকে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তারা কিন্তু শুধু উদ্যোক্তা না, ভালো নেতাও বটে। তাদের কাছ থেকেও আমরা নেতৃত্বের শিক্ষা নিতে পারি। নেতৃত্বের এই প্রাসঙ্গিকতা শুধু বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে না, ছোটখাটো শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

গবেষণায় নেতৃত্ব : গবেষক হিসেবে সফল হতে হলেও নেতৃত্বের উন্নয়নের ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। অন্য দিকে যিনি বড়সড় গবেষণা গ্রুপ পরিচালনা করছেন এবং গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে উন্নতমানের গবেষণা করিয়ে নিচ্ছেন, বুঝতে হবে তিনি ভালো নেতা। তিনি জন্মগতভাবে এবং পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নেতৃত্বের ভালো শিক্ষা পেয়েছেন। এ জন্যই আমরা দেখতে পাই, আমাদের চারপাশে যারা ভালো গবেষক তারা খুব ভালো মানুষ (ভালো নেতার প্রতিশব্দ) বলে পরিচিত মহলে সম্মানিত।

নেতৃত্বের মানোন্নয়নে প্রয়োজন :
নেতাকে জানতে হবে : জানতে হলে পড়তে হবে, Leaders are readers. অর্থাৎ নেতা মাত্রই শিক্ষার্থী। ভালো নেতা হতে হলে পড়ালেখা করতে হয়। অন্য দিকে, Readers are not necessarily leaders. পাঠক মাত্রই নেতা নয় (যদিও সবার নেতৃত্বের দায়িত্ব এবং সামর্থ্য আছে কিন্তু সবাই দায়িত্ব নেয় না এবং সামর্থ্য কাজে লাগায় না) অর্থাৎ, নেতারা বিশেষ কিছু পড়াশুনা করে বা নেতা হতে হলে বিশেষ কিছু পড়তে হয়। কী সেই বিশেষ কিছু? আরেকটি কথা আছে, ‘We become what we read. আমরা যা পড়ি তাই হই।

শুনতে হবে : নেতৃত্ব বিষয়ক বক্তব্য বা অন্য যেকোনো বক্তব্যই হোক না কেন, অফলাইনে বা অনলাইনে (ভিডিও বা অডিও) নিয়মিত লেকচার শুনতে হবে। নেতৃত্ব বিষয়ক সেমিনারে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ মানুষের দোষ গুণ যা নিয়েই আলোচনা হোক না কেন, তা থেকে কিছু শিখে নিজের গুণের উন্নয়ন করা সম্ভব।

পর্যবেক্ষণ করতে হবে : আশপাশে, বাসা বাড়িতে, অফিস আদালতে যাদের ভালো নেতা মনে হয়, তাদের ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাদের শব্দচয়ন ও বডি ল্যাংগুয়েজসহ সবকিছু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়ত খারাপ নেতাদেরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তারপর খারাপদের সাথে ভালোদের পার্থক্য খুঁজে বের করতে হবে। কী কী গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কারণে একজন ভালো আরেক জন খারাপ, তা খুঁজে বের করে ভালো গুণগুলো অর্জন আর দোষগুলো বর্জন করার চেষ্টা করতে হবে।

হাতে কলমে শিখতে হবে : প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে হাতে কলমে শিখতে হবে-

# কিভাবে লক্ষ্য স্থির করতে হয়।
# কিভাবে পরিকল্পনা করতে হয়।
# কিভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয়।
# কিভাবে উৎসাহিত করতে হয়।
# কিভাবে সৃজনশীলতা জাগিয়ে তুলতে হয়।
# কিভাবে বৈঠক করতে হয়

নেতার ক্ষমতার উৎস বা ভিত্তি
নেতৃত্ব হলো লক্ষ্য অর্জনের জন্য অধস্তনদের প্রভাবিত করার কৌশল বা প্রক্রিয়া। অন্যদিকে ক্ষমতা হলো অন্যদের আচরণকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য। একজন নেতার ক্ষমতা কতটা হবে তা যেমনি আনুষ্ঠানিক কতিপয় বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তেমনি তিনি এই আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা কতটা যোগ্যতা বা সফলতার সাথে প্রয়োগ করতে পারছেন তার ওপরও নির্ভরশীল। একজন নেতা কতটা ক্ষমতাবান হবেন তা তার ক্ষমতার বিভিন্ন উপাদান, উৎস বা ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। নিম্নো রেখাচিত্রের সাহায্যে এরূপ উৎসসমূহ দেখানো হলো :

নেতৃত্ব সমস্যা বা বাধা সৃষ্টিকারী উপকরণসমূহ
পৃথিবীর মধ্যে অত্যন্ত জটিল মানবশক্তি পরিচালনা করা। অথচ নেতৃত্ব এ জটিল উপাদান পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ক্ষেত্রে অধস্তন জনশক্তি যেমনি সমস্যার সৃষ্টি করে তেমনি নেতার নিজস্ব দুর্বলতাও কার্যকর নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন দিকও অনেক সময় কার্যকর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। নিম্নে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বা প্রতিবন্ধক রেখাচিত্রের সাহায্যে তুলে ধরা হলো।

উপসংহার: রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনায় প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে দক্ষ ও নৈতিকতাসম্পন্ন নেতৃত্ব। মাঝিবিহীন নৌকার মতই সঠিক নেতৃত্বহীন সমাজ বা রাষ্ট্র কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। Sir James Mackintosh বলেছিলেন, The highest intellect, like the tops of mountain, is the first to catch and to reflect the dawn. অর্থাৎ পাহাড় সকালে সূর্যোদয়ের আলো সবার আগে দেখতে পায়। তার চূড়ায় সূর্যোদয়ের আলো সবার আগে ফুটে উঠে তখনও, ধরা যখন আঁধারে ঢেকে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে একজন জ্ঞানী বা দক্ষ নেতা সমাজের ভবিষ্যৎ পরিবর্তনগুলো সবার আগে উপলব্ধি করতে পারেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে ভালোভাবে দক্ষতার সাথে সঠিক নেতৃত্ব দেয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন। 

তথ্যসূত্র : নেতৃত্বের প্রাথমিক বোঝাপড়া- ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ,
           ব্যবস্থাপনা- মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান

 

লেখক: সেক্রেটারী জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির 

সংশ্লিষ্ট