বুধবার, ১৮ মে ২০২২

চাইতে হবে আল্লাহর কাছেই - মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত

আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার দিক হচ্ছে সে কোনো না কোনোভাবে নিয়ম ভঙ্গের ফাঁদে পড়ে। যে ফাঁদ শয়তানের প্ররোচনা, কুপ্রবৃত্তির টান কিংবা মানবীয় দুর্বলতার কারণেই ঘটে থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য যে বিধিবিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন, ফাঁদে পড়ে মানুষ প্রতিদিন কোনো না কোনো বিধান লঙ্ঘন করে ছোট কিংবা বড় পাপ করতে থাকে। এসব পাপ জমা হতে হতে পাপের ভারে মানুষের হৃদয় হয় কলুষিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এক সময় মহান আল্লাহ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রহের পথ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। মানুষ দূরে সরে গেলেও আল্লাহ যেহেতু ভালোবেসে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাই তিনি তার বান্দাহর প্রতি ক্ষমার হাত বাড়িয়ে দেন। বান্দাহ যদি তাওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে কায়মনোবাক্যে ঐকান্তিকতা ও একনিষ্ঠতার সাথে আল্লাহর কাছে পাপ মোচনের ক্ষমা চায় তাহলে সে আল্লাহর ক্ষমা লাভে সক্ষম হয়।

বান্দাহর ধর্মই হচ্ছে আল্লাহর কাছে চাওয়া বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা। রাসূল সা. দিনে ৭০ বারেরও বেশি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতেন, তাওবা করতেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদিসে এসেছে রাসূল সা. বলেন, আল্লাহর কসম আমি দিনের মধ্যে ৭০ বারেরও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাওবা করি। (বুখারি)। আগার আল-মুযানি রা. থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, হে মানুষেরা তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর নিশ্চয়ই আমি একদিনের মধ্যে একশ’ বার আল্লাহর নিকট তাওবা করি বা ইস্তেগফার করি। (মুসলিম)। যিনি আল্লাহর প্রকৃত বান্দাহ, যিনি মুমিন মুসলমান তিনি সব বিষয়ে মহান আল্লাহর কাছেই চাইবেন এটাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দোয়া বা আল্লাহর কাছে চাওয়ার ক্ষেত্রে কখনো কখনো ব্যতিক্রম দেখা যায়। বান্দাহ খুব বড় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলে আল্লাহর কাছে চায় ছোটখাটো বিষয়ে চায় না। এমনকি অনেকের নিকট এই ধারণাও অনুপস্থিত যে ছোটখাটো বিষয়েও আল্লাহর কাছেই চাইতে হয়। ছোট বড়, গুরুত্ব কম হোক বা বেশি সব কিছুই চাইতে হবে আল্লাহর কাছেই। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা রা. বলেন, তোমার যা কিছু প্রয়োজন তা আল্লাহর কাছে চাও। যদিও তা একটি জুতার ফিতাও হয়ে থাকে। কারণ আল্লাহ যদি তোমার জন্য এটি সহজ না করেন তাহলে এটি পাওয়া তোমার জন্য সম্ভব হবে না (তিরমিজি)। হযরত আনাস রা. বর্ণিত অপর হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা তোমাদের সকল প্রয়োজন আল্লাহর কাছে চাইবে, এমনকি যদি জুতার ফিতা ছিঁড়ে যায় তাহলে তাও তাঁর কাছেই চাইবে। এমনকি লবণও তার কাছেই চাইবে। (তিরমিজি)

সকল প্রয়োজন পূরণে চাইতে হবে আল্লাহর নিকটে, সাহায্যের জন্যও চাইতে হবে আল্লাহর নিকট। ছোট প্রয়োজন বড় প্রয়োজন কম গুরুত্বপূর্ণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ সবই চাইতে হবে অসীম ক্ষমতাবান আল্লাহর কাছে। কারণ ছোট হোক কিংবা বড় সকল চাওয়া পাওয়া পূরণের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই। বান্দাহর জন্য যা বরাদ্দ তা আল্লাহই করে থাকেন। দুনিয়ার কারো কাছে চেয়ে সেই বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব নয়। আল্লাহ যদি কিছুই বরাদ্দ না রাখেন তাহলে দুনিয়ার কারো কাছে শতবার চাইলেও সামান্য দানা পরিমাণ বরাদ্দও কেউ দিতে পারবে না। তাই সব বিষয়ে চাইতে হবে আল্লাহরই কাছে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, যখন তুমি প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে এবং যখন তুমি সাহায্য চাইবে তখন তুমি আল্লাহরই সাহায্য চাইবে। আর জেনে রাখো, যদি সকল সৃষ্টি একত্রিত হয় তোমার কল্যাণ করতে তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তার অতিরিক্ত কোনো কল্যাণ তারা তোমার জন্য করতে পারবে না। এবং যদি সকল সৃষ্টি তোমার ক্ষতি করতে একত্রিত হয় তবে আল্লাহ তোমার বিরুদ্ধে যা লিপিবদ্ধ করেছেন তার অতিরিক্ত কোন ক্ষতি তারা তোমার করতে পারবে না। (তিরমিজি)

কল্যাণ এবং অকল্যাণ সব কিছুরই মালিক আল্লাহ। সুতরাং কল্যাণ কামনা করে যেমন আল্লাহর কাছে চাইতে হবে তেমনি অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্যও চাইতে হবে আল্লাহর নিকট। মুমিন বান্দাহর গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, বিপদ আপদ মুসিবতে মুমিন যেমন আল্লাহর কাছে চাইবে তেমনি কল্যাণ ও নিয়ামাতের মধ্যে থাকলেও আল্লাহর কাছে কল্যাণের স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধির জন্য চাইবে। কেউ কেউ এমন আছেন বিপদে পড়লে আল্লাহর কাছে চায় নিয়ামাতের মধ্যে বা ভালো অবস্থায় থাকলে চাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। এমন আচরণ মুমিনের কাম্য নয়। ভালো অবস্থা বা নিয়ামাতের মধ্যে থেকেও কেন আল্লাহর কাছে চাইতে হবে এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি চায় যে সে কঠিন বিপদ ও যন্ত্রণা দুর্দশার সময় আল্লাহ তার প্রার্থনায় সাড়া দিবেন, সে যেন সুখ শান্তি ও সচ্ছলতার সময়ও বেশি বেশি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। (তিরমিজি)

কিন্তু মানুষের সহজাত একটি প্রবৃত্তি হলো, মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়লে আল্লাহকে ডাকে সচ্ছলতায় ভুলে যায়। মানুষ বিপদে পতিত হলে আল্লাহকে ব্যাপকভাবে স্মরণ করে বারবার একনিষ্ঠভাবে দোয়া করে। আবার যখন বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত হয়ে যায় যখন সে কল্যাণের মধ্যে ফিরে আসে তখন সে বেমালুম আল্লাহকে ভুলে যায়।
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বান্দাহর এমন অকৃতজ্ঞ আচরণের সমালোচনা করে জাহান্নামি হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষকে যখন দুঃখ দুর্দশা স্পর্শ করে তখন সে তার প্রভুকে ডাকে একনিষ্ঠ মনোভাব নিয়ে। অতঃপর যখন তিনি তার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তখন সে ভুলে যায় যেমন সে তাঁকে একনিষ্ঠভাবে ডেকেছিল। সে আল্লাহর শরিক দাঁড় করায় যে সে তাকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে। বলো : কুফরি নিয়ে জীবনটাকে কয়টা দিন ভোগ করো। জেনে রাখো তুমি জাহান্নামি। (সূরা যুমার : ৮)। আল্লাহর কাছে বিপদ থেকে মুক্তি চেয়ে উদ্ধারের পর এমন আচরণ বান্দাহকে জাহান্নামে নিপতিত করে, এমন আচরণ কখনো কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- মাঝ নদীতে থাকা কোন নৌযান যদি ঝড়-তুফানের কবলে পড়ে তখন উদ্ধার পাওয়ার জন্য যাত্রীরা সবাই আল্লাহর নাম জপতে থাকে, ঝড়ের কবল থেকে বাঁচার জন্য একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে চাইতে থাকে। কিন্তু ঠিক যখন ঝড় থেমে যায় কিংবা নিরাপদে কূলে ভিড়ে তখন তারা আল্লাহর কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সব বাহবা জানায় নাবিককে। এক ধরনের আল্লাহর সাথে শরিক করার নামান্তর। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ কুরআনে বলেন, তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে তখন আন্তরিক নিষ্ঠার সাথে তারা আল্লাহকে ডাকে, তারপর যখন তিনি তাদেরকে নাজাত দিয়ে কূলে নিয়ে আসেন তখন তারা শিরক করতে থাকে। (সূরা আনকাবুত : ৬৫)

মহান আল্লাহ বান্দাহর ডাকে সাড়া দেন বলেই বান্দাহকে তার বরের নিকটই চাইতে হবে। কিছু বান্দাহ এমন আছেন যারা নিজের জন্য নিজে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করার চাইতে অন্য কোনো নেক আমলদার বুজুর্গকে দিয়ে দোয়া করানোকেই বেশি ফলদায়ক মনে করেন। তারা মনে করেন নিজের জন্য নিজে আল্লাহর কাছে দোয়া করার চাইতে বুজুর্গকে দিয়ে দোয়া করালে কবুল হবে বেশি। আবার সমাজে কিছু মানুষ মাজারে গিয়ে মৃত মানুষের কাছে চাওয়ার মতো গোমরাহিতেও লিপ্ত আছেন। তারা জানেন না যে মৃত ব্যক্তির কিছুই করার ক্ষমতা নাই। নেককার, বুজুর্গ, আলেম, ওস্তাদ, মুজাহিদ, মুসাফির, অসুস্থ ব্যক্তি এবং পিতা-মাতার কাছে দোয়া চাওয়া জায়েজ। কারো কারো ক্ষেত্রে তাদের নিকট গিয়ে দোয়া চাওয়ার হাদিসও রয়েছে। তবে নিজের জন্য নিজেই একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়াকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। কারণ বান্দাহ যখন আল্লাহর কাছে কিছু চেয়ে দোয়া করবেন তখন তার চাহিদার কথা আকুতি মিনতি করে যথার্থভাবে তিনিই নিজেই সবচেয়ে বেশি ভালো বলতে পারবেন।

হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল সা.কে প্রশ্ন করলাম, “হে আল্লাহর রাসূল, সর্বোত্তম দোয়া কী?” তিনি উত্তরে বললেন, “মানুষ নিজের জন্য নিজে দোয়া করা।” (মাজমাউয যাওয়াইদ)। যেহেতু সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দোয়া অবশ্যই কবুল হয় তাই তাদের কাছে দোয়া চাওয়া এবং দোয়া পাওয়ার উপযুক্ত আচরণ করা উচিত। তাছাড়া অসুস্থ ব্যক্তির কাছেও দোয়া চাইতে আল্লাহর রাসূল ইরশাদ করেছেন। মজলুম মুসাফির এবং পিতা-মাতার দোয়া কবুল হওয়া সংক্রান্ত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেন, তিনটি দোয়া এমন যেগুলো অবশ্যই কবুল করা হয়। এতে কোনো সন্দেহ নাই, মজলুমের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া এবং সন্তানের উপর তার পিতা-মাতার দোয়া। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)। অসুস্থ ব্যক্তির নিকট দোয়া চাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে রাসূল সা. বলেন, যদি তুমি কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাও তখন তাকে বলো তোমার জন্য দোয়া করতে, কারণ অসুস্থ ব্যক্তির দোয়া ফেরেস্তাদের দোয়ার মতো কার্যকর হয় বা কবুল হয়। (ইবনে মাজাহ)। হজ ও ওমরাহ পালনকারীর নিকট দোয়া চাওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে হযরত ওমর রা. বলেন, তোমরা হজ পালনকারী, ওমরাহ পালনকারী এবং যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকারীদের সাথে সাক্ষাৎ করবে (দোয়া চাইবে), যেন তারা পূত-পবিত্রতা হারানোর আগেই তোমার জন্য দোয়া করে। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা)।
মুমিন মুসলমান যিনি তিনি শুধু নিজের জন্যই দোয়া করবেন না বরং নিজের পাশাপাশি অপরের জন্যও দেয়া করবেন। নিজের পিতা-মাতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন পরিবার পরিজনের জন্য দোয়া করবেন। পাশাপাশি অপর মুসলিম ভাইবোন এবং বিশে^র নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যও দোয়া করবেন। এ ব্যাপারে কুরআনে অনেক দোয়া উল্লেখ রয়েছে। কুরআনে একটি দোয়া এভাবে উল্লেখ হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রভু আপনি আমাদের ক্ষমা করুন এবং ঈমানের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভাইদের ক্ষমা করুন। আর আপনি আমাদের অন্তরে মুমিনগণের বিরুদ্ধে কোন হিংসা বিদ্বেষ বা অমঙ্গলের ইচ্ছা রাখবেন না। হে আমাদের প্রভু, নিশ্চয় আপনি মহা করুণাময় ও পরম দয়ালু।’ (সূরা হাশর : ১০)

মুমিন তার অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্যও দোয়া করবে। নিজের কল্যাণ কামনা করে যেমন দোয়া করবে তেমনি অপর মুমিন ভাইয়ের জন্যও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করবে। নিজে যেমন অকল্যাণ থেকে পানাহ চাইবে তেমনি অপর মুমিন ভাইয়ের অকল্যাণ থেকে মুক্তি কামনা করবে। অপরের জন্য দোয়া করলে পক্ষান্তরের সেই দোয়া নিজের জন্যও করা হয়। কারণ মুমিন তার ভাইয়ের জন্য দোয়া করলে উক্ত দোয়া কবুল করে দোয়াকারীকেও আল্লাহ উক্ত নিয়ামাত দান করেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, “কোনো মুসলিম যখন তার কোন অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়া করে তখন আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন। তার মাথার কাছে একজন ফিরিস্তা নিয়োজিত থাকেন, যখনই সে মুসলিম তার অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য কোনো কল্যাণ চায় তখনই ফিরিস্তা বলেন; আমিন এবং আপনার জন্যও অনুরূপ (অর্থাৎ আল্লাহ আপনাকেও প্রার্থিত বিষয়ের অনুরূপ দান করুন)। (মুসলিম)

আল্লাহর কাছে চাওয়ার মাধ্যমে মূলত আল্লাহকে পাওয়া হয়। আল্লাহর কাছে চাওয়া বা দোয়া করার মাধ্যমে মহান রবের নৈকট্য অর্জনের পথ প্রসারিত হয়। কারণ দোয়া একটি ইবাদাত এবং অপরিসীম সাওয়াবের কাজ। আল্লাহর কাছে দোয়া করা বা চাওয়ারও অনেক মর্যাদা বা তাৎপর্য রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহর কাছে দোয়ার চেয়ে অধিক সম্মানিত আর কিছুই নেই। (তিরমিজি) দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দাহর সম্পর্কের একটি সেতুবন্ধ তৈরি হয়। এ বন্ধনকে সুদূঢ় ও মজবুত করার মাধ্যম বারবার আল্লাহকে ডাকা। আর আল্লাহ তার বান্দাহর খুব নিকটেই থাকেন। আল্লাহও কামনা করেন তার বান্দাহ তার কাছেই বারবার চাইবে। এক সাহাবি রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে জানতে চান ইয়া রাসূলাল্লাহ আমাদের প্রভু কি আমাদের কাছে না দূরে? যদি কাছে হন তবে আমরা তাঁর সাথে মুনাজাত করবো বা চুপে চুপে কথা বলব। আর যদি তিনি দূরে হন তাহলে আমরা জোরে জোরে তাকে ডাকবো জবাবে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমের সূরা বাকারার ১৮৬ নম্বর আয়াত নাযিল করেন এবং যখন আমার বান্দাগণ আপনাকে আমার বিষয়ে প্রশ্ন করে তখন তাদের জানিয়ে দিন আমি তাদের নিকটবর্তী। (ইবনে কাসির)

আল্লাহ যখন বান্দাহর নিকটবর্তী তখন বান্দাহর উচিত বেশি বেশি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় দোয়া করেই আমরা হা-হুতাশ করি। ত্বরিত ফল পাওয়ার প্রত্যাশা করি। ফল না পেলে হতাশ হয়ে যাই। দু’চার বার দোয়া করার পর ফলাফল না পেলে দোয়া করাই ছেড়ে দেই। অথচ কোন মুসলিমকে আল্লাহ খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। দোয়া কখনো নিষ্ফল হয় না, শূন্য হাতে বান্দাহকে ফিরিয়ে দিতে আল্লাহ নিজেই লজ্জা পান। হযরত সালমান ফার্সি রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন, যখন কোন মানুষ তার দিকে দু’খানা হাত ওঠায় তখন তিনি তা ব্যর্থ ও শূন্যভাবে ফিরিয়ে দিতে লজ্জা পান। (তিরমিজি)
আল্লাহর কাছে বান্দাহ যদি পাপ বা ক্ষতিকারক কিছু না চায় তাহলে সেই চাওয়া আল্লাহ কবুল করেন। হযরত উবাদাহ ইবনু সামিত রা. বলেন, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন জমিনের বুকে যে কোন মুসলিম আল্লাহর কাছে কোন দোয়া করলে- যে দোয়ায় কোন পাপ বা আত্মীয়তার ক্ষতিকারক কিছু না চায়- তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করবেনই। হয় তাকে তার প্রার্থিত বস্তু দিবেন অথবা তদনুযায়ী তার কোনো বিপদ কাটিয়ে দিবেন। (তিরমিজি)। দোয়া করেই ত্বরিত ফল চাইতে গিয়ে যদি হতাশা প্রকাশ কিংবা হা-হুতাশ করতে থাকি তবে তা হবে হিতে বিপরীত বা ক্ষতিকারক। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন, বান্দাহ যতক্ষণ পাপ বা আত্মীয়তার ক্ষতিকারক কোন কিছু প্রার্থনা না করে ততক্ষণ তার দোয়া কবুল করা হয়, যদি না সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বলা হলো ইয়া রাসূলাল্লাহ ব্যস্ততা কিরূপ? তিনি বললেন: দোয়াকারী বলতে থাকে- দোয়াতো করলাম, দোয়া তো করলাম, মনে হয় আমার দোয়া কবুল হলো না। এভাবে সে হতাশ হয়ে পড়ে তখন দোয়া করা ছেড়ে দেয় (মুসলিম)
দোয়ার ব্যাপারে এটি নিশ্চিত যে বান্দাহ আল্লাহর কাছে চাইলে দোয়া করলে মুমিন মুসলমানের দোয়া আল্লাহ ব্যর্থ করে দেন না। হয় তিনি তা বান্দাহকে সাথে সাথে দিবেন নতুবা পরকালের জন্য তা জমা রাখবেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন- যে কোনো মুসলিম আল্লাহর কাছে মুখ তুলে কিছু প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাকে তা দেবেনই। হয় তাকে তা সাথে সাথে দিবেন অথবা (আখিরাতের জন্য) তা জমা করে রাখবেন। (মুসনাদ আহমদ)

অপর একটি হাদিসে এসেছে দোয়া করলে তিন বিষয়ের অন্তত একটি আল্লাহ বান্দাহকে প্রদান করবেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন- যখনই কোনো মুসলিম পাপ ও আত্মীয়তা নষ্ট করা ছাড়া অন্য যে কোন বিষয় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে তখনই আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করে তাকে তিনটি বিষয়ের একটি দান করেন, হয় তার প্রার্থিত বস্তুই তাকে সঙ্গে সঙ্গে প্রদান করেন, অথবা তার প্রার্থনাকে (প্রার্থনার সাওয়াব) আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করে রাখেন, অথবা দোয়ার সমপরিমাণ তার অন্য কোন বিপদ তিনি দূর করে দেন। এ কথা শুনে সাহাবিগণ বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, তাহলে আমরা বেশি বেশি দোয়া করব। তিনি উত্তরে বললেন: আল্লাহ তায়ালা আরো বেশি বেশি দোয়া কবুল করবেন। (তিরমিজি)
দোয়া কবুলের জন্য পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা, আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট না করা, আল্লাহর সাথে শিরক না করার নির্দেশনা রাসূল সা. দিয়েছেন। তার পাশাপাশি হারাম থেকেও বেঁচে থাকার কথা রাসূল সা. বলেছেন। রাসূল সা. এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত অবিন্যস্ত ও ধুলোয় মলিন। সে আসমানের দিকে হাত প্রশস্ত করে বলে (দোয়া করে) হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এমন অবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে? (তিরমিজি)। ব্যক্তিগত জীবনে হালাল জীবন জীবিকা ছাড়া দোয়া কবুল করা হবে না আর সামষ্টিক জীবনে মানুষ যদি আমর বিন মারুফ নাহি আনিল মুনকার তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান না করে তাহলে এমন সময় আসবে তখন বান্দাদের ডাকে আল্লাহ সাড়া দেবেন না। রাসূল সা. বলেছেন, শপথ সেই সত্তার যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা অবশ্যই ভালো কাজের আদেশ দিবে এবং অন্যায় কাজ হতে বাধা প্রদান করবে। নতুবা অচিরেই এর ফলে আল্লাহ তোমাদের ওপর শাস্তি পাঠাবেন। এরপর তোমার কাছে দোয়া করবে কিন্তু তোমাদের দোয়ায় সাড়া দেয়া হবে না। (তিরমিজি)

দোয়া কবুলের জন্য অন্তরের গভীর থেকে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে, মনের আকুতি মিশিয়ে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, হে মানুষেরা তোমরা যখন আল্লাহর কাছে চাইবে তখন কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে চাইবে, কারণ কোনো বান্দাহ অমনোযোগী অন্তরে দোয়া করলে আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন না। (সহিহ তারগিব)। একনিষ্ঠভাবে সচেতনভাবে কল্যাণ কামনায় দোয়া চাইতে হবে। ক্ষতিকর বিষয়ে দোয়া চাইলে তা হবে হিতে বিপরীত। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন তোমাদের কেউ যখন কোন কিছু কামনা করবে তখন সে কি চাচ্ছে তা যেন ভালো করে দেখে; কারণ তার কোনো বাসনা বা প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যাচ্ছে তা সে জানে না। (মাজমাউয যাওয়াইদ)। উম্মে সালামাহ রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন- তোমরা নিজেদের উপর কখনো ভালো ছাড়া খারাপ দোয়া করবে না। কারণ ফিরিস্তাগণ তোমাদের দোয়ার সাথে আমিন, আমিন বলেন। (মুসলিম)। অনেক সময় আমরা দুঃখ কষ্ট যাতনায় কিংবা অন্য কোনো কারণে অতিষ্ঠ হয়ে সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজের মাল-সম্পদেরও ক্ষতি কামনা করি। এ প্রসঙ্গে জাবির রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা কখনো নিজেদের বা তোমাদের সন্তানদের বা তোমাদের মান সম্মানের অমঙ্গল বা ক্ষতি চেয়ে বদ দোয়া করবে না। কারণ হয়তো এমন হতে পারে, যে সময় তোমরা বদ দোয়া করলে সে সময়টি এমন সময় যখন আল্লাহ বান্দাহর সকল প্রার্থনা কবুল করেন এবং যে যা চায় তাকে তা প্রদান করেন। এভাবে তখন তোমাদের বদ দোয়াও তিনি কবুল করে নিবেন। (মুসলিম)

বান্দাদের মধ্যে এমনও ব্যতিক্রম কেউ কেউ আছেন আল্লাহর কাছে দোয়াই চান না। কেউ আছেন অন্যায় জুলুমের শিকার হলে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে, বিপদ আপদ মুসিবতে পতিত হলে আল্লাহর কাছে দোয়া করা প্রয়োজন মনে করেন না। তারা ধারণা করেন আল্লাহ তো তার সবকিছুই দেখছেন, শুনছেন, তিনিই নিশ্চয়ই পানাহ দিবেন কিংবা উদ্ধার করবেন দোয়া চাওয়ার প্রয়োজন কী। এ প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, সবচেয়ে অক্ষম সে ব্যক্তি যে দোয়া করতেও অক্ষম। (জামিউস সাজির)। আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত অপর হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে না আল্লাহ তার উপর ক্রোধান্বিত হন। (তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)

আসুন আমরা অসীম দয়ার সাগর আল্লাহর নিকটই একনিষ্ঠভাবে আমাদের সব চাওয়া বেশি বেশি করে পেশ করি। পাপ মোচনের জন্য প্রার্থনা করি। প্রয়োজন পূরণে প্রার্থনা করি। বিপদ আপদ মুসিবত থেকে উদ্ধারের জন্য নিবেদন করি। সুস্থতা কামনায় মোনাজাত করি। স্ত্রী-সন্তান পিতা-মাতা পরিবার পরিজন, জীবিত মৃত মুমিন মুসলমানদের জন্য দোয়া করি। সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য দোয়া চাই। দোয়া, মুনাজাতে আকুতি মিনতি ও ক্রন্দনের মাধ্যমে হৃদয়কে পবিত্র করি। দূরে সরে যাওয়া সত্তাটাকে আল্লাহর আরো বেশি নৈকট্য, সন্তুষ্টি এবং রহম লাভের উপযুক্ত করি। আল্লাহুম্মা আমিন।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট