শহীদ আশিকুর রহমান

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ | ১৫৩

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

“আশিকুর একটি লাল শার্ট নিয়ে গায়ে দিয়ে বললেন, ‘এবার কেমন দেখা যায়?’ কী এক অজানা আশঙ্কায় আব্বা-আম্মা দু’জনেই নীরব থাকেন।”

শহীদের পরিচিতি
রংপুর মিঠাপুকুরের ইমাদপুর মুহুরীপাড়া গ্রামের শহীদ মো: আশিকুর রহমান ১৯৮৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতার তিন সন্তানের মধ্যে তিনি প্রথম। ২ ভাই ১ বোনের সংসারে দরিদ্র পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে চূড়ান্ত চেষ্টা করেছেন। বড় সন্তানকে পড়ালেখা করাতে না পারলেও তারা তাকে নিয়ে হতাশ ছিলেন না। আশিকুর নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে পিতাকে সহযোগিতার জন্য শহীদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাড়ির পাশে ছোট মুদির ব্যবসা করতেন। আব্বা-আম্বা, ভাইবোনদেরকে নতুন ঘরে থাকতে দিয়ে তিনি পুরাতন ঘরে থাকতেন। পরিবারের প্রয়োজনে ওদের ৪ বিঘা সম্পত্তির ২/২.৫ বিঘা ছিল বন্ধক দেয়া। অসুস্থ বাবা এবং দরিদ্র পরিবারের উন্নয়ন নিয়ে তিনি খুব চিন্তা করতেন। ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়ার জন্য তিনি প্রেরণা দিতেন। এলাকাবাসী সাক্ষ্য দেন, ধর্মীয় কাজে তার আগ্রহ ছিল খুব এবং সে ছিল বেশ মিশুক। ২৫ বছরে পা দেয়া বড় ছেলেটার বিয়ে বিষয়ে পিতামাতার চিন্তা ছিল ব্যবসাটা একটু দাঁড়ালে ওর জন্য ঘর আলো করে নতুন বউ আনবেন। কিন্তু না সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ছেলেটা সবচেয়ে বড় ব্যবসা করে চলে গেল; আল্লাহ চাইলে তার বিয়ের অনুষ্ঠানটা জান্নাতেই হবে।

যেভাবে তিনি আল্লাহর ডাকে চলে গেলেন
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ঘটনাস্থ'ল শহীদের নিজ বাড়ি থেকে ২২ কিলোমিটার। আল্লামা সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে মিছিলের খবর পেয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত লোক দলবেঁধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেউ রিকশা, কেউ বাইসাইকেল, মোটরসাইকেলে আবার কেউবা নসিমনে করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। শহীদ আশিকুরের আব্বা ৫০ বছর বয়সী আফতাব উদ্দীনের চিন্তা ছিল তিনি একাই যাবেন; তাই একান্তে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু আশিকুর বেঁকে বসলো, বললো, আব্বা আপনি থাকেন আমিই যাবো। বাপ-বেটার টানাহেঁচড়া শেষে ঠিক হলো উভয়েই যাবেন। প্রথমে একটি সাদা শার্ট গায়ে দিয়ে তিনি বাবাকে বললেন, কেমন লাগছে? আব্বা বললেন, ভালোই তো। অতঃপর মায়ের কাছ থেকে আশিকুর একটি লাল শার্ট নিয়ে গায়ে দিয়ে বললেন, এবার কেমন দেখা যায়? কী এক অজানা আশঙ্কায় আব্বা-আম্মা দু’জনেই নীরব থাকেন। সামান্য কিছু মুড়ি খেয়ে; লাল শার্ট গায়ে ছেলে বাপসহ বেরিয়ে যান মাকে শুধু বলেন, আম্মা যাই! মা জননী এবারও নীরব।

আশিকুর ও তার বাবা ভটভটিতে চেপে সকাল সাড়ে ৭টায় মিঠাপুকুর যান। সেখানে ৫০ হাজার এলাকাবাসীর সাথে উল্লেখিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। বেলা প্রায় আড়াইটায় নামাজ শেষে তারা মিছিলে যোগ দেন। একটা পর্যায়ে পুলিশ-বিজিবি গুলি চালালে তিনি সরাসরি মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতের পর তার প্রতিবেশীরা লাশ নিয়ে মাগরিবের আগে বাসায় পৌঁছে এবং নামাজের পর জানাজা শেষে সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

স্বজনদের কান্না
‘আল্লামা সাঈদীর যেদিন রায় হবে কত জন যে মারা যাবে? এমটাই মন্তব্য ছিল আশিকুরের; কিন্তু কে জানতো সেই তালিকায় তার নামটিও জ্বলজ্বল করতে থাকবে। সরাসরি তার মাথায় গুলি লাগে। মগজ বের হয়ে যায়। স্বাধীন ও তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান দেশের কালো পিচঢালা রাস্তায় লাল শার্ট গায়ে এক তরুণের লাশ। তার কালো চুল ঢেকে যায় টকটকে লাল রক্ত ও শুভ্র মগজে তৈরি হয় ত্যাগের এক নতুন আলপনা। আশিকুর খুব সাহসী ছেলে ছিলেন। তার মামা ৪-৫ দিন তাকে অনুরোধ করেছেন, বাবা যেও না। অম্লান বদনে তিনি মামাকে বুঝাতেন, ‘ওখানে কিছু হলে তিনি শহীদ হবেন। পিতা আফতাব উদ্দীন মাঝে মধ্যে স্থানীয় মসজিদে ইমামতি করতেন। একদিন নামাজ শেষে সাঈদী সাহেবের জন্য দোয়া করলে তার এ চাকরি চলে যায়। ছোট ভাই আপনের কান্না। যে কারো হৃদয়ে কম্পন তুলবে, ‘ইসলামের জন্য আজকে আমাদের একঘরে করে ফেলেছে।’ এ যেন শেবে আবু তালিবের সেই জীবন্ত ছবি।

ছোট ভাইবোনেরা স্বপ্নযোগে বড় ভাইকে দেখতে পায় যেন এখনও তার দায়িত্ব সে পালন করে চলেছে, বলছে ‘পড়াশোনা ঠিকভাবে কর। আব্বা-আম্মার প্রতি খেয়াল রাখিও ইত্যাদি।’

জনম দুঃখিনী মা আঞ্জুআরা কৈশোরেই যার বিয়ে হয়েছিল। এ বয়সের বৌদের যা হয় সেই দূরে গাইবান্ধার বাবার বাড়ির স্মৃতিতে মুষড়ে থাকেন। বছর দুয়েকের মাথায় কোল আলো করে যখন প্রথম সন্তান আসলো প্রাণভরে গেল তার। ভালবেসে নাম রাখলেন আশিকুর রহমান আশিক। সেই ছোট্ট আশিকুর আজ ২৫ বছরের টগবগে তরুণ। মা চাননি বাবার সাথে ছেলেটিও যাক। কিন্তু নাড়ির বাঁধন দিয়ে তিনি ওদের দ্বীনের আকর্ষণকে থামাতে পারেননি। লাল শার্ট পরে ও বাবার সাথে চলে গেল। ১০ ঘণ্টা পর যখন ফিরে এলো- তখন নির্বাক বাবা, সাথে নিথর প্রাণ আশিকুর। ওর সারাটি শরীর লাল শার্টের সাথে ম্যাচ করে কেমন রঙিন হয়ে গেছে। সেই ছোট্টবেলায় চাঁদমুখো এই শিশুকে বুকে জড়িয়ে ঠিক যেখানটাতে চুমু দিয়ে তিনি ভরিয়ে তুলতেন সেই কপালটা কেমন চূর্ণ-বিচূর্ণ!! মা জননী কেঁদে কেঁদে যার চোখের পানি প্রায় সব শেষ। হায়রে! স্বামী টগবগে ছেলেকে নিয়ে গেল, আর আসলো ...। তাই স্বামীর প্রতি শত অনুযোগ। কিন্তু যখন স্বামী সান্তনা দিয়ে বলেন, সব ফয়সালা আল্লাহর হাতে, তখন তিনি থমকে যান। কিন্তু তার অন্তরের ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যায় কষ্টের ভিসুভিয়াসের জ্বলন্ত লাভায়।

ব্যক্তিগত প্রোফাইল

নাম : শহীদ মো: আশিকুর রহমান

সংগঠনের সমর্থক ছিলেন
জন্মতারিখ : ১৯৮৮ ইং, বয়স ২৫ বছর। আহত হওয়ার তারিখ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
আহতের ধরন ও পরবর্তী অবস্থা : সরাসরি মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই শহীদ হন
শাহাদাতের তারিখ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
স্থায়ী ঠিকানা : বাড়ির নাম : গ্রাম ইমাদপুর মহুরীপাড়া, ডাকঘর: বৈরাতী, ইউনিয়ন : ১৭ নং ইমাদপুর, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর
পিতা : মো: আফতাব উদ্দীন, ৫০, দোকান ও কৃষি
মাতা : মোসাম্মৎ আঞ্জুআরা - ৪০, গৃহিণী
ভাইবোনের বিবরণ : শহীদ আশিকুর রহমান, মু: আতিকুর রহমান আপন, অনার্স ২য় বর্ষ, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর; জান্নাতুল উম্মাহ, ৯ম শ্রেণী।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আশিকুর রহমান

পিতা

মো: আফতাব উদ্দীন

মাতা

মোসাম্মৎ আঞ্জুআরা

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

২ভাই ১বোন, ১ম

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম ইমাদপুর মহুরীপাড়া, ডাকঘর: বৈরাতী, ইউনিয়ন : ১৭ নং ইমাদপুর, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর

সাংগঠনিক মান

সমর্থক

শাহাদাতের স্থান

সরাসরি মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই শহীদ হন


শহীদ আশিকুর রহমান

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আশিকুর রহমান


শহীদ আশিকুর রহমান

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আশিকুর রহমান