শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী

০১ জানুয়ারি ১৯৬৯ - ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ | ১৮

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

চট্টগ্রাম বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এক রক্তঝরা শহীদি ময়দান। আন্দোলনের রক্তপিচ্ছিল এ ময়দানে শাহাদাতের প্রেরণায় উজ্জীবিত অসংখ্য তরুণ বাতিলের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শাহাদাতের এমনি এক অধ্যায়ের নায়ক শহীদ জসিম উদ্দিন। খোদাদ্রোহী শক্তির হামলায় ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ আহত হয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি সুবেহ সাদেকের সময় শাহাদাতবরণ করেন তিনি।

জসিম উদ্দিনের বেড়ে ওঠা
চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া থানার পূর্ব সরফভাটা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জসিম উদ্দিন। তাঁর পিতা মাস্টার খলিলুর রহমান ও মাতা মরিয়ম বেগম ছিলেন খুবই ধার্মিক। শহীদ জসিম ছোটকাল থেকেই আল্লাহর পথে নিবেদিত সাচ্চাদিল মুজাহিদ ছিলেন। তিনি নিজেকে আল্লাহর দ্বীনের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন এমনভাবে; যেন দ্বীনের কাজ করাই ছিল তাঁর জীবনের মহান লক্ষ্য।

শিক্ষাজীবন
শহীদ জসিম খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৮৫ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং শাহাদাতকালে তিনি ইমাম গাজ্জালী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলেন।

সাংগঠনিক জীবন
শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী ইমাম গাজ্জালী কলেজে অধ্যয়নকালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

শাহাদাত
১৪ ফেব্রুয়ারি শিবিরের মিছিলে বর্বর বোমা হামলায় দু’জন কর্মী খুনের প্রতিবাদ ও খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি শিবির দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করে। এ উপলক্ষে ঢাকার ফুলবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ছাত্র গণজমায়েতের আয়োজন করা হয়। লালদীঘি ময়দানে সমাবেশের সাড়া পড়ে গিয়েছিল চট্টগ্রাম শহর ছাড়াও আশপাশ উপজেলাগুলোতে। লালদীঘির ময়দান লোকে লোকারণ্য হয়। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হয় ছাত্র গণজমায়েত। জমায়েত শেষে লোকজন স্ব-স্ব গন্তব্যে পৌঁছার পূর্বেই ঘটানো হলো আরো এক নৃশংসতা।

ওইদিন দুপুর ১২টা থেকেই রাঙ্গুনিয়ার শিবিরকর্মীরা লালদীঘি ময়দানে জমায়েতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কিছু সংখ্যক শিবিরকর্মী রাঙ্গুনিয়া শিবির অফিসে সমবেত হন। জোহরের নামাজ পড়ে সবাই রওয়ানা হবে ঠিক করেন, অনেকে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে গিয়েছিলেন, এমন সময় মানবতার দুশমন ফ্যাসিস্টরা রাঙ্গুনিয়া শিবির অফিসে হামলা চালায়। হামলাকারীরা কিরিচ, ছোরা, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে শিবিরকর্মীদের নির্বিচারে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে। ৬ জন শিবিরকর্মীকে গুরুতর অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাঁদের মধ্যে জসিম উদ্দিন চৌধুরীর অবস্থা মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটে, শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। হাসপাতালের শয্যায় অবিরাম রক্ত দেয়ার পরও তাঁর অবস্থা স্বাভাবিক হয়নি, ছোরার আঘাতে ফুসফুস ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল তাঁর, রাতভর জ্ঞান ফেরেনি।

এভাবে দীর্ঘ সাড়ে ষোল ঘণ্টা কঠিন যন্ত্রণায় ভোগার পর পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি সুবহে সাদিকের সময়, ৫.১৫ মিনিটে তিনি মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। তাঁর শাহাদাতের খবর যেন বিদ্যুৎবেগে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদের সাথীরা দলে দলে ভিড় জমায় হাসপাতালে। তাদের কান্নার রোলে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। বিকেলে লালদীঘি ময়দানে শহীদের নামাজে জানাজার পর লাশ রাঙ্গুনিয়ার পূর্ব সফরভাটা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। সেখানেই চিরনিদ্রায় শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন আল্লাহর দ্বীনের এক নিবেদিত মর্দে মুজাহিদ শহীদ জসিম।

জসিমের স্মৃতি আঁকড়ে আছেন মা
শহীদের পিতা আজ আর বেঁচে নেই। মা মরিয়ম বেগম বেঁচে থাকলেও অসুস্থ। ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘জসিমের কথা মনে হলে এখনো তাঁর জামা ও ছবির ওপর হাত বুলিয়ে মনকে বোঝাই। তাঁর কথা মনে পড়লে কান্নায় বুক ফেটে যায়। আমি তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন সে বেহেশতে শান্তিতে থাকতে পারে।’

জসিম উদ্দিন মাহমুদের জীবন থেকে
শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী সরফভাটা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় তাঁর মামা হাজী ফজলুল হক ফার্মেসিতে বসতেন। তাঁর মামা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার এখনো স্মরণে আছে জসিম দেশের প্রতি নাগরিকের দায়িত্বের কথা চিন্তা করে প্রতিনিয়ত দেশের খবর রাখতেন। তবে টিভি দেখতে তাঁর আগ্রহ ছিল না, রেডিওতে খবর শুনতেন। একদিন শহীদ জসীমের বন্ধুরা দুষ্টুমি করে তাঁকে জোর করে টিভির সামনে বসিয়ে দেয়। জসিম উদ্দিন খুব ক্ষুব্ধ হন এবং টিভি রুম থেকে বেরিয়ে আসেন।’

একনজরে শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী
নাম : জসিম উদ্দিন চৌধুরী
মায়ের নাম : মরিয়ম বেগম
পিতার নাম : মাস্টার খলিলুর রহমান
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- পূর্ব সরফভাটা, থানা- রাঙ্গুনিয়া, জেলা- চট্টগ্রাম
সাংগঠনিক মান : সাথী
সর্বশেষ পড়াশোনা : উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : ইমাম গাজ্জালী কলেজ
জীবনের লক্ষ্য : ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
আহত হওয়ার স্থান : রাঙ্গুনিয়া শিবির অফিস
আঘাতের ধরন : রামদা, রড দিয়ে মাথায় আঘাত
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রসেনা
শাহাদাতের তারিখ : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭, ভোর ৫.১৫টা
শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
খুনিদের বিচার : শহীদের খুনি আব্দুর রহমান ও মুছা কাদেরী এ খুনের ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করছে।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী

পিতা

মাস্টার খলিলুর রহমান

মাতা

মরিয়ম বেগম

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ১, ১৯৬৯

স্থায়ী ঠিকানা

পূর্ব শরফভাটা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

HSC পরীক্ষার্থী, ইমাম গাজ্জালী কলেজ

শাহাদাতের স্থান

রাঙ্গুনিয়া শিবির অফিসে আহত এবং শাহদাত বরণ করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল


শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী

ছবি অ্যালবাম: শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী


শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী

ছবি অ্যালবাম: শহীদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী