শহীদ আতিকুল ইসলাম

১৩ জানুয়ারি ২০১৬ - ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ | ১৬১

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

“নাড়িছেঁড়া মা আর প্রদীপহারা পিতা বুকের ধন আপনকে হারিয়ে যে কান্নার সাগর তৈরি করে চলেছেন এর জলরাশি কি আর তাদের এই জনমে শুকাবে?”

শহীদ পরিচিতি
নীলফামারী জেলার পীর ও কামেল শাহ কলন্দর (রহ:) এর আধ্যাত্মিক শক্তি ও ইসলামের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এ অঞ্চলের বহু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। উত্তরাঞ্চেলে প্রথম পর্যায়ে ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে তিনি উল্লেখযোগ্য। কৃষক বিদ্রোহের মহান নেতা নবাব নূরুল উদ্দীন ইংরেজ বেনিয়াদের নিষ্ঠুর শাসন ও তাদের দোসর দেবী সিংহ ও অন্যান্য জমিদারদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। ভাওয়াইয়া গানের সূতিকাগার এ জেলায় আব্বাস উদ্দিনের জন্ম।
ঠিক এমন একটি ঐতিহ্যবাহী জেলার জলঢাকা উপজেলার পশ্চিম খুটামারা কবিরাজ পাড়াতে আতিকুল ইসলাম আপনের জন্ম। ১৯৮৬ সালে যখন আনিসুর রহমান ও আমিনা বেগম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তখন তাদের বয়স যথাক্রমে মাত্র ২৫ ও ২০ বছর। ৯১ সালে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই তাদের দু’জন পুত্রসন্তান মারা যায়। ২৩ মে ১৯৯৬ সালে বিয়ের ১০ বছর পর তাদের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় তাদের একমাত্র জীবিত সন্তান। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের নামের সাথে মিল করে এবং তার প্রতি অন্তহীন ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে সন্তানের নাম রাখেন আতিকুল ইসলাম আপন। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিল সন্তানকে আলেম হিসেবে তৈরি করবেন তাই তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলেন। শাহাদাতকালীন সময় ছেলেটি দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিল।

যেভাবে আপন আল্লাহর রাহে চলে গেলেন
নীলফামারীতে বর্তমানে নীলকরেরা নেই। কিন্তু মনে হয় তাদের প্রতিনিধিরা এখনও মাঝে মাঝে মানব সমাজে হামলে পড়ে। ঠিক যেমন গত ২ মার্চ ২০১৩ একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলে জনগণকে রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বিজিবি বাহিনী তাদের নীল পোশাক পরে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অন্যায় রায়ের প্রতিবাদে সারাদেশের মতো জলঢাকা সদরে বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। ঘটনাস্থলে শহীদের নিজ বাড়ি খুটামারা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার। আপন দুপুরে ভাত খেয়ে মাকে বললেন, ‘মা যাই। ইসলামদরদি মা বললেন, ‘আব্বুকে বলে যাও, আব্বু তখন খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাই আপন আর আব্বুকে ডাকেনি। যদিও মা-ছেলের আলোচনার গুঞ্জরণ বাবা শুনছেন। যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি ছিল না বলে তিনিও আর না করেননি। দুপুরের পর বিভিন্ন দিক থেকে শত শত লোক মিছিল সহকারে জলঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেয় এবং মিছিল কিছুদূর অগ্রসর হলে মোবাইলে খবর আসে কর্মসূচির স্থলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তাই আইন মেনে জলঢাকা ৪ কিলোমিটার আগে থেকে মিছিলকারীরা ফিরে আসছিলেন।

কিছুদূর আসার পর বিজিবির গাড়িবহর পেছন দিক থেকে মিছিল অতিক্রম করার চেষ্টা করে এবং মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে থাকে। ফলে মিছিলকারীরা উত্তেজিত হয়ে তাদেরকে ধাওয়া করে। বিজিবি আবার পেছন থেকে একত্রিত হয়ে হাঁটু গেড়ে গুলি করতে থাকে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয় এবং বিকেল ৩.১৫ মি: ঘটনাস্থলে ১০ম শ্রেণীর ছাত্র আতিকুল ইসলাম আপনের বুকের বাম পাশে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিনি রাস্তায় ছটফট করতে করতে শাহাদাত বরণ করেন। জনতা লাশ বহন করে বাড়িতে নিয়ে আসে। শহীদ আতিকুল ইসলাম আপন ইসলামী ছাত্রসংগঠনের কর্মী ছিলেন এবং তার মাতা-পিতাও বৃহত্তর সংগঠনের সাথে জড়িত।

স্বজনদের হাহাকার
১৯৮৬ থেকে ২০১৩ এই ২৭ বছরের অনেক কষ্টের পর আনিসুর-আমিনা দম্পতির সকল প্রত্যাশা ও স্বপ্নের স্ফুরণ ঘটেছিল এই ১৭ বছরের ফুটফুটে কিশোর ‘আপনকে কেন্দ্র করেই। আপনকে নিয়েই বাবা-মা আপন ভুবন গড়ে তুলেছিলেন। পিতা আনিসুর রহমানের পান, গুল ও সিগারেটের অভ্যাস ছিল; পরিবার ও ছেলেটির কথা চিন্তা করে কঠিন সে নেশাগুলোও তিনি অবলীলায় ত্যাগ করেন। ঘরকে সরগরম করতেই আরেকটি মেয়েকে তারা পালক মেয়ে হিসেবে নেন। সেই আশরাফিয়ার বয়স ১৩ বছর। সে এখন ৭ম শ্রেণীতে পড়ে। কিন্তু কষ্ট নামক শব্দটি যেন এই কবিরাজ বাড়ির সঙ্গী। কঠিন থেলাসামিয়ায় আক্রান্ত এই ছোট্ট মেয়েটি। তার বেদনার নিত্য অতল প্রবাহ তো আছেই; যেন সমগ্র পরিবারটিই ধুঁকছে সে কষ্টে। প্রতিদিন প্রায় ৮৩ টাকার ওষুধ খেতে হয় ওকে। ভালভাবে অপারেশন করতে চাইলে সিঙ্গাপুরে নিতে হবে। আনুমানিক খরচ হবে ৬০ লক্ষ টাকা। অপারেশনের কষ্টতো বোনাস কিন্তু সুস্থতার সম্ভাবনা ৭০%। কে জানে এভাবেও কতদিন টিকবে। আজকে ৫২ ও ৪৭ বছর বয়সী এ দম্পতি ভাবেন এই বয়সে তাদের কোল আলোকিত করে আর কোন সোনামানিক কি আসবে। তাদের বুকের কষ্টের সাহারা দূর করতে কোন জাদুর ধন কি তারা খুঁজে পাবেন? বর্তমান জামানায় ইব্রাহিম (আ:)-এর উপমা কি তারা হতে পারবেন?

আপনের গুলি লাগার খবর শুনে পাগলের মতো মোটরসাইকেল চালিয়ে যান স্নেহময় পিতা আনিসুর রহমান, সন্তানের প্রিয় নিথর প্রাণ দেহ দেখে ঝড়ে উপড়ানো বটগাছের মতোই অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এরপর নিজের ফার্মেসিতে বসেছেন ১৮ দিন পর, ২ মাস আর নিজের মোটরসাইকেলে উঠতে পারেননি। ২ মাস পর প্রথম একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

আপন যখন দুই-তিন বছর বয়সী, ওর জ্বর হয়েছিল। ডাক্তার ইঞ্জেক্ট করে রক্ত নিয়েছিলেন পরীক্ষার জন্য। সে দৃশ্য সহ্য করতে পারেননি তার যুবক পিতা। সেই আপনের প্রাণ দেহের পাঁজর চুইয়ে সব রক্ত নিঃশেষ হলো, তিনি কিভাবে সহ্য করলেন; বলেই কেঁদে জার জার হয়ে যান আজকের পৌঢ় পিতা আনিসুর। পর্দার অন্তরালেও শোনা যায় আটলান্টিকের ঊর্মিমালার মতো মায়ের অস্ফুট কান্নার আছড়ে পড়ার ধ্বনি।

নীলফামারী জেলার উত্তর পূর্বদিকে দিয়ে বহমান তিস্তা নদী জলঢাকা উপজেলার জন্য এখনও অভিশাপ, বর্ষায় প্লাবিত হয়ে যায় সব কিছু । হয়তো এ কারণেই সেই প্রাচীনকালে এ জনপদের নাম হয়েছিল জলঢাকা। নীলফামারী জেলার আরেক বিস্ময়। সমুদ্র নয়, অথচ সমুদ্রের নামে নাম। নয়ন জুড়ানো বিপুল জলরাশির কারণে সবাই তাকে নীলসাগর বলে। জনশ্রুতি আছে যে, প্রায় ৫২০০ বছর পূর্বে এই দীঘিটি (যার আয়তন ৯৩.৯০ একর) খনন করা হয়েছিল। হয়তো প্রকৃতির অমোঘ পরিবর্তনে জলঢাকা আর জলে ঢাকা থাকবে না; একদিন সমুন্নত, বিপুলা এক জনপদে রূপান্তরিত হবে। হয়তো ৫ হাজার বছরের সুপ্রাচীন মানবসৃষ্ট নীলসাগর দীঘির অথৈ জলরাশিও একদিন শুকিয়ে যাবে। কিন্তু নাড়িছেঁড়া মা আর প্রদীপহারা পিতা বুকের ধন আপনকে হারিয়ে যে কান্নার সাগর তৈরি করে চলেছেন; এই জররাশি কি আর তাদের এই জনমে শুকাবে?

ব্যক্তিগত প্রোফাইল

নাম : শহীদ মো: আতিকুল ইসলাম আপন
জন্ম তারিখ : ২৩.০৫.১৯৯৬ ইং
পিতা : মো: আনিসুর রহমান, বয়স ৫২ বছর, ঔষধের ব্যবসা ও ডিসপেন্সারি
মাতা : আমিনা বেগম, বয়স ৪৭ বছর, গৃহিণী
ভাইবোন : একমাত্র সন্তান।
অধ্যয়ন : দশম শ্রেণীর ছাত্র
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : পশ্চিম খুটামারা কবিরাজ পাড়া, ডাকঘর : খুটামারা, থানা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারী।
আহত ও শাহাদাতের তারিখ : ২ মার্চ ২০১৩, পিঠে ডান দিকে গুলি লেগে বুকের ডান পাশ দিয়ে বের হয়।
জানাজার ইমামের নাম ও উপস্থিতি : প্রথমবার মাওলানা আন্তাজুল ইসলাম প্রভাষক, আইডিয়েল কলেজ, টেঙ্গনমারী ঈদগাহ মাঠে, উপস্থিতি ২০ হাজার। দ্বিতীয়বার মাওলানা ওহিদুল ইসলাম, প্রভাষক সিটমিরগঞ্জ ফাজিল মাদ্রাসা।
কবর : বাড়ির দরজায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আতিকুল ইসলাম

পিতা

মো: আনিসুর রহমান

মাতা

আমিনা বেগম

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ১৩, ২০১৬

ভাই বোন

শহীদই একমাত্র সন্তান

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম : পশ্চিম খুটামারা কবিরাজ পাড়া, ডাকঘর : খুটামারা, থানা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারী

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

দশম শ্রেণী

শাহাদাতের স্থান

ঘটনাস্থলে


শহীদ আতিকুল ইসলাম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আতিকুল ইসলাম


শহীদ আতিকুল ইসলাম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আতিকুল ইসলাম