শহীদ আব্দুল করিম

২১ জুন ১৯৭৪ - ০৮ ডিসেম্বর ১৯৯৫ | ৭৯

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

৮ ডিসেম্বর ১৯৯৫, শুক্রবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিটি। আব্বা-আম্মাসহ আমরা বাসায় অপেক্ষায় ছিলাম কখন আব্দুল করিম বাসায় ফিরবে, সবার সাথে রাতের খাবার খাবে। কিন্তু না, মা বাবার আদরের ধন, সর্বকনিষ্ঠ সন্তানকে সাথে নিয়ে রাতের খাবার খাওয়া হল না। বরং সকলের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটল এক অপ্রত্যাশিত আকস্মিক খবরের মাধ্যমে। গ্রামের এক যুবক এসে খবর দিয়ে গেল আব্দুল করিম শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করেছেন। খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমি ও শহীদের সম্মানিত পিতা দৌড়ে গিয়ে শাহজালাল ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বে ওভার ব্রিজের ওপর শহীদ আব্দুল করিমের লাশ দেখে মনে হলো, তাঁর উপর অর্পিত মহান দায়িত্ব পালন শেষে প্রশান্তির ঘুমে শায়িত।

শাহাদাতের দিন আব্দুল করিম কদমতলী জামে মসজিদে জুমআর নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরে সম্মানিত পিতার সাথে দুপুরের খাবার সারেন। এরপর সাংগঠনিক কাজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। সিলেট শহরের শাহজালাল উপশহরের ডি-ব্লকের জামে মসজিদে এশার নামাজ জামায়াতে আদায় করেন। সাংগঠনিক কাজ সেরে রাত ১০.৩০টায় সহকর্মীদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে কদমতলীর বাসায় ফেরার পথে ইসলামের চিরশত্রু নরপশুরা আব্দুল করিমকে হত্যা করে শাহজালাল ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বে ওভার ব্রিজের উপর ফেলে রেখো যায়।

জীবনপঞ্জি
অনেক ইতিহাস ঐতিহ্যে খ্যাত আলেম-ওলামাদের সংগ্রামী জনপদ কানাইঘাট থানার ঐতিহ্যবাহী লোকালয় ঘড়াইগ্রামের আদর্শ বাড়িতেই আব্দুল করিম নামক এই শহীদি ফুল ১৯৭৪ সালের ২১ জুন, শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সম্মানিত পিতা জনাব আলহাজ আব্দুল কুদ্দুস এবং মাতা জনাবা সিদ্দিকা বেগম। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে শহীদ আব্দুল করিম ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর দাদা জনাব আব্দুল হাই এবং তাঁর পিতামহ হযরত মাওলানা ক্বারী আলহাজ্জ আব্দুল বারী একজন পীর ও বুজুর্গ ছিলেন। তিনি রশীদ আহমদ গহঙ্গী (রহঃ) এর বাংলার একমাত্র খলিফা। শহীদ আব্দুল করিমের শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার গ্রামের মসজিদে, যেখানে আজ তিনি চির নিদ্রায় শায়িত।

তিনি মাওলানা ইব্রাহীম আলী (উজানী পাড়া), মাওলানা মাহমুদ আলী (বাবন গ্রাম), মাওলানা শামসুল হক (বায়মপুর)-এর কাছে আল-কোরআন সহ ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি তার গ্রামের স্কুল মানিকগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় দ্বীনদার পরহেজগার শিক্ষক মরহুম আব্দুল লতিফের তত্ত্বাবধানে পড়াশুনা করে উক্ত বিদ্যালয় হতে ১৯৮৫ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুল বৃত্তিলাভ করেন। দি এইডেড হাই স্কুলের সকল বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সবোচ্চ নাম্বার পেয়ে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষাবিদ চৌধুরী ও তদানীন্তন জেলা প্রসাশক সহ সিলেটের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে শহীদ আব্দুল করীমকে শ্রেষ্ঠ ছাত্র ঘোষণা দিয়ে পুরস্কৃত ও তার পিতা জনাম আলহাজ্ব আব্দুল কুদ্দুসকে মাল্যদান করে সম্মানিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে দি এইডেড হাইস্কুল সিলেট থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান গ্রুপে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৯২ সালে সিলেট এম.সি. বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হতে এইচএসসি সমাপ্ত করেন এবং একই কলেজে দর্শন অনার্স ২য় বর্ষের পরীক্ষার্থী থাকাকালীন সময়ে শাহাদাত বরণ করেন।

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিপ্লবী পুরুষ শহীদ আব্দুল করিম স্কুলজীবন থেকেই ছিলেন সদা তৎপর। ১৯৯৪ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য (সর্বোচ্চ স্তর) পদ লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায়ই শহীদ আব্দুল করিম সিলেট এম.সি. বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের বলিষ্ঠ সংগঠন সম্মিলিত ছাত্র ঐক্যের কনভেনর ছিলেন। এছাড়া সিলেট শহর দক্ষিণ সুরমা ছাত্রশিবিরের সভাপতি, সিলেট শহর স্কুল বিভাগের সহকারী পরিচালক, ১০ নং উপশহর ওয়ার্ডের সভাপতি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামী আন্দোলনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত ছিলেন। দ্বীনের এই বীর মুজাহিদ দক্ষিণ সুরমার বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করেন। বিশেষ করে বিভিন্ন দাবি দাওয়া আদায়ে, বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাঁকে পাওয়া যেত সবার সামনে।

সবার চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত
সেদিন গভীর রাতে শহীদ আব্দুল করিমের শাহাদাতের খবর ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুৎবেগে বাংলাদেশের প্রতিটি শহর, নগর, গ্রামে-গঞ্জে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে লাগলো-
হত্যা করেছে ওরাই মাসুম আল্লাহর বান্দাকে
হত্যাকারীর বাহকেরা মিলে হত্যা করেছে তাঁকে

সিলেট শহরের প্রতিটি মানুষ পরিচিত অপরিচিত সবার চোখ হয়ে উঠল অশ্রুসজল। অনেকেতো বিশ্বাসই করতে চাইল না। এ খবর শুনে আন্দোলনের নেতা কর্মীরা ছুটে আসতে লাগলেন শহীদকে এক নজর দেখতে। সবার মনকে এক আকস্মাৎ ধাক্কা দিয়ে গেল এ ঘটনা। শতকরা আশি ভাগ যেখানে মুসলমান, সেখানেই রক্ত ঝরে তরুণ তাজা প্রাণের, ইসলামের পক্ষে কথা বলার জন্যে। কয়েক ঘন্টা আগেও যিনি ছিলেন কারো ছোট ভাই, প্রিয় ভাই, প্রিয় বন্ধু, সহকর্মী-শাহাদাতের মাধ্যমেই হয়ে গেলেন সবার নেতা, অগ্রসেনানী।

শাহজালাল ওভারব্রীজর উপর পড়ে থাকা সংগ্রামী পুরুষ আব্দুল করিমের রক্তাক্ত লাশের পাশে শাহাদাতের পর মুহুর্তে এসে যান শহীদের গর্বিত পিতা জনাব আলহাজ্ব আব্দুল কুদ্দুস, জেলা জামায়াতের আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান, শহর শিবিরের সভাপতি ফখরুল ইসলাম, শহীদের সহযোদ্ধারা ও তৌহিদী ছাত্র-জনতা। রাতের বেলা শহীদের লাশ যখন বসত ঘরের (কদমতলী, কুদ্দুস ভিলা) সামনে নিয়ে আসা হলো তখন আরেক আহাজারির পরিবেশ। যে মা-বাবা কলিজার টুকরো সন্তানকে কোলে কাঁধে নিয়ে লালন পালন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান বুক ভরা আশা নিয়ে-সন্তান বড় হয়ে সবার মুখে হাসি ফোটাবে, দেশ জুড়ে সুখ্যাতি অর্জন করবে, দেশ ও জাতির সেবায় এগিয়ে আসবে। কিন্তু না তা আর হলো না। পড়ন্ত বিকেলে বেরিয়ে যাওয়া আব্দুল করিম আর ঘরে ফেরেনি, মা-বাবার কোলে ফিরে আসলো তার পবিত্র কফিন, বৃদ্ধা মায়ের চোখের সামনে চূর্ণ বিচূর্ণ রক্তাক্ত মুখ, খুন রাঙ্গা বিধ্বস্ত অবয়বে প্রিয় সন্তানের লাশ। স্নেহময়ী মা কেমন করে সহ্য করবেন? সহ্য করাতো যায় না। আর তাইতো সন্তান হারা মায়ের বুক ফাটা আর্তিতে উপস্থিত বনিআদমের শোকাহত কোলাহল যেন পাথরে পরিণত হল। সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে শহীদের বৃদ্ধ পিতা-মাতা, ভাই-বোনদেরকে। কিন্তু এই শত শত মানুষের সান্ত্বনার পরও শহীদের মা আজও তার প্রিয় সন্তানকে খুঁজে বেড়ান। বৃদ্ধা মা কখনো সন্তানের কক্ষে, আবার কখনো বা পুরো বাড়ি পায়চারি করেন, কখনো বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে শাহজালাল ব্রিজের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করেন তার সোনা মানিক কখন ফিরে আসবে। কিন্তু না, মায়ের নয়নের মণি আর ফিরে আসবে না, তার অপোর আর শেষ হবে না। চোখের জল ঝরবে, ঝরতে থাকবে আজীবন।

দাফন কাফন
১ম জানাজা শেষে শহীদের লাশ নিয়ে সবাই যখন তাঁর গ্রামের বাড়ির নির্ধারিত কবরের দিকে রওয়ানা হচ্ছিলেন, তখন মা স্নেহের সন্তানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলছিলেন, .. .. বাবা করিম তুমি তোমার মাকে রেখে কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি আমাকে সঙ্গে নিবে না .. .. ..। বৃদ্ধ পিতারও আহাজারির অবসান হলো না। শাহাদাতের দুদিন পূর্বে বড় ভাই হাফেজ আব্দুর রহমানের বিয়ে হল। বিয়ের আমেজ এখনো কেটে ওঠেনি, আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনায় বাড়িটি তখনো মুখরিত। সেদিন আব্দুল করিম বড় বোন হুসনে আরা সাজ্জাদকে তাঁর স্বামীর বাড়ি বায়মপুরে নিয়ে যাবার কথা। কিন্তু না, বোনকে নিয়ে যাওয়া হল না, আর কোন দিন যাওয়া হবে না। সে বোনের সামনে আজ প্রিয় ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত লাশ। রাতের খাবার নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত যে বোনেরা (রওশন হক ও নার্গিশ) অপেক্ষা করত, তাদের প্রিয় ভাইয়ের জন্য এখন আর অপেক্ষা করতে হবে না। তাদরে ভাই কে কেড়ে নিয়েছে ইসলামের দুশমনেরা।

মাতৃভূমি সিলেট ছেড়ে বড় ভাই আলহাজ্ব মুহম্মদ আবদুর রকিব স্নেহের ভাইটিকে দেশে রেখে জীবিকার সন্ধানে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তখন শহীদ আব্দুল করিম ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। প্রবাসে অবস্থানের বছর চারেক পর তাকে শুনতে হল খুনিদের হাতে জীবন দিয়েছে তার প্রিয় ভাই আব্দুল করিম। তিনি স্বপ্ন দেখতেন তাঁর আদর্শবান ভাইটি বড় হবে, সুশিক্ষিত হবে, সমাজের একজন আদর্শ সেবক হবে, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় জীবনকে সার্থক করে তুলবে। তিনি যখন দেশে ফিরলেন তখন সিলেট এয়ারপোর্ট পিতাসহ পরিবারের সবাই আসলেন, কিন্তু স্নেহের ভাই আব্দুল করিমতো আর আসেনি।

নোবেল ও তান্নি নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে আজও খুঁজে ফিরে তাদের ছোট মামাকে-যে মামা তাদেরকে কোলে তুলে নিত, আদর করতো, চুমু দিত, বেড়াতে নিয়ে যেত, মিষ্টি কিনে দিত। মামা হারা মাসুম দুটি সন্তান আজও কেঁদে ফিরে, কিন্তু ফিরে পাবে না তাদের আদরের মামাকে। আর কোলে নিবে না, আদর করবে না, আর কখনও দেখতে যাবে না তাদের বাড়িতে। সে পাড়ি জমিয়েছে পরপারে, জান্নাতুল ফেরদাউসে। ফুটন্ত একটি গোলাপ অকালেই ঝরে যাবে, তা কারো কাম্য ছিল না। কেন অকালে ঝরে গেল মেধাবী এক ছাত্রের জীবন প্রদীপ, যাকে পাওয়া যেত অধিকার আদায় আন্দোলনে-সংগ্রামীদের মাঝে, রাজপথে রক্ত ঝরা ময়দানে।

প্রতিক্রিয়া
মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা ও সিলেটের দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত, প্রতিক্ষায় থাকি বিপ্লব- নামক বিশেষ ক্রোড়পত্রে সিলেট শহর শিবিরের তৎকালীন সভাপতি মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম লিখেন, শহীদ আব্দুল করিম সিলেটের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া এক প্রদীপ্ত তারকা। তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। কঠিন মুহুর্তে ধৈর্য ধারণ ও সাহসিকতায় তিনি ছিলেন অনন্য।

আব্দুল কাদের 
একই ক্রোড়পত্রে দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকায় কর্মরত, সাংবাদিক আব্দুল কাদের তাপাদার লিখেন,- একজন সত্যবাদী, একজন আমানতদার, একজন বাগ্মী, একজন গবেষক এবং একজন প্রকৃত মুমিনের নাম-শহীদ আব্দুল করিম। অসাধারণ সত্যবাদী ছিলেন তিনি। মিথ্যা কথা শুনতেই পারতেন না। অন্যায়কে সহ্য করতে পারতেন না। জনাব আব্দুল কাদের তাপাদার আরও লিখেন,- ধৈর্য কাকে বলে শহীদ আব্দুল করিমের নিকট থেকে শিক্ষা পেয়েছে আমাদের মতো অনেকেই। তিনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল তরুণ। উদ্ভাবনী শক্তি ছিল তার প্রখর।

সেলিম মুহাম্মদ আলী আসগর
ইসলামী ছাত্রশিবির সিলেট শহর শাখার তৎকালীন সাংগঠনিক স¤পাদক সেলিম মুহাম্মদ আলী আসগর অনুভবের অলিন্দে নামক স্মৃতি সংকলনে লিখেন- পারিবারিক সূত্র ধরেই শহীদ আব্দুল করিম ইসলামের প্রতি অনুরাগী ও নিবেদিত ছিলেন। অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ় ঈমানদার, অমায়িক, ধৈর্যশীল, মেধাবী, হাস্যোজ্জ্বল শহীদ আব্দুল করিম একজন সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাইতো কলেজে পা রাখতে না রাখতেই শহীদ আব্দুল করিম সংগঠনের সদস্য হয়েছিলেন। তিনি শুধু একজন সদস্যই ছিলেন না, একজন নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিও ছিলেন। সব সময় তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। সদালাপী শহীদ আব্দুল করিম ভাইয়ের নেতৃত্বে দক্ষিণ সুরমার পাড়ায় মহল্লায় আন্দোলনের কাজ বিস্তৃত ও মজবুত হয়েছিল। কাজের লোক শহীদ আব্দুল করিম ভাই শাহজালাল উপশহরকে শিবিরের মজবুত সংগঠনে পরিণত করার লক্ষ্যে নিরলস কাজ শুরু করেন। করিম ভাইয়ের পদস্পর্শে উপশহরের মাটি যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। ধূসর মরুভূমিতে যেন ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হতে শুরু করল।


সেলিম মুহাম্মদ আলী আসগর আরোও লিখেন
শহীদ আব্দুল করিম আমাদের সামনে যে আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা আমাদেরকে অনুসরণ করতে হবে।

একঃ শহীদ আব্দুল করিম অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। বাতিলের রক্তচক্ষুকে তিনি কোন দিন তোয়াক্কা করেননি। স্বাস্থ্যের দিক থেকে হালকা পাতলা করিম ভাই দুর্যোগে, কঠিন মুহূর্তে সবার সামনে থাকতেন। টেনশনে আমি তাঁকে কোন দিনও ঘাবড়াতে কিংবা পিছাতে দেখিনি।
দুইঃ স্পষ্টভাষী করিম ভাই কোন কথা বলার থাকলে সামনা সামনিই বলতেন। গীবতের আশ্রয় গ্রহণ করতেননা। দরদভরা মন নিয়ে এহতেসাব করতেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হলে থাকাকালীন সময়ে একদিন করিম ভাই নিজ উদ্যোগে হলে এসে আমাকে অনেক কথাই বলেছিলেন। তাঁর আন্তরিকতা এবং প্রজ্ঞার পরিচয় আমি সেদিন পেয়েছিলাম।
তিনঃ বৈঠকে বসলে করিম ভাইয়ের কথা খুবই মনে পড়ে। তাঁর সুচিন্তিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ অগ্রাহ্য করার সুযোগ খুব কমই পাওয়া যেত। পরামর্শ আর কথা দিয়ে করিম ভাই বৈঠককে প্রাণবন্ত করে তুলতেন।
চারঃ নীতি ও শৃঙ্খলার প্রতি করিমভাই আপোষহীন ছিলেন। মাঝে মধ্যে একটু অনিয়ম হলে রাগ করতেন। তবে তা ভিতরে রাখতেন না। একটু পরেই অত্যন্ত স্বাভাবিক ও অমায়িক হয়ে যেতেন। হৃদয় দিয়ে অপর ভাইদের ভালবাসতেন। শাহাদাতের ১৫-২০ দিন আগের ঘটনা। একটি জরুরি দায়িত্বশীল বৈঠক ছিল। কিন্তু ঘটনাক্রমে করিম ভাই দাওয়াত পাননি। রাস্তায় খবর পেয়ে বৈঠকে চলে আসেন। দাওয়াত না দেয়াতে একটু রাগ ও অভিমান করেছিলেন। বৈঠক শেষে আলাপ করছিলাম, অত্যন্ত হাসিমুখে উত্তর দিলেন করিমভাই। দায়িত্বশীল বৈঠকের গুরুত্ব এবং দাওয়াত দানের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এতে তার দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
পাঁচঃ শহীদ আব্দুল করিম ভাই অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। তুলনামূলক দুর্বল শরীর নিয়েও সারাদিন বিশ্রামহীনভাবে পেরেশানীর সাথে তাঁকে সাংগঠনিক কাজ করতে দেখেছি।
ছয়ঃ শহীদ আব্দুল করিম ভাই উন্নত আমলের অধিকারী ছিলেন। ফজরের সময় সবার আগে উঠে বাসার সবাইকে ডেকে তুলতেন। আব্বার দরজার সামনে গিয়ে কড়া নাড়তেন। শাহাদাতের পরের দিন শহীদ আব্দুল করিম ভাইয়ের সম্মানিত পিতা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেছিলেন-এখন আমারে ফজরর সময় কে ডাকবে? আমার ছেলে আমারে ফজরের সময় ডাকিয়া তুলত।
সাতঃ অপসংস্কৃতির বিরোধী ছিলেন শহীদ করিম ভাই। করিম ভাইয়ের আব্বার সাথে আলাপ করে জানলাম, বাসায় নাটক বা অন্য কিছু চলাকালীন অবস্থায় নিজ হাতে টিভি বন্ধ করে দিতেন।
আটঃ শহীদ আব্দুল করিম মনের মধ্যে গভীরভাবে শাহাদাতের তামান্না পোষণ করতেন। পরীক্ষার পর মুহূর্তেও কাজে ব্যস্ত থাকতেন। শাহাদাতের পূর্বে প্রায়ই করিম ভাই ঘনিষ্ঠজনের কাছে শাহাদাতের তামান্না ব্যক্ত করেছেন।

সৈয়দ তোফায়েল হোসেন
ইসলামী ছাত্রশিবির এম.সি. কলেজ শাখার সাবেক সভাপতি সৈয়দ তোয়ায়েল হোসেন অনুভবের অলিন্দে বইয়ে লিখেন - শহীদ আব্দুল করিম অত্যন্ত পরিশ্রমী ও বিচক্ষণ ছিলেন। সহজ সরলভাবে সে চলাফেরা করত। রিক্সায় চড়ে ও পায়ে হেঁটেই ইসলামী আন্দোলনের কাজ করতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। শহীদ আব্দুল করিমকে অনেক চেষ্টা করেও শার্ট ইন করাতে পারিনি।

মনজুর হোসেন খান
দক্ষিণ সুরমার পাঠানপাড়া খানবাড়ি নিবাসী, মাদ্রাসা শিক্ষক মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান অনুভবের অলিন্দে বইয়ে লিখেন, শহীদ আব্দুল করিম এক সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশের সন্তান ছিলেন। সেই সাথে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তাঁর মেধার গুনে সহজেই জাগতিক সুখ-আনন্দ উপভোগ ও বিলাসী হতে পারতেন। কিন্তু না, শহীদ আব্দুল করিম তা পছন্দ করেননি বরং সত্য সাধনার এক কঠিন শপথ বেছে নিয়েছিলেন।

পিতা-মাতার প্রতিক্রিয়া
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের তৎকালীন কেন্দ্রীয় এসিস্টেন্ট সেক্রেটারি জেনারেল জনাব মকবুল আহমদ ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাবেক সংসদীয় দলের নেতা ও এসিসটেন্ট সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মুজিবুর রহমান আমাদের বাসায় এসে সান্ত্বনা দেয়ার প্রাক্কালে নেতৃবৃন্দের সান্তনার জবাবে শহীদ আব্দুল করিমের পিতা-মাতা বলেন, শহীদের মা-বাবা হিসেবে আমাদের কামনা এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক। এক ছেলেকে হারিয়ে লক্ষ লক্ষ সন্তানের মা বাবা হওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান ও সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হামিদ হোসাইন আজাদের সান্তনার জবাবে শহীদের বৃদ্ধা মা বলেন - এ দেশে আর কত মায়ের বুক এভাবে খালি করে কলিজার টুকরো সন্তানেরা লাশ হয়ে বাসায় আসবে। হত্যাকারীকে কি প্রশাসন চিনে না, ওদের সামনে কি সবাই অসহায়? শহীদ আব্দুল করিমের মাও প্রশ্নের জবাব জানতে চান, জানতে চান এই ঘৃণ্য পশুচক্রের সামনে কি কর্তৃপক্ষ অসহায়? আজ শহীদ পরিবার বুঝতে পেরেছে, আজকের সম্বিত হারা মুসলিম জাতিকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন শাহাদাতের তাজা খুন। যে দিন অগণিত স্ত্রীদের বিলাপ, তাদের ইয়াতিম বাচ্চাদের আর্তনাদ, আর সন্তান হারা পিতা-মাতার আহাজারি আল্লাহর আরশে মাতম তুলবে, সে দিনই রচিত হবে আর একটি নতুন পৃথিবীর ভিত্তি প্রস্তর।


একনজরে শহীদ পরিচিতি
নাম : মোহাম্মদ আব্দুল করিম
পিতার নাম : মোহাম্মাদ আব্দুল কুদ্দুস
মাতার নাম : সিদ্দিকা বেগম
জন্ম : ২১ জুন ১৯৭৪ ইংরেজি
সাংগঠনিক মান : সদস্য
দায়িত্ব : ১০ নং উপশহর ওয়ার্ড সভাপতি, সিলেট শহর
সর্বশেষ পড়াশুনা : সম্মান ২য় বর্ষ, দর্শন
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : এমসি কলেজ
শিক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব : প্রাথমিক বৃত্তি, এসএসসি এইচএসসি কৃতিত্বের সাথে পাস
আহত হওয়ার স্থান : শাহজালাল ব্রিজের উপর (দিন প্রান্তে ওভার ব্রিজ)
আঘাতের ধরন : ছোরা ও শ্বাসরোধ করে
যাদের আঘাতে নিহত : ছাত্রদল
শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৮.১২.১৯৯৫ রাত ১১ টা ৪৫ মিনিট
কবরস্থান : যেখানে গ্রামের বড়ীতে পারিবারিক গোরস্থানে
প্রিয় শখ : সবসময় সাংগঠনিক কাজে নিজেকে নিয়োজিতী করা।
যে শাখার শহীদ : সিলেট মহানগরী
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : গড়াইগ্রাম ডাক. মানিকগঞ্জ বাজার, থানা কানাইঘাট, সিলেট
ভাই বোন : ৪ ভাই ৩ বোন
ভাইদের মাঝে অবস্থান : ৪র্থ
ভাইবোনদের মাঝে অবস্থান : ৭ম
পরিবারে মোট সদস্য : ৯ জন
পিতা : জীবিত, পেশা ব্যবসা
মাতা : জীবিত, পেশা ব্যবসা

শহীদের স্মরনীয় বাণী
স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, শাহাদাতেই আমার কাম্য। আমার বড় সাধ আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার। মা, আমি যদি শহীদ হয়ে যাই তুমি কেঁদ না, তুমি হবে শহীদের গর্বিত মা।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আব্দুল করিম

পিতা

মোহাম্মাদ আব্দুল কুদ্দুস

মাতা

সিদ্দিকা বেগম

জন্ম তারিখ

জুন ২১, ১৯৭৪

ভাই বোন

৪ ভাই ৩ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : গড়াইগ্রাম ডাক. মানিকগঞ্জ বাজার, থানা কানাইঘাট, সিলেট

সাংগঠনিক মান

সদস্য

সর্বশেষ পড়ালেখা

সম্মান ২য় বর্ষ, দর্শন, এমসি কলেজ

শাহাদাতের স্থান

শাহজালাল ব্রিজের উপর


শহীদ আব্দুল করিম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল করিম


শহীদ আব্দুল করিম

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল করিম