শহীদ মুহাম্মদ শাহ্ আলম

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ | ৮৩

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর থানা শহরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিল। মিছিল শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণকালে যখন বাজার চত্বরে পৌঁছে তখন ছাত্রদলের সন্ত্রাসী বাহিনী সে মিছিলে অতর্কিত হামলা চালায়। তাদের নিক্ষেপ করা বোমার আঘাতে শাহাদাৎ বরণ করলেন জামায়াত কর্মী (সাবেক শিবির কর্মী মো. আবু বকর)।

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট 
সেদিন ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬। জামায়াত কর্মী শহীদ আবু বকরের জানাযা পূর্ব সমাবেশে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় বিদেশ বিষয়ক সম্পাদক মোশারফ হোসেন মাসুদ ভাই ঘোষণা দিলেন, ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কোটচাঁদপুর ও মহেশপুরের মাটিতে হবে না। যে কোন মূল্যেই হোক না কেন এ নির্বাচন প্রতিহত করতে হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক কোটচাঁদপুর থানার সকল কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ করা সম্ভব হলো কিন্তু কাজ সেরে কোটচাঁদপুর শহরের বায়তুল মামুর মসজিদে এলে খবর আসে মহেশপুরে নির্বাচন হচ্ছে। তাৎক্ষণিক কোটচাঁদপুর থানা কর্মপরিষদ সিদ্ধান্ত নিলেন মহেশপুরের দায়িত্বশীলদের সাথে দেখা করার জন্য। মসজিদ থেকে অযু করে তিনটি মোটরসাইকেল যোগে দায়িত্বশীলরা মহেশপুর রওয়ানা হন। সিদ্ধান্ত এলো শহীদ শাহ আলম সেখানে যাবেন না। কিন্তু শহীদ হওয়ার তাড়না তাকে সেখানে যেতে বাধ্য করেছিল। শহীদ শাহ আলম নাছোড়বান্দা, তিনি যাবেনই সাথে। কিন্তু দায়িত্বশীলরা তাকে সাথে নিবেন না। সর্বশেষ তার অনুরোধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন দায়িত্বশীলরা। শহীদ শাহ আলম ভাই মোটরসাইকেলের পেছনে বসে যখন খালিশপুর স্কুল বরাবর পৌঁছলেন তখন বিএনপির সন্ত্রাসীচক্র চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল এবং আক্রমণ শুরু করল জামায়াত এবং শিবির নেতৃবৃন্দকে। কৌশলে মোটরসাইকেল যোগে অধ্যাপক মতিউর রহমান ও মাওলানা মোজাম্মেল হক চলে আসলেও শিবিরের সদর পূর্ব শাখার সভাপতি সেখানে আটকা পড়েন। মোটরসাইকেলসহ ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সন্ত্রাসীরা হঠাৎ ইট-পাটকেল দিয়ে আক্রমণ করে। বৃষ্টির মত ছোঁড়া ইটের আঘাতে সভাপতির ডান হাত ভেঙে যায় এবং মোটরসাইকেল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। তিনি দৌড়ে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান কিন্তু মোটরসাইকেলটি ওরা পুড়ে ফেলে।

শহীদ শাহ আলম জীবননগর-কালীগঞ্জ মহাসড়কের উত্তর দিকের মাঠে চলে যান, কিন্তু ইরি ধানের মাঠে কাদা থাকার কারণে কিছুক্ষণ পর আবার মহাসড়ক ধরে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তা আর হলো না, দুনিয়া ছেড়ে আরশের মালিকের ডাকে সাড়া দিয়ে মহাসুখের চির নিরাপদ স্থান জান্নাতে চলে গেলেন। মহাসড়কের পাশে ওঁৎপেতে থাকা সন্ত্রাসীদের কবলে পতিত হন। চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে লাঠি, রড, ইট দিয়ে উপর্যুপরি আঘাতের পর আঘাতে শহীদ শাহ আলম মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ফেলে রেখে যায় সন্ত্রাসীরা। খালিশপুরের পাশে বজরাপুরে অবস্থানরত শিবিরকর্মীদের কাছে খবর এলো দুর্বৃত্তরা কাকে যেন মেরে রাস্তার উপর ফেলে রেখেছে। শহীদের বন্ধু সা’দ আহমদ ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন উদ্ধার করার জন্য। সবাই বাধা দিল কিন্তু সাদ আহমদ ভাই বললেন; আমার ভাই শহীদ হয়ে যাবে আর আমরা এখানে আরাম করে বসে থাকব, এটা হয় না। এই বলে একাই চলে গেলেন। দেখলেন, শহীদ শাহ আলম রাস্তার পাশে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। কাঁধে করে মোটরসাইকেল যোগে কোটচাঁদপুর নিয়ে আসলেন। হাসপাতালে ভর্তি করলে ডাক্তাররা বললেন; আমরা পারব না। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু যিনি মহান প্রভুর সান্নিধ্য পেতে অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন তিনি আর থাকবেন কেন। পরম দয়াময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে শাহ আলমও চলে গেলেন মহা সুখের উদ্যানে।

শহীদ শাহ আলমের বন্ধু সা’দ আহমদের প্রতিক্রিয়া
শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্তের ঘটনা। কোটচাঁদপুরে বায়তুল মামুর মসজিদে সবাই ওযু করছে কিন্তু শহীদ শাহ আলম ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখে বারবার শুনা যাচ্ছিল ‘কুল্লু নাফসিন যায়িকাতুল মাউত’! এই কথাটি ৭/৮ বার উচ্চারণ করছিলেন শহীদ শাহ আলম।

কোটচাঁদপুর সাথী শাখার তৎকালীন সভাপতি মো. ছাবুরুছ ছোবহান খান-এর প্রতিক্রিয়া
১৯৯৫ সালে দায়িত্ব দেয়া হলো কোটচাঁদপুর কলেজে মিছিল করতে হবে। নেতৃত্ব দেবে শাহ আলম। মাত্র ১২ থেকে ১৪ জন নিয়ে মিছিল করলেন শাহ আলম। বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন শহীদ শাহ আলম। যার কারণে তাকে বিএনপির সন্ত্রাসীরা কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। কিন্তু শাহ আলম একাই ৫/৬ জনের মোকাবেলা করে চলে আসেন।

শহীদের একমাত্র ছোটভাই নূর আলম-এর প্রতিক্রিয়া
আমার বড় ভাই শহীদ শাহ আলমকে বলতাম, আপনার ও পথে যাওয়ার দরকার নেই, বাড়িতে চলে আসেন, সকলে মিলে একসাথে বসবাস করবো। ভাই তখন বলতেন, এ পথে চলে যদি মৃত্যু বরণ করি তাহলে শহীদ আর যদি বেঁচে থাকি তাহলে গাজী। এটা যে কুরআনের পথ, মহা সত্যের পথ। এ পথ থেকে চলে যাওয়ার কোনো রাস্তা যে দুনিয়াতে নেই। কখনো বড় ভাইকে আমরা ইসলামী ছাত্রশিবির থেকে ফেরাতে পারিনি। যখনই এর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেছি তখনই আমাদেরকে বুঝিয়েছেন কুরআন হাদীস দিয়ে। ভাই যখনই গ্রামে আসতেন গ্রামের ছেলেদেরকে বুঝাতেন ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে। ছোট ছোট ছেলেরা মারামারি, গন্ডগোল, গালাগালি করলে বড় ভাই তাদেরকে বলতেন; মারামারি, গালাগালি করা খারাপ। আল্লাহ গুনাহ দেবেন, এভাবে ছোট ছেলেদের বুঝাতেন। তাঁর আচরণে মুগ্ধ হয়ে তাঁর দাওয়াতে অনেক ছাত্র ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দেয়।

কোটচাঁদপুর সরকারি কে.এম.এইচ ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল আবদুল মোতালেব-এর প্রতিক্রিয়া
জীবনে অনেক ছাত্র দেখেছি। কিন্তু শহীদ শাহ আলমের মত সদালাপী বিনয়ী, নম্র ও ভদ্র ছেলে আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখিনি। যার আচরণের কথা কোনো শিক্ষকই কোনোদিন ভুলতে পারবে না। কিন্তু অল্প দিনের ব্যবধানে শহীদ শাহ আলম শিক্ষকদের এমনভাবে মন কেড়ে নিয়েছিলেন যা সাধারণত বিরল। শহীদ শাহ আলম হযরত ওমর (রা.) এর মত শাহাদাতের আকাংখা পোষণ করতেন। তিনি সর্বদা শহীদ হওয়ার কথা বলতেন।

কোটচাঁদপুর আলিয়া মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল আসাদুজ্জামান সাহেবের প্রতিক্রিয়া
জামায়াতে ইসলামীর কর্মী মোজাফফর শহীদ হলেন। শহীদ শাহ আলম ভাইয়ের আম্মা মারা গেলেন। তার কিছুদিন পর আমার গলা জড়িয়ে কেঁদেছিলেন আর বলেছিলেন; আমি কেন শহীদ হতে পারলাম না। হুজুর আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন, আমি যেন আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হতে পারি। তৎকালীন কোটচাঁদপুর থানা আমীর ও শহীদের শিক্ষক এবং বর্তমান ঝিনাইদহ জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা মোজাম্মেল হক বলেন; শহীদ শাহ আলম ভাই যে শাহাদাত বরণ করবেন তা তার আচরণে, কথা-বার্তায় বোঝা যেত। তার কথার মধ্যে কি এক মায়া মিশানো থাকত যারা তার সাথে কথা বলেছে, মিশেছে, তারা সবাই জানে। তিনি সর্বদা হযরত ওমর (রা.) এম মত শাহাদাতের আকাঙ্খা পোষণ করতেন।

শাহাদাতের ২/৩ মাস আগে এক দিন এশার নামায আদায় করে সাবেক মেহেরপুর জেলা শাখার সভাপতি জামায়াত নেতা মাওলানা মোজাম্মেল হককে বললেন; ভাই আমি যদি শহীদ হই আপনি কি আমার জানাজা পড়াবেন? তখন তিনি বললেন; তুমি এমন কথা বল কেন? তিনি কথাটা তেমন আমল দেননি। শহীদ শাহ আলম আবার বললেন; ভাই, আপনি বলেন সত্যি আমার জানাযা পড়াবেন কিনা? মাওলানা সাহেব বললেন, অমন কথা বলতে নাই। আল্লাহ কাকে শহীদের মর্যাদা দেবেন কাকে কবুল করবেন তা কি মানুষ বলতে পারে? শহীদ শাহ আলম ভাই জানতেন তিনি এই দুনিয়া ছেড়ে নিয়ামতের সাম্রাজ্যে চলে যাবেন। তাই তিনি বারবার নাছোড়বান্দা হয়ে জিজ্ঞাসা করছিলেন; ভাই আমি শহীদ হলে আপনি জানাযা পড়াবেন কিনা ? মাওলানা মোজাম্মেল হক হঠাৎ বলে ফেলেন; হ্যাঁ, তুমি শহীদ হলে আমি জানাযা পড়াব।

হাজারো মানুষের ঢল ও অনেক বড় বড় আলেম উপস্থিত হয়েছিলেন শহীদের জানাযায়। ঘোষণাকারী ঘোষণা করলেন আজকের শহীদ শাহ আলমের জানাযা পড়াবেন মাওলানা মোজাম্মেল হক। অনেক বড় বড় আলেমের নাম ঘোষণা করলেন না। করলেন মাওলানা মোজাম্মেল হকের কথা। মাওলানা মোজাম্মেল হক জানাযার পূর্বে জনতার উদ্দেশে, শহীদের শোকার্ত বন্ধুদের উদ্দেশে এ কথা জানিয়ে দিলেন। সবার চোখে যেন অশ্রুর ঢল নামল।

শহীদ শাহ আলমের নামে লন্ড্রি 
শহীদ শাহ আলম ভাইয়ের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য শহীদ শাহ আলমের সুধী কোটচাঁদপুর আলামপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আবদুর রাজ্জাক শহীদের নামে একটা লন্ড্রি দোকান করেছেন। প্রশ্ন করা হল, আপনি কেন দোকানের নাম শহীদ শাহ আলম লন্ড্রি রাখলেন? জবাবে তিনি বললেন; এলাকার মানুষের দাবি ছিল শহীদ শাহ আলমের দাফন হবে আলামপুরে কিন্তু শহীদের ভাই ও আত্মীয়-স্বজনরা নিজ গ্রামে নিয়ে দাফন করে। তাই শহীদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তাঁর নামে দোকান করেছি। যাতে দোকান যতদিন থাকে শহীদ শাহ আলমের নামও এলাকার মানুষ স্মরণ করে।

একনজরে শহীদ শাহ আলম
নাম : মুহাম্মদ শাহ আলম
পিতার নাম : ডা. মু. আবদুল মালিক
সাংগঠনিক মান : কর্মী
সর্বশেষ পড়াশুনা : ডিগ্রী পরীক্ষার্থী
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : কোটচাঁদপুর সরকারি কে.এম.এইচ ডিগ্রী কলেজ
আহত হওয়ার স্থান : খালিশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে
শহীদ হওয়ার স্থান : মহেশপুরের খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে পিচঢালা রোডে
আঘাতের ধরন : লাঠি, ছোরা, ইট, রড দ্বারা আঘাত
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রদল ও যুবদলের গুন্ডাবাহিনী
শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৫.০২.১৯৯৬
যে শাখার শহীদ : কোটচাঁদপুর সাথী শাখা, ঝিনাইদহ
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: গাড়াপোতা, ডাকঘর: ভৈরবা, থানা: মহেশপুর, জেলা: ঝিনাইদহ
ভাই-বোন : ২ ভাই, ১ বোন (তিনি সবার বড়)
পিতা : জীবিত, পেশা-ডাক্তার
মাতা : মরহুমা

শহীদের স্মরণীয় বাণী
‘আবু বকর শহীদ হলেন, আল্লাহ কেন আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করলেন না।’

শাহাদাতে শহীদের বাবার প্রতিক্রিয়া
‘আমার ছেলে শহীদ হয়েছে, এতে আমার কোন দুঃখ নেই, বরং সে আমাদের জান্নাত লাভের পথ সুগম করল। প্রয়োজনে আমার ছোট ছেলের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে পারি।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুহাম্মদ শাহ্ আলম

পিতা

ডা. মু. আবদুল মালিক

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

২ ভাই, ১ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম: গাড়াপোতা, ডাকঘর: ভৈরবা, থানা: মহেশপুর, জেলা: ঝিনাইদহ

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ডিগ্রী পরীক্ষার্থী, কোটচাঁদপুর সরকারি কে.এম.এইচ ডিগ্রী কলেজ

শাহাদাতের স্থান

মহেশপুরের খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে পিচঢালা রোডে


শহীদ মুহাম্মদ শাহ্ আলম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ শাহ্ আলম


শহীদ মুহাম্মদ শাহ্ আলম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ শাহ্ আলম