শহীদ একরামুল হক

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ০৫ জুন ১৯৯৫ | ৭৪

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র। শাহজালাল হলের গেস্টরুমে পাঠচক্রের প্রোগ্রাম। পাঠচক্রের সদস্যদের সাথে একে অপরের পরিচয় হচ্ছে। কার-বাড়ি কোথায় কোন সাবজেক্টে পড়াশুনা আমার ও একরাম ভাইয়ের পরিচয় জানার পর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছাকাছি বসলাম। কারণ দুজনের বাড়ি একই জেলায় আবার দুজনের বিভাগীয় অফিসও পাশাপাশি। উল্লেখ্য আমি দর্শন বিভাগের ছাত্র আর একরাম ভাই ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। পাঠচক্রের প্রোগ্রাম যথাযথ সময়ে শেষ হওয়ার পর দু’জনে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হল। ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক, বিশেষ করে ফেনী জেলার কাজকর্মের ব্যাপারে।

এরপর থেকেই একরাম ভাইকে ফ্যাকাল্টিতে দেখলেই কাছে ছুটে যেতাম। প্রথম আলাপেই কেমন যেন ভক্ত হয়ে গেলাম। তিনি যদিও আমার এক বৎসরের সিনিয়র ছিলেন তবুও দু’জন বন্ধুর মতো ব্যবহার করতাম। উনি আমান বাজারে লজিং থাকতেন এবং সাংগঠনিক দায়িত্ব সেখানেই পালন করতেন তাই কোন প্রোগ্রাম উপলক্ষে বা ফ্যাকাল্টিতে ক্লাসের ফাঁকে দেখা হতো। দেখা হলেই কাছে ছুটে যেতাম। এ বিশাল হৃদয়ের মানুষটার কাছে গেলে মনে হতো অনেক দুঃখের কথা ভুলে যেতাম। মনে বড় সান্ত্বনা পেতাম হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটা দেখে এবং সাহস পেতাম দৃঢ় চিত্তের ব্যক্তিত্ব দেখে। অপূর্ব সাহসী ছিলেন সদস্য প্রার্থী হয়েছে শুনে কোলাকুলি করলেন। অনার্স পরীক্ষা এবং পারিবারিক কিছু সমস্যার কারণে তিনি সদস্য হতে পারেননি এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলতেন, “এগিয়ে যান তাড়াতাড়ি সদস্য হয়ে যাওয়া দরকার। পারিবারিক সমস্যার কারণে আমি তো পারলাম না” আমি বললাম, কেন কী হল সময়তো এখনো আছে। তিনি একটু হেসে বললেন কই আর সময়! অনার্সের রেজাল্ট হয়ে গেছে ইতোমধ্যে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, কয় দিন পর মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হবে। তাছাড়া পারিবারিক অনেক সমস্যা। অনার্সের রেজাল্ট এর কথা শুনে কি রেজাল্ট জিজ্ঞাসা করতেই হেসে বললেন, এই দুই ডান্ডা আর কি, সাথে সাথে তার এক বন্ধু (এই মুহূর্তে নামটি স্মরণে আসছে না) বললেন সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়েছে। আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রস করে বললেন তখন স্যার স্যার বলে আমরা পেছনে পেছনে হাঁটবো। একরাম ভাই দুষ্টুমি করে বললেন, “আমি বেতন নিয়ে তোমাদের পিটাব” এটা বলেই অট্টহাসি দিয়ে আমার সাথে হাত মিলিয়ে বিদায় নিলেন দু’জন। এভাবে মাঝে মধ্যে দেখা হতো, কথা হতো।

আরেক দিনের ঘটনা। একদিন ফ্যাকাল্টিতে দেখা হল তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামছেনএবং আমি উঠছি এমন সময় জড়িয়ে ধরলেন। বললেন শুনেছি সদস্য হয়েছেন এবং হল সেক্রেটারি। আমি বললাম সে তো অনেক পুরোনো কথা, তবে আপনি তো কি ব্যাপারে ছাত্রজীবন শেষ করলেন নাকি? তিনি একটু হেসে স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে বললে হ্যাঁ মাস্টার্স পরীক্ষা এই তো শেষ করলাম। আমি বললাম তাতো জানি আমি সাংগঠনিক ছাত্রজীবনের কথা বলছি। তাঁর পারিবারিক সমস্যার কথা জানতাম বলে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে বললাম এখন কি করার চিন্তা করছেন। উত্তরে বললেন, দেখা যাক, আপাতত বাড়িতে আছি। একটা কলেজে ঢুকার চেষ্টা করছি। বললাম কি ব্যাপার এম.ফিল করবেন না? তিনি একটু হেসে বললেন দেখা যাক রেজাল্ট এর তো অনেক দিন বাকি এ সময়টায় কিছু একটা করি। আমিও তখন বললাম আসলে সুযোগ পেলে ঢুকে যাওয়া দরকার। তিনি বললেন দোয়া করবেন। এটা বলেই হাত মিলালেন, কে জানতো এটাই ছিলো একরাম ভাইয়ের সাথে আমার জীবনের শেষ দেখা।

যদি জানতাম তাহলে সে দিন তাঁকে ছাড়তাম না প্রাণ ভরে আরো কথা বলতাম যার কোন শেষ হতো না। এর কয়দিন পরেই আবার দেখা হয়েছে তাঁর সাথে তবে আগে সে একরাম নয়। আল্লাহর একজন অতি সম্মানিত মেহমান হিসেবে নূরানী জ্যোতিতে উদ্ভাসিত এক যুবক। তখন আগের মতো কুশল বিনিময় হয়নি তবে হয়েছে আত্মিকভাবে কথোপকথন। আগের মতো কথা বলতে পারিনি শ্রদ্ধার নত হয় আসছিল- ৫ই জুন’৯৫ সকাল ১০টায় ফ্যাকাল্টিতে সাথী মোশাররফ ভাই (একরাম ভাইয়ের বিভাগের ছাত্র ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু) বললেন একরাম ভাইয়ের অবস্থা খুবই খারাপ সোনাগাজীতে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা হামলা করে আহত করেছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে আছে। ডিপার্টমেন্টের অনেকেই দেখতে যাবে আপনি যাবেন? আমি কোন আকরাম ভাই জিজ্ঞাসা করতেই মোশাররফ ভাই বলে উঠলেন, “আরে সাথী ছিলেন যে অনার্স সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়েছেন, এবার মাস্টার্স পরীক্ষা দিলেন আমি আঁতকে উঠে বললাম কি বলেন? আমার সাথে মাত্র ৫দিন পূর্বে উনার সাথে দেখা হল কবে বাড়ি গেলেন? মোশাররফ ভাই বললেন আমার সাথে ওতো একদিন আগেই দেখা হল। আমি বললাম দেখা যাক হলে যাই তারপর সিদ্ধান্ত নিব।

হলে ঢুকতেই দু-তিন জন সাথী কর্মী এসে বলল মতিন ভাই একরাম ভাইকে চিনেন নাকি, সোনাগাজীর? হ্যাঁ শুনেছি আহত হয়েছেন। একজন বলে উঠল না এই মাত্র ফোন আসলো উনি শাহাদাত বরণ করেছেন। ইন্নালিল্লাহি পড়ে দ্রুত রুমে গেলাম, চেয়ারে বসে পড়লাম। পুরো দুনিয়াটা অন্ধকার মনে হল। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে, কারো সাথে কোন কথা বলতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর হল সভাপতি রহমান ভাই এসে আমাকে খুঁজছে, আমি চোখ মুছে বের হতেই বললেন মতিন ভাই খবরটা পেয়েছেন? আমি অশ্রুসজল চোখে মাথা নাড়ালাম তিনি বললেন মিছিল হবে লোকজন খবর দেন। এর পরপরই বিশাল মিছিল বের হল।

মিছিলের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস নিয়ে হাসপাতাল পৌঁছি। সেখানে পূর্ব থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীর কিছু জনশক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র এবং তার নিজ এলাকার কয়েকজন লোককে দেখতে পেলাম। সকলের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে উঠল, আমরা লাশ ঘরে জোর করেই ঢুকে গেলাম। লাশ দেখে কেঁদে উঠলো সকলের মন। পরে যখন হাসপাতালের পাশে বসে আছি, মনে পড়তে লাগলো পুরনো সব স্মৃতির কথা, করিডোরের কথা, ফ্যাকাল্টিতে প্রোগ্রামের কথা বা সিঁড়িতে শেষ দেখার কথা। নিজের অজান্তেই অশ্রুতে বুক ভিজে গেল। এরপর আর একরাম ভাইয়ের চেহারা দেখিনি। দেখার মতো অবস্থাও আমার ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে জানাযা এবং সোনাগাজী যানাযা শেষে চিরদিনের জন্য যখন সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে রেখে আসছিলাম। এভাবে শহীদ একরামকে রেখে সবাই চট্টগ্রাম রওয়ানা হলাম। কাফেলার সবাই ছিল শুধু ছিল না একজন যিনি একদম পৃথিবীকে ছেড়ে মহান প্রভুর দরবারে পৌছে গেছেন।

এরপর জেলা সভাপতি হয়ে ফেনী আসার পর যতবার শহীদের বাড়ি গিয়েছি বারবার মনে পড়েছে প্রথম পরিচয় এবং সর্বশেষ দেখার কথা। খালাম্মা প্রশ্ন করেন করে আমার একরামের স্বপ্নের ইসলামী সরকার হবে, কবে হবে খুনিদের বিচার। তখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি আর অতীতের একরাম ভাইকে যেন শাহজাহাল হলের গেষ্টরুমে বা আর্টস ফ্যাকাল্টিতে সিঁড়িতে দেখতে থাকি। সাদা ধবধবে নূরানী জ্যোতিতে উদ্ভাসিত এক পবিত্র যুবক সাথীদের হৃদয় ফাটানো আর্ত চিৎকার যা কোন দিন শেষ হবার নয়, ভুলার নয়। নিজের অজান্তেই তখন দু'চোখ ভিজে ওঠে।

শহীদের আচরণ
আমাদের দেশে কুচকুচে কালো পাখি কোকিল। বসন্তকালের কোকিল খুব সুন্দর গান শোনায়, কিন্তু কোকিল দেখার পর মনে হবে না সে এত সুন্দর গান শোনাতে পারে। শহীদ একরামের গায়ের রং খুব সুন্দর ছিল না। কিন্তু চেহারা ছিল সুন্দর মায়াবী, আর মুখের ভাষা ছিল মিষ্টি বড় ও ছোটদের মাঝে তিনি যোগ্যতম সমান আর স্নেহ-ভালবাসা প্রদর্শন করতেন। তার সাথে যখনই ছোট কারো দেখা হতো খুবই স্নেহের সাথে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করতেন কেমন আছ? তিনি ভাবুক ছিলেন। এলাকার গরিব দুঃখীদের নিয়ে তাইতো তিনি গরিব দুঃখীদের সাহায্যার্থে এলাকার একটি সমিতি গঠন করেছিলেন সেখান থেকে অভাবীদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। তিনি এলাকার গরিব দুঃখীসহ সকল মানুষের প্রিয়জন । তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল তিনি যেদিন শাহাদাতবরণ করেছিলেন। সেইদিন থেকেই তিন দিন পর্যন্ত এলাকার সর্বস্তরের মানুষ কালো ব্যাজ ধারণ করে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন।

কী অপরাধ ছিল তার? কী অপরাধে হত্যা করা হলো, জনগণের বন্ধু আর ইসলামী আন্দোলনের নিরপরাধ এই কর্মকে? তার তো এছাড়া আর কোন অপরাধ ছিল না যে, তিনি আল্লাহর দীন কায়েমের জন্য শপথ নিয়েছিলেন আর মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিলেন।

যেভাবে ঘটনা ঘটলো 
৩ জুন ১৯৯৫। পড়ন্ত বিকেলে তিনি স্থানীয় একটি পাঠাগার বসে পত্রিকা পড়ছিলেন, অমনি মাস্তান বাহিনী খুনের নেশায় উন্মাত্ত হয়ে এসেই তাঁর মাথায় আঘাত করে, তার সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি জানতেন না তাকে এমন একটি পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। মাত্র দু’দিন আগে বাড়িতে ফিরেছিলেন শিক্ষাজীবনের পরীক্ষা দিয়ে, তিন দিন আগেই তার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। পরীক্ষা শেষে মায়ের আদরে ধন মায়ের কাছেই এসেছিলেন, সোহাগী বোনের কাছে এসেছিলে বুকভরা সোহাগ নিয়ে। তার চোখে বিরাট আশার স্বপ্ন, মাত্র একবছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর তিনিই ছিলেন পরিবারের বড়। স্বাভাবিকভাবে পরিবারের সকল দায়িত্ব তার ওপরই বর্তায়। এজন্য তার চেতনা ছিল পরিবারের জন্য কিছু করতে হবে। বাড়িতে এসেই মাকে বলেছিলেন মা পরীক্ষা দিয়ে এসেছি, ভালই হয়েছে, দোয়া করবেন। মা এবার চাকরি করে বোনগুলোকে বিয়ে দিয়ে দেব আর পরিবারে অভাব পূরণ করবো। কিন্তু তার সকল স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল তা আর বাস্তাবতার মুখ দেখেনি এবং কখনো দেখবেও না। আহ! কী নিষ্ঠুর এই পৃথিবী। আসলে এভাবে অনেক কিছুর স্বপ্ন দেখেই সবাইকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে।

আহত হওয়ার সোনাগাজী হাসপাতলে নেয়া হলে ডাক্তার সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে স্থানাস্তর করলেন। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলাম তাকে যেন সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে আনেন। আমরা চেয়েছিলাম তিনি সুস্থ হয়ে বাড়িতে এসে আবার আন্দোলনের কাজ করবেন। কিন্তু আমাদের সেই চাওয়া বৃথাই গেল। তিনি বাড়িতে এসেছে ঠিকই কিন্তু জীবিত নয় কফিনে।

একনজরে শহীদ পরিচিত
নাম : মুঃ একরামুল হক খাঁন
পিতা : মৃত সামছুল হক খাঁন
ভাইবোন : ২ ভাই, ৫ বোনের মধ্যে ৪র্থ
সাংগঠনিক মান : সাথী
ঠিকানা : গ্রাম: সফরপুর, পোস্ট : কুদ্দুস মিয়ার হাট, থানা : সোনাগাজী, জেলা : ফেনী
শিক্ষা জীবন
এস.এস.সি : ২য় বিভাগ
এইচ.এস.সি : ২য় বিভাগ
বি.এ অনার্স : ২য় শ্রেণীতে ২য়, চঃবিঃ।
শাহাদাত কালে : এম. এ. ফলপ্রার্থী।
শহীদ হওয়ার স্থান : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
যাদের আঘাতে নিহত : ছাত্রদল
যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম মহানগরী উত্তর
শাহাদাত : ৫ই জুন, ১৯৯৫ইং।

ঘটনা
সোনাগাজীর সফরপুর মিয়ার বাজারে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা এক নিরীহ ছাত্রকে আটকিয়ে মারধর করে ও চাঁদা দাবি করে। এর প্রতিবাদ করায় ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা তার উপর চড়াও হয়। সারা শরীরে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রথমে সোনাগাজী হাসপাতালে ও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দুই দিন অচেতন অবস্থায় থেকে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দেন।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ একরামুল হক

পিতা

সামছুল হক খাঁন

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

২ ভাই ৫ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

সফরপুর, কুদ্দুস মিয়ার হাট, সোনাগাজী, ফেনী

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

অনার্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ