শহীদ খাইরুল ইসলাম

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ | ৭৩

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

চট্টলার পিচঢালা রাজপথে নিত্য মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে যারা বজ্রমুষ্টি আকাশ পানে তুলে তাকবির ধ্বনিতে মুখর থাকতো তাদের একজন-শহীদ খাইরুল ইসলাম। বাংলার জমিনে শোষণ বঞ্চনার অবসান হবে-‘কোরআনের সুশাসনে মহানবী (সা) এর অনুসরণে’-এমন সুস্বপ্নে বিভোর কর্মপাগল সদা চঞ্চল এক যুবক শহীদ খাইরুল ইসলাম।

কক্সবাজারের চকরিয়ার গ্রামীণ সরল-সাবলীল নিজ পিতৃনিবাসে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ‘মানুষ’ হবার আশায় উচ্চ শিক্ষা লাভের স্বপ্নে ‘স্নেহ নীড়’ ছেড়ে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন তিনি। চট্টলার শ্রেষ্ঠতম দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন। কোরআনের পথে ছাত্র-যুবকদের সংঘবদ্ধ করার জন্য সদা তৎপর হবার তীব্র প্রেরণা পান তিনি এখানে ইসলামী আদর্শের একক পতাকাবাহী ছাত্র যুবকদের কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরে নিরলস নেতা হিসেবে, দৃপ্ত শপথ, বলীয়ান প্রতিশ্র“তিশীল এবং প্রতিভাবান সংগ্রামী হিসেবে নিজের অবস্থান রচনা করেন মহানগরীর ময়দানে। প্রতিবাদে প্রতিরোধে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে অকুতোভয় মর্দে-মুজাহিদ হিসেবে বিনা তলবেই ময়দানে যাদের সময়োচিত উপস্থিত দায়িত্বশীলদের সুকঠিন দায়িত্ব পালনে সহায়ক হতো, শহীদ খাইরুল ইসলাম ছিলেন তাদের অন্যতম।

স্বভাবতই শহীদ খাইরুল ইসলামী আন্দোলনের সংগ্রামী পথে সাহস এবং সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হতেন। রাজপথের নানা প্রান্তরে খোদাদ্রোহী শক্তির যাত্রাপথে ইসলামী আদর্শের দেয়াল রচনা করেইক্ষান্ত হতেন না বরং উদ্দীপ্ত যৌবনের অসংখ্য ছাত্রদের নেতৃত্বে দিতেন। এগিয়ে নিতেন ইসলামী আদর্শের অগ্রসরমান পতাকা। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি-সন্ত্রাসী হায়েনার তাঁকে দুনিয়া থেকে সরিয়া দেয়ার মতো নির্মম পথে এগিয়ে যান।

সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা
পবিত্র মাহে রমজানের সিয়াম শেষে নিজ গ্রামে পিতা-মাতা ও স্বজনদের সাথে ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি আরো অনেকের মতো। তাই ঈদপূর্ব কেনাকাটার জন্য তিনি চট্টগ্রামের মিমি সুপার মার্কেটে যান।

কিন্তু রমজানের পবিত্রতা ঈদের আনন্দ একজন যুবকের ঈদ উদযাপনের নির্মল স্বপ্ন সবকিছুকেই গুঁড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসী চক্রের খুনের নেশা। নানা রংয়ের বৈদ্যুতিক আলোতে প্লাবিত উৎসবমুখর মিমি সুপার মার্কেটের জনারণ্য থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বহু সদস্যের উদাসীন উপস্থিতিতে খুনিরা শহীদ খাইরুলকে জোরপূর্বক টেক্সিতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। নগরীর ব্যাটারি গলি এলাকায় নিয়ে ব্রাশ ফায়ারে খুন করে শহীদ খাইরুলকে। নিভে যায় একজন সংগ্রামী, সাহসী, কর্মতৎপর মর্দে মুজাহিদের জীবন প্রদীপ। শহীদ খাইরুল শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। শাহাদাতের বর্ণনাতীত মর্যাদায় ভূষিত হন।

শহীদের সাথীরা রাজপথ মুখরিত করে তুলে প্রতিবাদে-বিক্ষোভে। শাহাদাতের রক্ত শপথে উজ্জীবিত তরুণেরা শহীদের স্বপ্ন কোরআনের শিক্ষায় আলোকিত শোষকহীন-বঞ্চনাহীন এক সমাজ গঠনের জন্যে এখনও রাজপথ মুখরিত করে। তাকবিরের ধ্বনিতে শাহাদাতের তীব্র প্রেরণা উদ্বেলিত হয়। শত যুবকরা এখন ও রাজপথে মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে। শহীদ খাইরুলের অসমাপ্ত মিশন থেমে থাকে না। আগমন ঘৃণার চাবুক পড়ে খুনিদের অস্তিত্বে আল্লাহর ‘নূর’ ফুৎকারে ওরা নির্বাপিত করতে পারে না। অনির্বাণ চেতনা-প্রেরণার ধ্রুব উৎস হয়ে জ্বলে, আলো ছড়ায় শহীদ খাইরুল ইসলাম।

ইসলামী আন্দোলনের সাহসী সৈনিক
দেশ ও জাতির সম্ভাবনাময় অনেক তরুণের রক্তে সিক্ত চট্টগ্রাম মহানগরীর জনপদ। আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৮ জন ভাইকে শহীদ হিসেবে পেশ করেছে, অসংখ্য ভাই হারিয়েছে হাত পা, কান, চোখ, রক্ত দিয়েছে অগণিত ভাই। এ শাহাদাত, ত্যাগ এবং কোরবানি চট্টগ্রাম ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। শহীদ খাইরুল ইসলাম ১৮ জন শহীদের মধ্যে অন্যতম।

ছাত্র হিসেবে খাইরুল
শহীদ খাইরুল ইসলাম ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উম্মুল মাদারেস নামে খ্যাত শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র।
১৯৯১ সালে আলীয় মাদরাসায় আলিমে ভর্তি হন। দারুল উলুম মাদরাসা ছাত্রাবাসের ২৯ নং কক্ষে তিনি থাকতেন। খাইরুল ভাই ছিলেন সংগঠনের সাথী। মিথ্যা মামলা থাকার কারণে ৯১ সালে তিনি আলিম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে নি।

১৯৯২-৯৩, ৯৪ সালে বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের সাথে শিবিরের সারা দেশে সংঘর্ষ চলছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর ময়দান তখন উত্তপ্ত। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক এবং মেডিক্যালে আন্দোলন সংগ্রাম চলছিল। ১৯৯৪ সালে শহীদ হলেন প্রিয় ভাই নুরুল আলম এবং ইউসুফ। এই দুটি শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছিল সংগঠনের মহানগরী অফিসের পাশে চন্দনপুরা ও চকবাজারে। এই দুই শহীদের গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ি।

এই ঘটনাগুলোর পর চন্দুনপুরার এক চিহ্নিত সন্ত্রাসী সেলিম মারা যায়। শহীদ খাইরুল ইসলামকে এ্ই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামী করা হয়। এ কারণে তিনি ফাজিল পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। শাহাদাতবরণের সময় তিনি ছিলেন ফাজিল ক্লাসের ছাত্র।

দায়িত্বশীল হিসেবে শহীদ খাইরুল ইসলাম
শহীদ খাইরুল ভাই চট্টগ্রাম মহানগরী স্কুল বিভাগ, বাকলিয়া সরকারি হাইস্কুল এবং হামজারবাগ রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালক ছিলেন। দায়িত্বশীল হিসেবে খাইরুল ভাই কর্মীদের জন্য নিবেদিত ছিলেন। সব সময় হাসি মুখে থাকতেন। প্রাণচাঞ্চল্য ছিল তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য। দায়িত্বশীল হিসেবে তার হৃদয় ছিল বিশাল। যেকোনো সমস্যায় ভূমিকা গ্রহণ ছিল খাইরুল ভাইয়ের অন্যতম গুণ। স্কুল ও মাদরাসার হোস্টেলে তাঁর সাথে দেখা করতে তরুণরা আসতো দলে দলে।

যেদিন শহীদ হলো
২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ সাল, সে দিনটি ছিল ২১শে রমজান। তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে কুরআন তেলাওয়াত করলেন। জোহরের নামাজের পরও ছাত্রাবাসে ছিলেন। যোহরের পর তিনটার দিকে তিনি ঈদের বাজার করতে মিমি সুপার মার্কেটে যান। সকাল থেকেই ছাত্রদেলের সন্ত্রাসীরা সম্ভবত তার গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। মিমি সুপার মার্কেট এলাকায় তাদের আড্ডা ছিল। বাজার শেষ করে নিচে নেমে আসার সাথে সাথে সন্ত্রাসীরা তাকে টেক্সিতে তুলে ব্যাটারি গলিতে নিয়ে গিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে গুলি করে হত্যা করে।

শাহাদাতের পর
শহীদ খাইরুল ইসলাম ভাইয়ের শাহাদাতের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে চারদিকে থেকে শিবিরে কর্মীরা ছুটে আসতে লাগল। মাগরিবের নামাজের পর পরই চট্টগ্রাম শহর মিছিলের শহরে পরিণত হয়।

জনশক্তিকে বাধা দিয়ে রাখা যায়নি। সবাই প্রতিবাদের জন্য রাজপথে নেমে আসে। সিরাজউদ্দোল্লা রোড, আন্দরকিল্লা, চকবাজার, লালদীঘি এলাকায় শিবির কর্মীরা রাস্তায় অবস্থান নেয়। রাতে জেনারেল হাসপাতালে লাশ নিয়ে আসা হয়। রাতে পালাক্রমে শিবির কর্মীরা লাশ পাহারা দেয়। গভীর রাতে পর্যন্ত জেনারেল হাসপাতাল চত্বরে সমাবেশ চলতে থাকে। ২৩ তারিখে দুপুরে লালদীঘি ময়দানে জানাজা হয়। হাজার হাজার শোকাহত জনতা জানাজায় অংশগ্রহণ করে। দ্বিতীয় দফা জানাজা হয় দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসা ময়দানে। তৎকালীন এমপি শাহজাহান চৌধুরী, এনামুল হক মঞ্জু এবং অধ্যক্ষ মাওলানা আবু তাহেরসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। গ্রামের বাড়িতে শেষ বারের মত জানাজা পড়ে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

খাইরুল অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস
খাইরুল ইসলাম শহীদি মিছিলে এক উজ্জ্বল মুখ। অবশ্য এই মিছিলে সব মুখই উজ্জ্বল, অভাবিত দ্বীপ্তিময়। তবুও সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা ও সময়ের সংস্পর্শে কিছু মুখের স্মৃতি বড় বেশি মনে পড়ে। খাইরুল ইসলাম এমনই, তার স্মৃতিরা এখনো কথা বলে, প্রীতিকর আগামীর বার্তা আনে। তাই, খাইরুল ইসলাম আমাদের প্রেরণার উৎস।

একনজরে শহীদ পরিচিত
নাম : খাইরুল ইসলাম
সাংগঠনিক মান : সাথী
সর্বশেষ পড়াশুনা : ফাজিল ২য় বর্ষ
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসা
আহত হওয়ার স্থান: চট্টগ্রাম মিমি সুপার মার্কেট থেকে অপহরণ করে ব্যাটারি গলির মুখে নিয়ে আহত করা হয় এবং এখানেই শাহাদাতবরণ করেন
শহীদ হওয়ার স্থান : ঐ
আঘাতের ধরন :গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন।
যাদের আঘাতে নিহত : ছাত্রদল
শহীদ হওয়ার তারিখ : ২২.০২.১৯৯৫
স্থায়ী ঠিকানা : চকরিয়া, কক্সবাজার।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ খাইরুল ইসলাম

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

স্থায়ী ঠিকানা

চকরিয়া

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ফাযিল ২য় বর্ষ, দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসা, চট্টগ্রাম

শাহাদাতের স্থান

চট্টগ্রামের ব্যাটারি গলি