অধ্যাপক মফিজুর রহমান

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمْ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

“হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর সিয়ামের ফরমান অবতীর্ণ হয়েছে যা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির ওপরও নাজিল হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে পার।

নামকরণ : বাকারা- গাভী। এ সূরার ৬৭ থেকে ৭১ আয়াত পর্যন্ত আয়াতে বনি ইসরাইল জাতির মধ্যে গাভী পূজার বিষয় আলোচনা এসেছে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমের সূরাসমূহের নাম নির্ধারণ করেছেন।যে সমস্ত শব্দ নামকরণের জন্য গৃহীত বলে তাফসিরকারীরা গ্রহণ করেছেন সেগুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ significant and symbolic।

এমনি এ সূরার নাম বাকারা অর্থাৎ গাভী। এই সূরায় গাভীসংক্রান্ত রচনামূলক একটি বাক্যও নেই। সূরাটিতে রয়েছে তাওহিদ আর শিরকের রূপক হিসেবে গাভীকে নেয়া হয়েছে আর তাকে কতলের নির্দেশ এসেছে।
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَذْبَحُوا بَقَرَةً
মূসা তার জাতিকে বলল, “আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গাভী জবাই করার নির্দেশ দিচ্ছেন।”

নাজিলের সময় : এই সূরার অধিকাংশ আয়াতই মাদানী হায়াতে নবীজির ওপর অবতীর্ণ। বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্যতার কারণে কিছু মক্কী আয়াতও এর মধ্যে শামিল হয়েছে। তাকে মাদানী সূরা হিসেবে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত।
গ) বিষয়বস্তু : এ সূরা যেন একটি সংক্ষিপ্ত কুরআন। ইসলামী জীবনব্যবস্থার সালাত, সিয়াম, জাকাত, যুদ্ধ ও সামাজিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশিকা এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।

তাফসিরুল আয়াত:

 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا
হে ঈমানদারগণ! কুরআনুল কারিম যখন ‘মুমিনদের’ সম্মোধন করেন স্বাভাবিকভাবে বুঝতে হবে এরপর কোন বিধান, হুকুম অবতীর্ণ হবে। যখন ‘নাস’ কে খেতাব করা হয় তখন ঈমান গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। কুরআন তাদেরকে মুমিন বলে যারা শুধু মুখে ঈমানের ঘোষণা দেয় না বরং তাদের হৃদয়ে ঈমানের বিষয়গুলো গেঁথে নেয় ও জীবনে তার জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে। আর বিশ্বাসের মধ্যে থাকে না সন্দেহ।
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُوْلَئِكَ هُمْ الصَّادِقُونَ
“নিশ্চয়ই তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে এবং তাতে আর সন্দেহ পোষণ করে না এবং জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারাই সত্যিকারের মুমিন।” (সূরা হুজুরাত : ১৫)


كُتِبَ عَلَيْكُمْ الصِّيَامُ – Fasting is preseribed for you “তোমাদের ওপর সিয়ামের ফরমান অবতীর্ণ হয়েছে।”
সিয়ামকে كُتِبَ শব্দ দিয়ে ফরজ করা হয়েছে। অর্থাৎ লিখিত বিধান অবতীর্ণ হয়েছে। শব্দটি সিয়ামকে অনেক বেশি তাৎপর্যবহ করে আরও বহু নির্দেশ হতে এটিকে ভিন্ন মাত্রার সংযোজন ঘটিয়েছে। এ কঠিন শব্দটির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা কিসাসের বিধান নাজিল করেছেন, করেছেন মিরাসের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ফরমান।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمْ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى
“মমিনগণ নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য قِصَاص এর বিধানের লিখিত ফরমান নাজিল হয়েছে।” (সূরা বাকারা-১৭৮ )
অনুরূপভাবে ‘মিরাজের’ অতীব কঠিন ও জটিল বিষয়েও এই একই শব্দ ব্যবহার করেছে আল-কুরআন।
বিষয়টিতে চিন্তাশীলদের জন্য অনেক ভাবার বিষয় লুকিয়ে রয়েছে। এই একটি শব্দ একটি গ্রন্থ সদৃশ, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সিয়ামের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের হাজার ইশারা।

 كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ As it was prescribed those before you,“যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও অনুরূপ লিখিত সিয়ামের ফরমান অবতীর্ণ হয়েছিল।”

“এ সিয়ামের বিধান শুধু উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর নয় সকল কালের সকল নবীর শরিয়তে ফরজ করেছিলাম। এ কথাটি সংযুক্ত না হলেও সিয়াম পালন করা ফরজ হয়ে যেতো। এর মাধ্যমে সিয়ামের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। এ বিধানটি এতই গুরুত্বপূর্ণ সকল নবীর শরিয়তে সিয়াম সাধনা ফরজ করা হয়েছিল, আর তা এই জন্য যে এর সাধ্যমে এমন কতগুলো গুণাবলি অর্জন হয় যা পরকালীন মুক্তি ও ইহকালীন কল্যাণ অর্জনে অপরিহার্য। শরিয়তের বহু আইন এমন রয়েছে যা এক জাতির ওপর জরুরি হলেও অপর আর এক জাতির ওপর পালনীয় ছিল না। কিন্তু সিয়াম ওই বিধানের অন্তর্ভুক্ত যাকে আল্লাহ তায়ালা সার্বজনীন করেছেন। সময়ের প্রতিটি অধ্যায়ে সকল শ্রেণী পেশার ওপর অবশ্য পালনীয় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
এই বার আলোচনায় আনতে চাই صوم সিয়াম সাধনা কাকে বলে এর তাৎপর্য কী? এর মধ্যে কি প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে?

ক) صوم শব্দের অর্থ বিরত থাকা। একটি নির্দিষ্ট সময় সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে সময়ে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা সওম বা রোজা। একটি ফরজ ইবাদাত। ইহা একটি দীর্ঘমেয়াদি তারবিয়াত, যা লাগাতার এক মাস চলবে। সমগ্র দুনিয়াব্যাপী গোটা মুসলিম উম্মাহ এ পবিত্র ইবাদাতে আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও সওয়াবের এত বেশি বোনাস দেন যে এক নফল ইবাদত এক ফরজের সমান। যখন আকাশ থেকে ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে ঘোষণা দিতে থাকেন ‘হে নেক আমলকারীগণ! সিদ্ধান্ত নাও, ইবাদত-বন্দেগির জন্য কোমর বাঁধ। হে বদকারেরা! অপরাধের জগৎ থেকে ফিরে আস, তাওবা কর।” (বায়হাকী)

এ সাওম মানুষের মধ্যে সহানুভূতির অনুভূতিকে উজ্জীবিত করে, ধার তীব্র জ্বালা,কী নিদারুণ যাতনা তা রোজাদারের মধ্যে জাগ্রত করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সমস্ত অনাচার ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা ও আল্লাহরই সন্তুষ্টি অর্জন করা। নবীজি (সা) বলেন, মিথ্যা কথা ও সাক্ষ্য দেয়া থেকে স্বীয় জিহবাকে যারা সংযত করে না আর অন্যায় ও সীমালংঘনের কাজ থেকে যার দুই হাত বিরত থাকে না তার সিয়াম করা আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” (সহীহ বুখারী)

এ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসেই আল কুরআন নাজিল হয়েছে। অবতীর্ণ হয়েছে সব আসমানি বিতাব। এ মাসের মধ্যে একটি রাত আছে, যার মধ্যে আল কুরআন নাজিল হয়েছে সে একটি রাতের মর্যাদা সমস্ত মাসের চেয়েও বেশি। এ পবিত্র মাসের প্রথম দশ দিন রহমত অবতীর্ণ হয়, সিক্ত করে দেয় তামাম পৃথিবী ও পৃথিবীর অধিবাসীকে, বান্দারা যেন রহমত লাভে ধরনা দেয়,হাত তোলে প্রভুর কাছে। মধ্য দশ রমজানে প্রভুর পক্ষ থেকে অসংখ্য বনি আদমকে মাফ করে দেয়া হয়। চোখের পানি ও তাওবার মাধ্যমে করতে হবে শবেকদরের দুর্লভ রজনীর অনুসন্ধান। এ রাত যারা হারালো তারা যেন সব কিছু হারালো।


 لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ঃ that you become the pious “সিয়ামের মাধ্যমে তোমরা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পার।”
আয়াতের শেষে তাকওয়া অর্জনকে সিয়ামের মূল লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়েছে। এ তাকওয়াকে কুরআন ও হাদীসে বিস্তারিত ও গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে তাকওয়া নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

খ) তাকওয়া শব্দটি (وقي) মূল ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। এর অর্থ বেঁচে থাকা, পরহেজ করা এবং সাবধান হওয়া।
তাকওয়া বলতে আল্লাহভীতিকে বোঝায়। তাই আল্লাহর ভয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় নাফরমানি থেকে পরহেজ করে চলাই তাকওয়ার মূল উদ্দেশ্য। এর পরিধি সমগ্র জীবনের সবকিছুতে বিস্তৃত । যারা নিজ জীবনে তাকওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তারা মুত্তাকি। কুরআনুল কারিম মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা দিয়ে আল-কুরআনের সূচনা করেছেন।
ذَلِكَ الْكِتَابُ لا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ [২] الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاة وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ [৩] وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالآخرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ
“এই কিতাবটি সেই কিতার যাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই এবং মুত্তাকিগণ এ কিতাবের হিদায়ত লাভে সমর্থ হবেন। আর তাকওয়ার অধিকারী তারা যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে গায়েবের ওপর, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, আল্লাহপ্রদত্ত রিজিক থেকে ব্যয় করে পূর্বের কিতারসমূহে ও আখেরি কিতারের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আখেরাতের জীবনে দৃঢ় একিন পোষণ করে।” (সূরা বাকারা : ২-৪)

জীবনে মূল সফলতা এ তাকওয়ার সাথে সম্পৃক্ত। কুরআন বলছে-
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجا- وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لا يَحْتَسِبُ
“আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকিদের জন্য জীবন চলার পথ বের করে দেন আর ধারণার অতীত জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করেন।” (সূরা তালাক : ২-৩)
বান্দাদের সম্মান, মর্যাদা এর সাথে সম্পর্কিত, إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
“আল্লাহর নিকট মুত্তাকির অধিক মর্যাদা সম্মান, তিনি সবকিছু জানেন ও খবর রাখেন।”
গ) তাকওয়া ও সিয়াম সাধনা

তাকওয়া মূলত একটি ভালো গুণের নাম নয় বরং তা অনেক গুণের সমষ্টি।
শত শত উন্নত নৈতিক গুণাবলি এ তাকওয়ার জঠরে জন্ম নেয়। কুরআনুল কারিম এ অনন্য গুণাবলি অর্জনে সিয়াম সাধনাকে জরুরি করেছে। সিয়াম যেন তাকওয়ার গুণে অর্জনের খোদায়ি তাকওযা. মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও মানব হৃদয়ের ওপর সিয়ামের প্রভাব অনন্য। পাপাচার ও সীমালংঘনের রয়েছে অসংখ্য পথ, তবে তিনটি মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে মানবের সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি যেন খুলে দিয়েছে গুনাহের হাজার রুদ্ধদ্বার। আর তা হলো,

১. মানুষের জীবন ধারণের জন্য ‘খাদ্য পানীয়’ অপরিহার্য প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যদি মানুষ একান্ত প্রয়োজনের ওপর সন্তুষ্ট না হয়ে আরও উন্নত খাদ্য ও পানীয় চায় তবে সীমা অতিক্রম করতে বাধ্য হবে। এ ক্ষেত্রে কোন খাদ্য ও উপাদেয় বস্তু তার পেটের অতৃপ্ত ক্ষুধার আগুন নেভাতে পারবে না। তার বৈধ আয় রোজগার ও একটি প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ হবে তাকে বাধ্য করবে হারামের সীমাহীন পথে বিচরণ করতে। কিন্তু সিয়াম তাকে এ পথে চলতে দেবে না। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পেটের, জিহবার তামাম চাহিদা খাদ্য পানীয়কে হারাম করে দিয়ে বিরত থাকার প্রশিক্ষণ কার্যকরী করে সিয়াম সাধনা।

২. মানুষের জীবনে এবং সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে স্বীয় বংশ বিস্তারের এক জরুরি প্রয়োজন লুক্কায়িত রয়েছে। এর জন্য স্রষ্টা নারী-পুরুষের মধ্যে দৈহিক মিলনের ও যৌন ক্ষুধা নিবারণের প্রয়োজন বলবৎ করে দিয়েছেন। কোন প্রাণী সপ্তাহে, মাসে, বছরে এমনকি কেউ জীবনে একবার অথবা স্রষ্টার বেঁধে দেয়া সময়ে বংশ রক্ষার প্রয়োজনে এ দৈহিক মিলনে মিলিত হয়। আশ্চার্য যে শূকর ও কুকুরের মতো প্রাণীরা ছাড়া সকল পশু-পাখি পর্যন্ত এ ক্রিয়া সম্পাদন করে সংগোপনে ও সীমিতভাবে। আফসোস-আশারাফুল মাখলুকাত এর জন্য, মানবেরা এ বিষয়ে নৈতিকতার সীমা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। বলাৎকার, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এ জাতীয় কোনো অপরাধ পশুর জগতেও নেই অথচ পৃথিবী আজ এ পাপের ভার সইতে পারছে না। দেশের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি, পার্লামেন্ট সদস্য, সুশীলসমাজের সদস্যদের একটি বিরাট অংশ যৌন রোগে আক্রান্ত, সাধারণদের কথা বলাই বাহুল্য। এক্ষেত্রে সীমালংঘন এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় আজ পুরুষে পুরুষে, নারীতে-নারীতে যৌনাচার হচ্ছে। পত্রিকার পাতায় আসছে কিভাবে একজন নারী কুকুরের সাথে যৌন মিলন করছে। মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ কী? কোথায় চলছে আধুনিকতা? ভাবতেও লোম শিউরে ওঠে। ইসলাম তো এ ব্যবস্থাকে পবিত্র রাখার জন্য বিবাহকে বৈধ পন্থা বলেছে। সমস্ত নবীগণ বিবাহিত। এমনকি প্রয়োজনে একাধিক বিবাহও পুরুষের জন্য অনুমতি দিয়েছে। আর ‘সিয়াম’ একটি সময় পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণকে দীর্ঘায়িত করেছে মানুষেরা যেন নিয়ন্ত্রিত ও বিরত থাকার ব্যাপারে অভ্যস্ত হতে পারে। যৌন সীমা সংরক্ষণে এ তারবিয়াত সকল ধর্মে স্বীকৃত রয়েছে।

৩. জীবন যাপনে আরাম ও আয়াসের প্রতি রয়েছে মানবের চির দুর্বলতা। এর প্রয়োজন পূরণে সৃষ্ট হচ্ছে সভ্যতার হাজারো উপাদান ও উপকরণ। মানুষ যদি এ বিলাসসামগ্রীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে, হতে বাধ্য। তার পৃথিবীতে আগমন কী উদ্দেশ্যে তা ভাবার সময় থাকবে না জীবন শুধু বিলাস উপকরণ সংগ্রহের ও ভোগের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। মানুষকে কর্মক্ষম করতে ও মোটামুটি আরামে থাকতে যা প্রয়োজন তাতে সন্তুষ্ট হতে হবে। বিলাসিতাকে পরিহার করে সাদাসিধা জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে উম্মতকে নবীজি (সা) উপদেশ দিয়েছেন আর পরিশ্রমী হওয়াকে মুমিনের গুণ বলা হয়েছে।

‘সিয়াম’ পালনকারীগণ রাতে ক্লান্ত দেহে অতিরিক্ত তারাবীহ  সালাত আদায় করতে হয় আবার শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও সেহেরির জন্য উঠতে হয়। অতিরিক্ত আরামের পথে সিয়াম বাধা হয়। শিক্ষা দেয় কঠোর পরিশ্রমী হতে। তাকওয়া অর্জনে সিয়াম সাধনার চেয়ে কার্যকর আর কোনো বিধান নেই। তাই কুরআন শরীফ তাকওয়ার উচ্চশিখরে আরোহণ করার জন্য সিয়ামকে বলছে মাধ্যম ও সিঁড়ি হিসেবে। যে সিয়াম মুত্তাকি তৈরির এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম সে সিয়াম হতে হবে অবশ্যই যথার্থ ও আল্লাহর পছন্দমত। রাসূল (সা) বলেন, উপবাস রোজা নয়,
قالَ قالَ ( صلعم ) كَمْ مِنْ صاءِمِ لَيْسِ لهُ مِنْ صِيامِه اِلاَّ الظَّمأُ وكِمْ قاءِمِ لَيْسِ لِهُ مِنْ قِيَمِه الاَّ شَهَرُ- (الدارمي)
নবীজি (সা) বলেন, “অনেক রোজাদার এমন রয়েছে যাদের রোজা শুধু উপবাসের যাতনা ছাড়া আর কিছুই নয়, আবার অনেক তাহাজ্জুদ গুজার ব্যক্তির রাত জাগরণ অনিদ্রার কষ্ট ছাড়া আর কিছু নেই।” (দারামী)
নবীজি (সা) আবার বলেন, “যে রোজাদারকে মিথ্যা কথা বলা ও পাপকর্ম থেকে তার সিয়াম বিরত রাখতে পারেনি তার শুধু খাদ্য ও পানীয় বর্জন করার উপবাস আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” (সহীহ বুখারী)

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ 
১. আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে তারাই মুমিনে হক যারা আল্লাহ, রাসূল ও পরকালে একিন পোষণ করে, তাতে সন্দেহ করে না ও জিহাদকে গ্রহণ করে সর্বস্থায়।
২. ‘সিয়াম’ এর বিধানকে সকল যুগে সকল উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর লিখিত ফরমান এসেছে।
৩. জান্নাতে যাওয়ার জন্য আল্লাহ ‘তাকওয়া’কে জরুরি করেছেন। আর তিনিই ‘তাকওয়া’ অর্জনের জন্য ‘সিয়াম’ জরুরি করেছেন।
৪. যে রোজাদার বা সিয়াম পালনকারী অন্যায় ও পাপাচার থেকে বিরত থাকেনি তার সিয়াম গ্রহণযোগ্য নয়।

উপসংহারঃ 
খোদাহীনতা, অনৈতিকতা, দুর্নীতি, মানবতার ওপর জুলুম পৃথিবীকে যেন মানব বাসের অযোগ্য করে তুলেছে। সীমালংঘনের প্রকার ও বহু মাত্রিকতার উল্লাস দেখে সভ্যতা মানবিকতা আজ কোণঠাসা। সত্য ও সত্যের ধারকেরা মিথ্যার দাপটের নিকট আজ কম্পমান।এ সময়ে প্রয়োজন ‘তাকওয়ার’ হাতিয়ার যা আমাদের হৃদয় থেকে সৃষ্টির সমস্ত খাওফ বিদূরিত করে আল্লাহর ভয়কে গালেব করবে। যে ভয় দিয়ে সকল ভয়কে আমরা জয় করব। সে সিয়াম সাধনার মাস আমাদের দারে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে উপস্থিত। এ পবিত্র মাহে রমজানে এক একটি মুহূর্ত সময়ও অনেক মূল্যবান। হাজার হাজার বছরের নফল ইবাদত একত্র করলেও একটি ফরজের সমান হবে না। কিন্তু এ মাসের একটি নফল ইবাদত একটি ফরজতুল্য সুবহানআল্লাহ। ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে পালন করতে হবে এক একটি রোজা। ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হবে সকল পাপাচার থেকে। তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ নিয়মিত আদায় করতে হবে। রহমতের মাসে সবচেয়ে বড় আল্লাহর অনুগ্রহ আল-কুরআন। অর্থসহ এক খতম কুরআন পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে সবাইকে এ মাসের মধ্যে। হাজার ব্যস্ততার পরও রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতি রমজানে ইতিকাফ করেছেন। আসুন আমরা কঠিন এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এ পবিত্র মাসে। আমিন।

লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ