শহীদ খাইরুল ইসলাম

১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ - ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০০ | ১১০

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

মুসলমানতো সে ব্যক্তি যিনি তার সবকিছু আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে পারেন। কোথায় তার জন্ম? কী তার বংশ পরিচয়। এর কোনটিই এ পথের প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না। শাহাদাতের জন্য নির্ধারিত যে জীবন তাকে কী আর কোনো সংকীর্ণতা আটকে রাখতে পারে? আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তারই এবাদাত করার জন্য, তার জন্য জীবন উৎসর্গ করার জন্য। পৃথিবীতে সে সৌভাগ্যবান যুবকের সংখ্যা নিতান্তই বিরল, যারা তাদের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে তার রবের কাছে পৌঁছে গেছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম কবুল করেছেন আর শাহাদাতের অমিয় সুধা পান রে আসল ঠিকানায় চলে গেছেন শহীদ খায়রুল ইসলাম। ব্রাহ্মণ হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করে শাহাদাতের মর্যাদা পেয়ে নিজেকে ধন্য করেছেন আর কলঙ্কিত করে গেছেন ঐ সকল যুবকদের যারা মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েও আবু জাহেলদের মতো পাপের পাল্লা ভারি করেছে। দুঃখ ঐ সব নামধারী মুসলমানদের জন্য যারা ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন।

সেদিন যা ঘটেছিল
শোকাহত চট্টগ্রামবাসী। চোখে মুখে বেদনার ছাপ। মাত্র একমাসপূর্বে শহী সালাহউদ্দীনের নির্মম শাহাদাতের শোক তখনও চট্টগ্রামবাসী কেটে উঠতে পারেনি। তখনো চট্টগ্রামের বাকলিয়া, ডি.সি রোড প্রতিটি এলাকা থমথমে। অজানা আশঙ্কায় ভুগছে চট্টগ্রামবাসী। শহীদ সালাহউদ্দীনের খুনীরা পুলিশ পাহারায় ঘুরছে সর্বত্র। দু’টি পুলিশ ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে ডিসি রোডের সবখানে চলছে সন্ত্রাস। প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-যুবক তাদের নিজ নিজ বাড়ি-ঘর . ,েমে ফিরে যেতে পারছেন না এমনিতর বিভিষীকাময় পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামস্ত ডিসি রেডে কমিশনারের অফিসের সামনে আওয়ামীলীগ আয়োজন করে সমাবেশের। দিনটি ছিল মঙ্গলবার, ২২ ফেব্র“য়ারি ২০০০। হঠাৎ মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে এদিক-ওদিক দৌঁড়াতে থাকে। কয়েকজন সন্ত্রাসী একজন টগবগে যুবককে টেনে হেঁচড়ে আবদুল লতিফ লেনের ভিতর দিয়ে বগার বিলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি হচ্ছেন ডি.সি রোডের সবার প্রিয় খায়রুল ইসলাম। যাকে এক নজর দেখার সাথে সাথে কারোই চিনতে বাকি রইলো না। সন্ধ্যা আস্তে আস্তে ঘনিয়ে আসতে লাগলো। খুনী ছাত্রলীগ ক্যাডার ফরিদ-মুরাদ চক্র মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে প্রতিবাদের ভাষাটুকুও কেড়ে নেয়। নিজের জামা দিয়ে চোখ মুখ বেঁধে হীন কায়দায় কাপুরুষোচিত অপকর্ম শুরু করে খুনীচক্র। হাত-পা বেঁধে নড়াচড়াও করতে দিল না তাঁকে। মাগরিবের নামাজের পর পরই অন্ধকার যতই ঘনীভূত হতে লাগল, খুনীদের অত্যন্ত বর্বর কায়দায় খায়রুল ইসলামের উপর নির্যাতন চলতে থাকলো। তখন খায়রুল ইসলাম অতি কষ্টে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, আমি নও মুসলিম আমাকে হত্যা করো না। কিন্তু খুনীদের কর্ণকুহরে এতটুকুন মায়া লাগেনি। শহীদ খায়রুলকে বর্বর কায়দায় তলপেটে খুর দিয়ে আঘাত করে পুরুষাঙ্গ অনেকটা পৃথক করে ফেলে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে খুনীরা তার দু’ পাঁজরে গুলি করে কর্দমাক্ত বিলে ফেলে নিশ্চিন্তে পালিয়ে যায়। আর কালেমা পড়তে পড়তে রাতের অন্ধকারে খায়রুল ইসলাম পৌঁছে যান মহান প্রভুর দরবারে।


সন্ধ্যার সাথে সাথে খায়রুলের শাহাদাতের খবর পৌঁছে যায় চট্টগ্রামের প্রতিটি মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে। দলে দলে ছাত্র-জনতা ছুটে আসে চট্টগ্রাম জামায়াত কার্যালয়ে। চট্টগ্রাম মহানগরীর সেক্রেটারি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকজন বেরিয়ে পড়েন লাশের সন্ধানে। অবশেষে রাত ১০ টার দিকে বগার বিল থেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ চান্দগাঁও থানায় নিয়ে যায়।

শহীদ খায়রুল ইসলাম ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের কোতয়ালীস্থ পাথরঘাটার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে তার নাম ছিল উত্তম কুমার দে। পিতা চন্দ্রমোহন দে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৮৪ সালে ২৪ জুন বায়তুশ শরফের পীর মাওলানা আবদুল জব্বারের হাতে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন। ১৭.৭.১৯৮৪ তারিখে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এফিডেভিটের মাধ্যমে নিজের নাম রাখেন খায়রুল ইসলাম এবং বায়তুশ শরফের পীর আবদুল জব্বার সাহেবকে নিজের পিতা হিসেবে গ্রহণ করে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তাঁর তত্ত্বাবধানে থেকে ইসলামের হুকুম আহকাম শিখে নেন। ১৯৮৭ সালে খায়রুল ইসলাম চকরিয়া চলে যান। সেখানে ভেওলা গ্রামের জনৈক সিদ্দিক আহমদের বাড়িতে লজিং থেকে ’৮৮ সালে উক্ত গ্রামের ইলিশা জামিলা খাতুন উ"চবিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৯০ সালে সেখান থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের এম.ই.এস কলেজে ইন্টারে ভর্তি হন। ডিসি রোডের রফিক কলোনীতে থাকতেন। এম.ই.এস কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। শাহাদাতের পূর্বে শহীদ খায়রুল ইসলাম ডিগ্রী পরীক্ষার্থী ছিলেন এবং ডি.সি রোডের আবু সৈয়দ কলোনীর বাসিন্দা ছিলেন। টিউশনী করেই চলতেন, কলোনীর ছাত্র-ছাত্রীরা খায়রুলকে স্যার বল ডাকতো।

২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ খায়রুল ইসলাম এর লাশ পোস্টমর্টেম শেষে চট্টগ্রামের লালদিঘী চত্বরে নিয়ে আসা হলে হাজারো ছাত্র-জনতা শোকে নুইয়ে পড়ে। জামায়াত-শিবিরের কেন্দ্রীয়-স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন এসময়। জানাযায় ইমামতি করেন প্রবীণ মাওলানা মুহাম্মদ শামছুদ্দীন। জানাযা শেষে কফিন নিয়ে শহীদের হাজারো সাথী মিছিল নিয়ে ডি.সি রোডে চলে যায়। এ সময় হাজারো নারী পুরুষ শহীদকে দেখার জন্য রাস্তার ধারে-বিল্ডিংয়ের ছাদে নীরবে অশ্রুপাত করে। মিছিল শেষে দ্বিতীয় দফা জানাযায় ইমামতি করেন ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মুফতি ইজহারুল ইসলাম। নামাজ শেষে ডি.সি রোডস্ত সাবেক কমিশনার নাছির মিয়ার তত্ত্বাবধানে পারিবারিক গোরস্থানে শহীদ খায়রুল ইসলামকে দাফন করেন।

২২ ফেব্রুয়ারি এমনিতে চট্টগ্রাম মহানগরীর ছাত্র-জনতার জন্য শোকের দিন। এ দিনটি আসলে শোকের ছায়া নেমে আসে। ১৯৯৫ সালে এ দিনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্রনেতা খাইরুল ইসলামকে, আর ২০০০ সালের ঐ দিনে শহীদ হলেন নওমুসলিম খায়রুল ইসলাম। একই নামের দুই শহীদকে আল্লাহ কবুল করলেন একই দিনে, যাদের লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন। একই নাম, একই এলাকায় পড়ালেখা করে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, একজন শহীদ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন তার পিতা মাতার কাছে, যার শোকে শহীদ খাইরুলের মাতাপিতা আজও মুহ্যমান। কিন্তু আরেকজন শহীদ নওমুসলিম খায়রুল ইসলাম, যিনি পিতা-মাতার কাছে পৌঁছতে পারলেন না। কারণ শাহাদাতের পূর্বেই ত্যাগ করেছেন মুশরিক পিতামাতাকে। সন্তানের জন্য বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ার জন্য কোনো পিতামাতা না থাকলেও শহীদ খায়রুল ইসলামের জন্য কেঁদেছেন চট্টগ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। ইসলাম কবুলের সময় যাকে ভালবেসে পিতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সেই মুজাহিদ পীরে কামেল শাহ আবদুল জব্বারও চলে গেছেন জান্নাতের ওপারে। দুনিয়ার কোনো স্থানই খায়রুলের জন্য উপযুক্ত ছিল না। তাইতো তিনি চলে গেলেন জান্নাতে। জান্নাতই যে তাঁর আসল ঠিকানা।

এক নজরে শহীদ খায়রুল ইসলাম
নাম : মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
পূর্বনাম : উত্তম কুমার দে
পিতা : চন্দ্রমোহন দে
সাংগঠনিক মান : কর্মী
শহীদ হওয়ার স্থান : বগার বিল (চট্টগ্রাম)
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রলীগের খুনীচক্র
আঘাতের ধরন : খুর, ছুরি দিয়ে পেটে আঘাত, নিম্নাঙ্গে আঘাত
শহীদ হওয়ার তারিখ : ২২.০২.২০০০ ইং
যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম মহানগরী
স্থায়ী ঠিকানা : পাথরঘাটা, কোতয়ালী, চট্টগ্রাম
ভাইবোন : ৩ ভাই, ১ বোন ( তিনি ২য়)।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ খাইরুল ইসলাম

পিতা

চন্দ্রমোহন দে

জন্ম তারিখ

ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

ভাই বোন

৩ ভাই, ১ বোন ( তিনি ২য়)

স্থায়ী ঠিকানা

পাথরঘাটা, কোতয়ালী, চট্টগ্রাম

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ডিগ্রী পরীক্ষার্থী, এম.ই.এস কলেজ।

শাহাদাতের স্থান

বগার বিল (চট্টগ্রাম)


শহীদ খাইরুল ইসলাম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ খাইরুল ইসলাম


শহীদ খাইরুল ইসলাম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ খাইরুল ইসলাম