শহীদ মুহাম্মদ ফজলে এলাহী

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ০৩ ডিসেম্বর ১৯৯৫ | ৭৮

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

শাহাদাত একটি পবিত্রতম শব্দ। সকল মানুষের কাছে শহীদগণ সুউচ্চ মর্যাদায় সমাসীন। মুসলিম, অমুসলিম, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কোন মানুষই শাহাদাত বা শহীদ শব্দটিতে বিশেষ আবেগ অনুভূতিতে উচ্ছ্বসিত হয়। মানুষ যতকিছুকে ভালবাসে তার মধ্যে সব চাইতে প্রিয় বস্তু হচ্ছে নিজেরর জীবন। সে জীবনকে কোন কিছুর জন্য অকাতরে বিলিয়ে দেয়া সহজ কথা নয়। তাই মানুষ যে জিনিসটির জন্য নিজের জীবনকে অকাতরে বিসর্জন দেয় নিঃসন্দেহে সে উদ্দেশ্যটি অনেক মহৎ, অনেক বড় এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। এজন্যই যে উদ্দেশ্য মানুষ শহীদ হয় সে উদ্দেশ্যের সাথে সাথে একাত্ম সকল মানুষই শহীদকে সবচাইতে বেশি সম্মান করে মর্যাদায় দেয়।

শহীদ ফজলে এলাহী তেমনি একটি প্রাণ, একটি প্রেরণা, একটি জীবন, একটি প্রত্যয়, একটি জিহাদি ঘোষণা, একটি বিপ্লব। শহীদ ফজলে এলাহীর প্রতি ফোঁটা রক্ত লক্ষ্মীপুরের ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর অনুপ্রেরণার জন্য এক বিস্ফোরণমোখ বারুদের ভূমিকা পালন করবে। যে স্মৃতি বেদনা দেয়, অনুপ্রেরণা যোগায় এবং বিপ্লবের জন্য উদ্ধুদ্ধ করে।” আমার ১২ বছরের সক্রিয় সাংগঠনিক জীবনের অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য স্মৃতির মাঝে শহীদ ফজলে এলাহীর শাহাদাত স্মৃতি সবচাইতে স্মরণীয়।

শিবির অফিসে হামলা করে শহীদ করা হল ফজলে এলাহীকে
শহীদ প্রিন্সিপাল আব্দুল জাব্বার এবং শহীদ প্রফেসর তারিকুল্লাহর রক্তে ভেজা পুন্যভূমি লক্ষ্মীপুরের সবুজ জমিনে আজও তাদের উত্তরসূরিদের শোণিত প্রবাহিত হচ্ছে। আলোমুখী উইপোকার ন্যায় নতুন প্রজন্মের মুক্তিপাগল তরুণ যুবকেরা একে একে শামিল হচ্ছে শহীদি মিছিলের রক্তিম সারিতে। সেই মিছিলের গর্বিত অগ্রসেনানী শহীদ ফজলে এলাহী যিনি ১৯৯৫ সালে ৩ ডিসেম্বর শাহাদাত বরণ করেন। ইসলামী জাতীয়তাবাদী শক্তির মাঝে একটা অঘোষিত মেরুকরণ সৃষ্টি হয়। যা ছিল সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। অবশ্য ছাত্র অঙ্গন থেকে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনতার হৃদয়ের মধ্যমণি ইসলামী ছাত্রশিবিরেকে অন্যায়ভাবে প্রতিহত করার বেআইনি কাজটি পাঁচানব্বই সালে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে অনেক আগেই।

বাবার প্রতিক্রিয়া
আমার ছেলে সব সময় বলতো আমার জন্যে কোনো চিন্তা করবেন না, দোয়া করবেন আমি যেন শহীদ হতে পারি। আশির দশকের শুরু দিকে লক্ষ্মীপুর কলেজ এবং শহর এলাকায় ইসলামী ছাত্র শিবিরে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সারাদেশ শিবিরের এই positive আত্মপ্রকাশকে বন্ধু সংগঠনগুলো কেউই সহজে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু সকল বিরোধিতা, সমালোচনা এবং রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শিবিরে ন্যায়,সত্য ও কোরবানির আলোকময় পথে দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যেতে থাকে। ফলত: শিবিরের পতাকাতলে মেধাবী এবং চরিত্রবান ছাত্রদের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটে। প্রতিপক্ষ বন্ধু সংগঠনগুলো রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় শিবিরে পেছনে পড়ে যাওয়ায় অগণতান্ত্রিকভাবে শিবির ঠেকানো স্লোগান দিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ১৯৮১ সালে লক্ষ্মীপুর কলেজ সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে আসাতে তদানীন্তন সময়ে সারাদেশে প্রচণ্ড প্রতাপশালী মার্কসবাদী, লেনিনবাদী ছাত্র সংগঠন জাসদ ছাত্রলীগ শিবিরের উপর এক হিংসাত্মক হামলা চালায় কিন্তু শিবির কর্মীদের ঈমানী শক্তির সম্মিলিত প্রতিরোধের মুুখে জাসদ ছাত্রলীগ সেদিনের শুধু মাঠই ছাড়েনি বরং রাজনৈতিক যৌবনও হারিয়ে ফেলে যা আজও ফিরে পায়নি। নব্বইর দশকে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার সুবাদে জাতীয়বাতাবদী ছাত্রদল লক্ষ্মীপুর কলেজে তাদের সংগঠনকে মজবুত করার প্রয়াস পায়। কিন্তু একক আধিপত্য বিস্তার করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।

মাঝখানে বাধার প্রাচীর মনে করে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে শিবির অবিচল থাকায় যুক্তির পরিবের্ত শক্তি প্রয়োগের আশ্রয় গ্রহণ করে ছাত্রদল। শক্তি প্রয়োগের গতিধারায় শুরু হয় শিবির কর্মীদের উপর হামলা মামলা, জুলুমে নির্যাতনের স্টিম রোলার। শিবিরের সাবেক জেলা সভাপতিদ্বয়যথাক্রমে আ. ন ম, আবুল খায়ের ও নাছির উদ্দীন মাহমুদ এবং শিবির নেতা হুমায়ুন কবির, ওমর ফারুক, এনামুল হক রতন, বাহার হোসেনসেহ অন্তত দেড়শতাধিক নেতাাকর্মী বিএনপির ৪/৫ বছরে শাসনামলে মারাত্মক আহত হন। পাশাপাশি আত্মরক্ষার নৈতিক অদিকার থাকায় শিবির কর্মীরাও সম্ভাব্য বিরোধ গড়ে তোলে। এভাবে ক্রমান্বয়ে লক্ষ্মীপুরে রাজনৈতিক আকাশে দুর্যোগের ঘটনায় নেমে আসেন সময় গড়াতে গড়াতে চলে আসে ১৯৯৫ সাল। তখন সারা দেশে চলছে তীব্র সরকার বিরোধী আন্দোলন "কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা" প্রশ্নে সারা দেশের মত লক্ষ্মীপুরেও শিবির রাজপথের অপরিহার্য শক্তি হিসেবে কাজ করছিল।

চার বছরে মারখাওয়া পোড়খাওয়া বিক্ষুব্ধ শিবির কর্মীদের সুশৃঙ্খল আন্দোলন দেখে শিবিরকে নিঃশেষ করার পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৯৫ সালে ৩ ডিসেম্বর বিরাট মিছিল হতে শিবিরে জেল অফিসে হামলা চালানো হয। অফিসে অবস্থানরত ২০/৩০ জন শিবিরে জিন্দাদিল মুজাহিদ অসীম সাহসিকতার সাথে হামলা মোকাবেলা করতে থাকেন। মুহূর্তেই ঘটনা লক্ষ্মীপুর শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আসে অবস্থানরত কয়েকজনের মধ্যে শিবির কর্মীদের প্রেরণার উৎস শহীদ ফজলে এলাহী ও ছিলেন। তুমুল সংঘর্ষের এক পর্যায়ে ফজলে এলাহী রড, হকিস্টিক ও ধারালো ছুরির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। রক্তে ভেসে যায় শিবিরে অফিসের সম্মুখস্থল পিচঢালা কালো পথ।মুমূর্ষু ফজলে এলাহীকে কয়েকজন শিবির কর্মী মিলে নিয়ে যায় সদর হাসপাতালে তার চিকিৎসার জন্য জীবন বাঁচানোর জন্য। কিন্তু সেখানেও একই বর্বরতা, হামলা হলো হাসপাতালে। প্রচণ্ড বোমা বিস্কোরণ, ভাঙচুর হামলার এক নজিরবিহীন তাণ্ডবে আরো ৭/৮ জন মারাত্মক আহত হয়। ফজলে এলাহীও দ্বিতীয়বারের মত আহত হন। তাকে ঢাকায় স্থানান্তরের জন্য গাড়িতে উঠাতে না উঠাতেই ডাক্তার ঘোষণা দেন ফজলে এলাহী নেই। চলে গেলেন ওপারে, জান্নাতের সিঁড়িতে ইমাম হোসেইনের সঙ্গী হয়ে মুহূর্তের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসলেও শিবির কর্মীদের চোখের পানি নিমিষেই সংবরিত হয়ে গেল। ফজলে এলাহী শাহাদাতের শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথ নিল সবাই।

শহীদ ফজলে এলাহী মায়ের অনুভূতি
আমার ছেলের মেধা খুব ভাল ছিল। মাত্র ৬ বছর বয়সে কুরআন পড়া শিখেছে। প্রথম জীবনে তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ছি। স্কুল চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে তারপর টুমচর ও লক্ষ্মীপুর আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়। স্বভাব চরিত্র খুব ভাল ছিল এবং লেখাপড়ার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল বলে তার বাবা তাকে খুব ভালবাসত এবং সবসময় সাথে সাথে রাখতো। সব সময় পাঞ্জাবি পরা পছন্দ করতে ফযলে এলাহী কাঁঠাল, গরুর ও মুরগির গোস্ত পছন্দ করত। শাহাদাতের কয়েক দিন পূর্বে ওর নানা বাড়িতে গিয়েছিল। তার পরনে লুঙ্গী ছিল লুঈী টাকনু গিরার নিচে দেখে ওর নানা ওকে টাকনুর নিচে পোশাক পরা যাবেনা বলে। বলার পর আর কোন দিন টাকনুর নিচে কাপড় পরেনি। গ্রামের মানুষও খুব ভালবাসত। ভাই বোনদের সাথে এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে ভালো ব্যবহার করতো। সে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করত।

শেষ বিদায়
সে দিন আমি ফজলে এলাহীর নানার বাড়িতে ছিলাম। ও বাড়িতে এসে আমাকে না পেয়ে বড় বোনের বাড়িতে গিয়েছিল। দু’ভাই বোন জীবনের শেষ কথা বলল। পরে তার নানা বাড়ি আসল। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম বাবা তুমি কি লক্ষ্মীপুর থেকে এসেছে? জবাবে সে বলর জি মা! লক্ষ্মীপুর থেকে এসেছি। ঢাকা যাব, মাস্টার্সে ভর্তি হওযার জন্য টাকা লাগবে। আমার সাথে কথা বলে নানা বাড়ি থেকে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বড় ভাইদের শ্বশুর বাড়ি গিয়েছে। সেখানেও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার নানা বাড়ি এসেছে। তারপর সে বলল মা তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ভাত দাও! আমি তাকে পোয়া মাছ দিয়ে ভাত দিয়েছি কারণ তার পোয়া মাছ খুব পছন্দ ছিল। ভাত খাওয়ার পর সাদা পায়জামা পরে সে আমার কাছ থেকে ১৭০০ টাকা নিয়ে বিদায় নিল। আমি তাকে বললাম এই টাকায় তোমার হবে সে বলল হবে এবং সে শেষ বিদায় নিয়ে চলে গেল। সে যখন আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে গেল তখন আমার কাছে কেমন যেন লাগছে। আমি বলে প্রকাশ করতে পারছি না। প্রায় ১ মাস পর তার শহীদ লাশ বাড়ি নিয়ে আসে। তারপর আমার ছেলে ওয়ালিউল্লাহ এসে আমাকে খবর না বলে তার ভাবীকে খবর বলে। তার মৃত্যুখবর শুনে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। আমার ছেলে ফজলে এলাহীর জন্মগ্রহণ করার পূর্বে ওর বাবা স্বপ্নে দেখছে পূর্ব দিকে চাঁদ উঠেছে। চাঁদের নাম রেখেছে ফজলে এলাহী। সে স্বপ্নে দেখা অনুযায়ী তার বাবা তার নাম রেখেছে ফজলে এলাহী। আমার বাবাকে আল্লাহ কবুল করেছেন, তার পথে শহীদ করেছেন আমি একজন শহীদের মা হিসেবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। তোমরা যারা ফজলে এলাহীর সাথীরা বেঁচে আছ যে উদ্দেশ্যে সে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আজ তোমাদের কাছেই রইল। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার দ্বীনের জন্য কবুল করুন। আমীন

একনজরে শহীদ পরিচিতি
নাম : মুহাম্মদ ফজলে এলাহী
পিতার নাম : মুহাম্মদ মমতাজ উদ্দীন
সাংগঠনিক মান : কর্মী
দায়িত্ব : উপশাখা সভাপতি
সর্বশেষ পড়াশুনা : এমএ ১ম পর্ব, ইসলামিক স্টাডিজ, কামিল ফলপ্রার্থী
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
অন্যান্য কৃতিত্ব : ভালো শিল্পী ছিলেন
জীবনের লক্ষ্য কী ছিল : শিক্ষকতা
আহত হওয়ার স্থান: লক্ষ্মীপুর শহরের চক বাজারে শিবিরে কার্যালয়ের সামনে
শহীদ হওয়ার স্থান : লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল
আঘাতে ধরন : চাইনিজ কুড়াল লাঠি ও রড
যাদের আঘাতে নিহত : বিএনপি দলীয় এমপি খাইরুল এনামের নেতৃত্বে ছাত্রদল
শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৩-১২-১৯৯৫ রাত ৮টা
যে শাখার শহীদ : লক্ষ্মীপুর জেলা
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: চরগোঁসাইন, পো: বিবিরহাট, থানা: রামগতি, জেলা লক্ষ্মীপুর
ভাই বোন : ৫ ভাই ৫ বোন
ভাইদের মাঝে অবস্থাান : ৩য়
ভাইবোদের মাঝে অবস্থান : ৮ম
পারিবরের মোট সদস্য : ১১ জন
পিতা : মৃত
মাতা : জীবিত, পেশা; গৃহিণী
কততম শহীদ : ৭৮

শাহাদাতের শহীদের মাতার প্রতিক্রিয়া
আমার ছেলে সব সময় বলতো আমার জন্যে কান চিন্তা করবেন না, দোয়া করবেন আমি যেন শহীদ হতে পারি।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুহাম্মদ ফজলে এলাহী

পিতা

মুহাম্মদ মমতাজ উদ্দীন

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৫ ভাই ৫ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম: চরগোঁসাইন, পো: বিবিরহাট, থানা: রামগতি, জেলা লক্ষ্মীপুর

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

এমএ ১ম পর্ব, ইসলামিক স্টাডিজ, কামিল ফলপ্রার্থী

শাহাদাতের স্থান

আহত হওয়ার স্থান: লক্ষ্মীপুর শহরের চক বাজারে শিবিরে কার্যালয়ের সামনে, শহীদ হওয়ার স্থান : লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতাল


শহীদ মুহাম্মদ ফজলে এলাহী

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ ফজলে এলাহী


শহীদ মুহাম্মদ ফজলে এলাহী

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ ফজলে এলাহী