শহীদ খলিলুর রহমান

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২২ জুন ১৯৯০ | ৩৯

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাস্তিক্যবাদী ইসলামবিরোধী খুনিরা শিবিরের আটজন নেতা ও কর্মীকে হত্যা করেছে। অতীতে সকল খুনির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট মামলা দায়ের করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলেই খুনিচক্র বারবার খুনের নেশায় মেতে ওঠে। মেতে উঠেছিল সেদিনও। যার ফলশ্রুতিতে খলিলের মতো একজন প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় তরুণকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হল। শহীদ খলিলুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অষ্টম শহীদ।

ব্যক্তিগত পরিচিতি
শহীদ খলিলুর রহমান একজন পিতৃমাতৃহীন এতিম। তাঁর পিতার নাম ছিল আয়েজ আলী মন্ডল। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর থানাধীন ঘোষকুড়া নামক গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন শহীদ খলিলুর রহমান। নয় ভাই-বোনের মাঝে তাঁর অবস্থান ছিল পঞ্চম। আল্লাহর দ্বীনের দুশমনরা খলিলকে হত্যা করে তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ করলে পরিবারটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে।

লেখাপড়া ও সাংগঠনিক জীবন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্রশিবিরের অষ্টম শহীদ খলিলুর রহমান ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষের (পুরাতন) ছাত্র ছিলেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য শহীদ খলিলুর রহমান শাহাদাতকালে ১৯৮৯-৯০ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সৈয়দ আমীর আলী হল শিবিরের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রতিভাবান এই ছাত্র ইতঃপূর্বে নাটোর শহর ও জেলা শাখার সেক্রেটারি ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কয়েকবার।

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
১৯৮৯-এর এপ্রিলের পর থেকে ক্যাম্পাসে কমবেশি টেনশন থাকলেও ৯০-এর ২২ জুনের আগে তেমন বড় ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়নি। ১৯৮৯-৯০ সেশনের প্রথম বর্ষ সম্মানের ক্লাস মাত্র ১২ দিন আগে শুরু হয়েছে। সেশনজট কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ক্লাস ও পরীক্ষাসমূহ রীতিমত চলছে। নবাগত ছাত্র-ছাত্রীরা শিবিরের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে মুক্তিকামী এই কাফেলায় শরিক হচ্ছে। আর অন্যদিকে শিবিরের অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে বাতিলপন্থী খোদাদ্রোহীরা হিংসার থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে।

ঘটনার দিন রাত ১০টায় ছাত্রশিবির শাহ মাখদুম হল শাখা নবাগত ছাত্রদের স্বাগত জানিয়ে হলে মিছিল শুরু করে। মিছিল চলাকালে ছাত্রলীগ (না-শ)সহ অন্যান্য সকল ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসীরা একযোগে চিৎকার শুরু করে ‘ধর ধর, মার মার’ ইত্যাদি বলে। কিন্তু শিবিরের মিছিল তখনও “সব মতবাদ পায়ে দলে/আয়রে তোরা খোদার পথে; “মুক্তির একই পথ-ইসলামী বিপ্লব”; নবাগত ছাত্র ভাইয়েরা/স্বাগতম শুভেচ্ছা’ ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে হল প্রদক্ষিণ করছিল। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা করিডোরের লাইট নিভিয়ে গোটা হলকে অন্ধকার করে দিয়ে মিছিলের পথ বন্ধ করার চেষ্টা করে। অকথ্য ভাষায় শিবিরকে গালিগালাজ করতে থাকে। অন্ধকারময় অবস্থায় সন্ত্রাসীরা হাতবোমা আর ককটেলের শব্দে হলকে প্রকম্পিত করে তোলে।

হলের গেটে তালা লাগিয়ে অস্ত্র হাতে হত্যার উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ শিবিরকর্মীদের ওপর। অন্ধকারের মাঝেই প্রাণভয়ে ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। জীবন রক্ষার্থে তারা হল গেটের তালা ভেঙে পার্শ্ববর্তী সৈয়দ আমীর আলী হলে আশ্রয় নেয়। তখন আমীর আলী হলের প্রভোস্ট আবদুর রহমান বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করে বাইরে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে খুনি সন্ত্রাসীরা গোটা হল ঘিরে ফেলে। এখানেও শিবিরকর্মীরা নিশ্চয়তা পেলেন না। উপর্যুপরি বোমা ও ককটেলের শব্দে হলকে এক নারকীয় হত্যাপুরীতে পরিণত করল। ঘটনার আকস্মিকতা উপলব্ধি করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সায়েদুল ইসলাম ও রাজশাহীর এসপি আলী ইমাম ফোর্সসহ সেখানে উপস্থিত হন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সামনে এমন হত্যাযজ্ঞ চলছে অথচ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। প্রক্টর সায়েদুল ইসলাম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রায় ৪০/৫০ মিনিট যাবৎ অনুরোধ জানাতে থাকেন কিন্তু এসপি তার কথায় কোনো কর্ণপাত করেননি। প্রক্টরের জোরালো বক্তব্য আর পুলিশ ভূমিকা নিলেই এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটতো না।

পুলিশ যখন সেখানে উপস্থিত তখন রাকসু’র ভিপি রাগিব আহসান মুন্নাসহ সংগ্রাম পরিষদের বিপুল সংখ্যক কর্মী সশস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ সন্ত্রাসীদের নিরস্ত্র করার জন্য কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। বরং পুলিশের সামনেই সন্ত্রাসীরা হলের ভেতর প্রবেশ করে এবং ঠাণ্ডা মাথায় পুলিশ প্রহরায় শিবিরকর্মীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। অনেকের মত খলিলুর রহমানও আহত হলেন। তারপর খোদাদ্রোহী হায়েনারা চাইনিজ কুড়াল, ধারাল কিরিচ ও ছোরা দিয়ে খলিলকে নির্মমভাবে আঘাত করে।

অনেকের ধারণা খলিলুর রহমান সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি আঘাতে হলের মধ্যেই শাহাদাত বরণ করেছিলেন। আবার অনেকেই বলেছেন প্রচণ্ড আঘাতে খলিলুর রহমান জ্ঞান হারিয়েছিলেন। পরে তাঁকে সন্ত্রাসীরা হলের বাইরে এনে হত্যা করে। যাই হোক, রাত ১২টার দিকে খলিলুর রহমানকে মেডিক্যালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের খুনিরা তাতে বাধা প্রদান করে। পাষণ্ড নরখাদকরা শহীদ খলিলের লাশের গলায় দড়ি দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে প্রথমে লতিফ হলে আনে, তারপর এসএম হলের গেস্ট রুমে নিয়ে যায়। উপরন্তু হায়েনার দল শহীদ খলিলকে নিজেদের কর্মী বলে মিথ্যা দাবি করতেও দ্বিধা করেনি। বহু চেষ্টার পর রাত ৩টার দিকে খলিলুর রহমানকে মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে শহীদ খলিলুর জান্নাতের অনেকগুলো সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠে গেছেন। শহীদ খলিলকে যখন আমীর আলী হল থেকে দুষ্কৃতিকারীরা বের করে আনে তখন হল গেটে প্রক্টর ও এসপি উভয়েই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তারা ওই মানুষখেকোদের হাত থেকে শহীদ খলিলকে উদ্ধারের সামান্যতম চেষ্টাও করেননি।

পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা
সন্ত্রাসীরা যখন হল ঘেরাও করে রেখেছিল তখন পুলিশ হলের মধ্যে যেতে অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু প্রক্টরের অনুরোধকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ রাখেনি। অথচ সন্ত্রাসীরা বাইরে থেকে হলে প্রবেশ করল কীভাবে(?) তা সবার কাছেই রহস্যজনক। শহীদ খলিলকে খুন করে জাসদ মৈত্রীর খুনিরা পুলিশের সামনে দিয়ে মৃত খলিলকে হল গেট দিয়ে বের করল। ইচ্ছে করলে পুলিশ বাহিনী সন্ত্রাসীদের হাত থেকে খলিলুর রহমানকে তখনও উদ্ধার করতে পারত। কিন্তু কোনো এক রহস্যময় কারণে তারা তা করেনি।

হল প্রভোস্ট আবদুর রহমান নিজ মুখে স্বীকার করেছেন, ‘শিবিরের সমর্থক আমীর আলী হলে বেশি ছিল কিন্তু তারা কাউকে আক্রমণ কিংবা অন্যকোনো কক্ষে অগ্নিসংযোগ করেনি। বাইরে থেকে সন্ত্রাসীরা গিয়েই খলিলকে হত্যা করেছে।’
খলিলকে হত্যা করে দুষ্কৃতিকারীরা তাদের কর্মী বলে দাবি করেছিল। কিন্তু সত্য উদ্ভাসিত হওয়ায় তাদের মিথ্যার মুখোশ উন্মোচিত হয়। খলিল হত্যার পর একটি তদন্ত কমিটিও গঠন হল কিন্তু তদন্তের ফলাফল জাতি জানতে পারেনি। পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের সাথে আওয়ামী লীগ আঁতাত করে ৬০ জন খুনিকে মামলা থেকে রেহাই দিয়েছে।


একনজরে শহীদ খলিলুর রহমান
নাম : মো: খলিলুর রহমান
পিতার নাম : আয়েজ আলী মন্ডল
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- ঘোষকুড়া, ডাকঘর- রামবাড়ী, থানা- নিয়ামতপুর, জেলা- নওগাঁ
ভাই-বোন : ৯ জন
ভাই-বোদের মাঝে অবস্থান : পঞ্চম
পরিবারের মোট সদস্য : ১৬ জন
সর্বশেষ পড়াশোনা : ইসলামিক স্টাডিজ (সম্মান), প্রথম বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনের লক্ষ্য : শিক্ষকতা
সাংগঠনিক মান : সদস্য
আহত হওয়ার স্থান : সৈয়দ আমীর আলী হল
শাহাদাতের স্থান : ঘটনাস্থলেই
আঘাতের ধরন : কাটা রাইফেলের গুলি, হকিস্টিক, রড ও কুড়াল
যাদের আঘাতে শহীদ: জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন
শাহাদাতের তারিখ : ২২ জুন, ১৯৯০
মায়ের প্রার্থনা : শহীদের নিজের পিতা-মাতা মৃত হওয়ায় সৎ মা তাঁকে লালন-পালন করতেন। শহীদ হওয়ার পর তাঁর মা তাঁকে শহীদ হিসেবেই কবুল করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ খলিলুর রহমান

পিতা

আয়েজ আলী মন্ডল

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৯ জন

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম- ঘোষকুড়া, ডাক- রামবাড়ি, থানা- নিয়ামতপুর, জেলা - নওগাঁ

সাংগঠনিক মান

সদস্য

সর্বশেষ পড়ালেখা

ইসলামিক স্টাডিজ, ১ম বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

সৈয়দ আমীর আলী হল, রাবি