বুধবার, ১৫ আগস্ট ২০১৮

মোবারক হোসাইন

শহীদ আবদুল মালেক : ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের মহানায়ক

শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা মূলত মানুষের আত্মা, আধ্যাত্মিক ও মানসিক বিকাশ ঘটায়। যে শিক্ষা মনুষ্যত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধের চেতনাকে জাগ্রত করতে ব্যর্থ সে শিক্ষায় জাতির কোনো কল্যাণে তো আসেই না বরং একটি জাতিসত্তাকে দুর্বল করে ফেলবে খুব সহজেই। এমন একটি ক্রান্তিকালে ১৯৬৯ সালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করতে পেরে শহীদ আবদুল মালেক এগিয়ে আসেন একটি সুন্দর সমাজ ও সুন্দর মানুষ তৈরির মেন্যুফেস্ট নিয়ে। জাতির সামনে পেশ করেন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা। শহীদ আবদুল মালেক দৃঢ়তার সাথে উদ্বেলিত কণ্ঠে গোটা জাতির কাছে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। অবশেষে কুপোকাত হয় ইসলামবিদ্বেষীদের সকল রাশভারী ষড়যন্ত্র ; বিজয়ী হয় শহীদ আবদুল মালেকের স্বপ্ন। সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজও এদেশের মানুষ শহীদ আবদুল মালেককে খুব অনুভব করছেন। শহীদ আবদুল মালেককে হত্যা করে ঘাতকরা আবদুল মালেকের আদর্শকে মুছে দিতে পারেনি বরং শহীদ আবদুল মালেক আজ লক্ষ-কোটি ছাত্র- জনতার হৃদয়ের মানুষে পরিণত হয়েছেন। একটি আদর্শিক জাতি উপহার দিতে হলে শহীদ আবদুল মালেকের প্রস্তাবিত সেই শিক্ষানীতির অনুসরণ সময়ের অনিবার্য দাবি হয়ে উঠেছে।

ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে অবস্থানের যৌক্তিকতা ও শাহাদাতের প্রেক্ষাপট:
১৯৬৯ সালে পাকিস্তানজুড়ে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান দেখা দেয়। ফলে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করেন। এরই একপর্যায়ে এয়ার মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দেয়। ছাত্রসমাজের একটি অংশ ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের দাবি তুলে। ১৯৬৯ সালে শহীদ আবদুল মালেকসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এয়ার মর্শাল নুর খানের সাথে সাক্ষাৎ করে দেশে সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর দাবি করেন। শহীদ আবদুল মালেকের প্রতিনিধিদলের পর দেশের অন্যান্য আরও সংগঠনও একই দাবি তোলে। সবার দাবির মুখে অল্প কিছুদিনের মধ্যে সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এটি ছিল পাকিস্তান আমলের গঠিত সর্বশেষ শিক্ষা কমিশন। গঠিত শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষানীতিও ঘোষণা করে। ঘোষিত শিক্ষানীতিতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এতে ইসলামী আদর্শের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু তাতে বাদ সাধে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারীরা। তারা এ শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি জানায়। এমনই প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি কী হবে তা নিয়ে জনমতে জরিপের আয়োজন করা হয়। জনমত জরিপের অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২রা আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নিপা) ভবনে (বর্তমান ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ) এ শিক্ষানীতির ওপর একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনা সভায় বামপন্থীদের বিরোধিতামূলক বক্তব্যের মধ্যে শহীদ আবদুল মালেক মাত্র ৫ মিনিট বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। অসাধারণ মেধাবী বাগ্মী শহীদ আবদুল মালেকের সেই ৫ মিনিটের যৌক্তিক বক্তব্যে উপস্থিত সবার চিন্তার রাজ্যে এক বিপ্লবী ঝড় সৃষ্টি করে। ফলে সভার মোটিভ পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যায়। জাতির শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তির বিষয়ে তিনি সেদিন স্পষ্ট করে বলেছিলেন, "Pakistan must aim at ideological unity, not at ideological vacuum- it must impart a unique and integrated system of education which can impart a common set of cultural values based on the precepts of Islam. We need Common set of cultural values, not one set of cultural values.

তার বক্তব্যের এ ধারণাটিকে তিনি যুক্তিসহকারে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। উপস্থিত শ্রোতা, সুধীমণ্ডলী এবং নীতিনির্ধারকরা শহীদ আবদুল মালেকের বক্তব্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে একটি সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। আবদুল মালেকের তত্ত্ব ও যুক্তিপূর্ণ অথচ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ক্ষিপ্ত করে দেয় ইতঃপূর্বে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে বক্তব্য রাখা বাম, ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামবিরোধী বক্তাদের। সকল বক্তার বক্তব্যের মাঝ থেকে নীতিনির্ধারক এবং উপস্থিত শ্রোতা-সুধীমণ্ডলী যখন আবদুল মালেকের বক্তব্যকে পূর্ণ সাপোর্ট দেয় তখন আদর্শের লড়াইয়ে পরাজিত বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সকল ক্ষোভ গিয়ে পড়ে শহীদ আবদুল মালেকের ওপর। নিপার আলোচনা সভায় বাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে জনমত তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ডাকসুর নামে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষে প্রস্তাব পাস করানোর উদ্দেশ্যে দশ দিনের ব্যবধানে অর্থাৎ ১২ আগস্ট ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে (টিএসসি) এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। ছাত্রদের পক্ষ থেকে শহীদ আবদুুল মালেকসহ কয়েকজন ইসলামী শিক্ষার ওপর কথা বলতে চাইলে তাদের সুযোগ দেয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। সভার একপর্যায়ে জনৈক ছাত্র নেতা ইসলামী শিক্ষার প্রতি কটাক্ষ করে বক্তব্য রাখে। তখন উপস্থিত শ্রোতারা এর তীব্র বিরোধিতা করে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে স্লোগান দেয়। আবদুল মালেক তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে টিএসসির আলোচনা সভাস্থলেই তার প্রতিবাদ করেন। এই প্রতিবাদ সংঘর্ষে রূপ লাভ করে। সংঘর্ষ একপর্যায়ে থেমে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে আবদুল মালেক ও তার কতিপয় সঙ্গীকে টিএসসির মোড়ে সেকুলারপন্থীরা হামলা করে এবং রেসকোর্সে এনে তার মাথার নিচে ইট দিয়ে ওপরে ইট ও লোহার রড দিয়ে আঘাত করে মারাত্মকভাবে জখম করে এবং অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে চলে যায়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে এ পরিকল্পিত হামলার নেতৃত্ব দান করে। আবদুল মালেক ভাইকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ আগস্ট তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাতে শোকাহত সমগ্র জাতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সম্ভবত আবদুল মালেক ভাইয়ের মতো মেধাবী ছাত্রনেতার শাহাদাত এর আগে ঘটেনি। ফলে আবদুল মালেক ভাইয়ের শাহাদাতে গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। সর্বমহলে এই ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে। জাতির এই শ্রেষ্ঠসন্তানের বিদায়ে কেঁদেছে গোটা জাতি। দলমত নির্বিশেষে সবাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সে সময়ের সংবাদপত্র তার সাক্ষী। আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সভাপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানও বিবৃতি দিয়ে ঘটনার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ছাত্রনেতারা আবদুল মালেকের শাহাদাতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও সকল জাতীয় নেতা নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাত কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

শহীদ আবদুল মালেকের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। আওলাদে রাসূল (সা) সাইয়েদ মোস্তফা আল মাদানী জানাজার ইমামতি করেন। জানাজার পূর্বে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, “শহীদ আবদুল মালেকের পরিবর্তে আল্লাহ যদি আমাকে শহীদ করতেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) তার শোকবাণীতে মন্তব্য করেন, “এক মালেকের রক্ত থেকে লক্ষ মালেক জন্ম নেবে।” তার এ মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল। শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাতের সংবাদ শুনে সেদিন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) বলেছিলেন, ‘আবদুল মালেক এদেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তবে শেষ নয়।’ এক আবদুল মালেককে শহীদ করে শত্রুরা শত শত আবদুল মালেক সাপ্লাই করেছে আন্দোলনে। এক আবদুল মালেকের শাহাদাতের ফলে আন্দোলন শত শত আবদুল মালেককে পেয়েছে যারা তার মতো মনে-প্রাণে শাহাদাত কামনা করে। শহীদ আবদুল মালেককে হত্যা করে ইসলামী আদর্শকে স্তব্ধ করা যায়নি।