বুধবার, ২৪ মে ২০১৭

আব্দুল আলীম

মৌসুমী মুসল্লীঃ প্রেক্ষিত রমজান

মুসলমানদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস হল পবিত্র মাহে রমজান। এ মাসের মাধ্যমে একজন মুসলমান তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করিয়ে নিতে পারে । অর্জন করতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ তা হল “তাকওয়া”। সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-“হে ঈমানদারগণ তোমাদের ওপর রোযাকে ফরজ করা হয়েছে । যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে”। এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, রমজানের মূল উদ্দেশ্য হল ঈমানদারদের তাকওয়া অর্জনের সুযোগ করে দেয়া। কিন্তু খুব কম মানুষই ভাল করে তাকওয়ার সঠিক অর্থ বুঝে। তাকওয়ার মূল অর্থ হল-বেঁচে থাকা, দূরে থাকা, ভয় করা। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ২০১ নং আয়াতে বলেন-“হে আল্লাহ, তুমি আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ দান কর এবং দোযখের আযাব থেকে বাচাঁও/মুক্তি দাও”। সুরা তাহরীমের ৬ নং আয়াতে বলেন-“হে ঈমানদারগন, তোমরা নিজে এবং তোমার আহল পরিবার কে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও”। সুরা হাশরের ১৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে- “হে ঈমারদারগন! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির লক্ষ্য রাখা উচিত, সে আগামীকালের (কিয়ামত দিবসের ) জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছে ?”

যাই হোক আমার আলোচনা তাকওয়া নিয়ে নয় । আলোচনার মূল বিষয়-কাদের জন্য এই রমজান এবং কারা কিভাবে এটা ব্যবহার করে? আমার আজকের এই লেখা পড়ে মুসলমানদের মধ্যে বড় একটা অংশ হয়তোবা অসন্তুষ্ট হবে। কিন্তু কিছু করার নাই। কুরআন হাদীসের শিক্ষা এবং বাস্তবতা মিলিয়েই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

প্রথমত আমরা দেখব রমজান মাস কাদের জন্য। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনে অনেকভাবে মানুষকে আহবান করেছেন। যেমন- হে আদম সন্তান, হে মানবজাতি, হে আমার বান্দা। তার মধ্যে অন্যতম আহবান হল 'হে ঈমানদারগন'! মহান আল্লাহ তায়ালা রমজানের রোজা ফরজ করেছেন এমনি একটি সুন্দর আহবান দিয়ে। একথা দ্বারা স্পষ্ট যে রমজান শুধুমাত্র ঈমানদারদের জন্য। কাফির, মুশরিকদের জন্য নয়। আবার প্রশ্ন হল, মুমিন কারা? মুমিনের সংজ্ঞা আমরা কুরআন-হাদিস থেকে পাই। সুরা মুমিনুনের ১-১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ”নিশ্চয়ই ঈমানদাররা সফল হয়ে গেছে, যারা তাদের নামাজে খুশু খুজু অর্জন করেছে(বিনয়ী).... তারা তাদের নামাজের হেফাজত করে।”

রাসূলে করীম (স.) হাদীসে ঈমানের ব্যাপারে বলেছেন-ঈমানের সমষ্টি হল “মুখে স্বীকার, অন্তরে বিশ্বাস এবং বাস্তবে আমল।” এ বিষয়গুলো সবারই জানা । অন্য একটি হাদীসে তিনি বলেন - “যে ব্যক্তি আল্লাহ কে প্রভু, ইসলাম কে দ্বীন এবং মুহাম্মদ (সঃ) কে রাসূল হিসাবে মেনে নেয় তারা তাদের ঈমানকে পূর্ণ করে নিল”। ঈমানের আরও ব্যাখ্যা কুরআনের সূরা মায়েদার ৫৪ এবং সুরা আহযাবের ৬৯ নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে ।

ঈমান আনার পর একজন মুমিনের প্রথম কাজ হল ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। কিন্তু অনেক ঈমানদারই আছে যারা নামাজ না পড়ে ঈমান ঠিক আছে বলে দাবী করে। সর্বোপরি কুরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের জন্য রমজান যারা ঈমানদার অর্থাৎ যারা ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখি? বাংলাদেশের কথাই যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে শতকরা ২০% লোক ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। কিন্তু রমজান মাসে রোজা তো প্রায় সবাই পালন করে। এমনকি অধিকাংশ মুসলমান ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়াও শুরু করে ।

মৌসুমী মুসল্লি সমাজে তাদেরকে বলা হয়, যারা রমজান মাস আসলে নামাজ পড়া শুরু করে এবং ঈদুল ফিতরের দিন যোহর থেকে আবারও ১১ মাসের জন্য বিশ্রাম নেয়। আমার প্রশ্ন হল- কুরআন হাদীসের কোথাও কি এটা আছে যে, শুধুমাত্র রমজানে নামাজ পড়া বাধ্যতামুলক অন্য মাসে না পড়লেও চলবে?? সুতরাং বুঝা যায়, এটা আল্লাহর সাথে এক ধরনের প্রতারণা। কোন দলিলের ভিত্তিতে এ সকল মুসল্লি নামাজ ধরেন এবং ছাড়েন?

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে এটাকে তাঁর সাথে ঠাট্টা বিদ্রুপ বলে উল্লেখ করেছেন। সুরা বাকারার ১৩ ও ১৪ নং আয়াতে বর্ণনা করেন -“তারা মনে করে আমরা আল্লাহর সাথে মস্করা করি। আসলে আল্লাহই তাদের সাথে মস্করা করেন”। একই সুরার ৮৫ নং আয়াতেও বলেছেন- “তোমরা কিছু অংশের প্রতি ঈমান আনবে কিছু অংশের প্রতি ঈমান আনবেনা, এরকম যারা কারে তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্চনা এবং কিয়ামত দিবসে কঠোর শাস্তি রয়েছে” ।

মৌসুমী মুসল্লি এজন্য বলা হয় যে, রমজান মাস আসলে তারা নামাজ শুরু করে এবং এ মাস শেষে নামাজ ছেড়ে দেয়। এমনও দেখা গেছে- আজ চাঁদ দেখা গেলে রাতে তারাবী হবে তাই সে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু কোনক্রমে চাঁদ দেখা না গেলে সেদিন আর এশা নামাজে যায়না। অন্যদিকে ঈদুল ফিতরের দিন যোহরের নামাজও অনেক পড়েনা। কারণ রমজান তো শেষ ,মৌসুম শেষ!

এবার আসব কয়েকটি যৌক্তিক ব্যাখ্যায় । যার মাধ্যমে বুঝতে সহজ হবে যে, এরকম মৌসুমী মুসল্লিদের জন্য আল্লাহ তায়ালা রমজান দেননি ।

রমজান শব্দটি উর্দু/ফারসী-এর মূল হল-“রমজ” এর অর্থ হল-জালিয়ে দেয়া,পুড়িয়ে দেয়া,ভস্মীমূত করা। ইংরেজীতে বলা হয়-Remove, Refrsh. যা মানুষের গুনাহ বা দোষ ত্রুটি গুলোকে মুছে দেয়। মুসলমানরা আবারও একটি সজীব সুন্দর ও গুনাহমুক্ত জীবন লাভ করে । আমরা দেখি কম্পিউটার প্রোগ্রাম সমূহে বা সফটওয়্যারে যখন Virus আক্রমণ করে তখন Anti-Virus প্রয়োজন হয় সেটাকে Remove করার জন্য । সহজে একটা কথা ভাবুন তো; রমজান যদি একটি Anti-Virus হয় তাহলে এটা তো তাদেরই প্রয়োজন যাদের কম্পিউটার (ঈমান) আছে । কিন্তু কম্পিউটার নাই বা মোবাইল ডিভাইসও নেই Anti-Virus ক্রয় করে- এরকম কোন পাগল কি আছে ? সুতরাং বুঝা যায়- যারা ১১টি মাস ঈমানের ভিত্তিতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছে এবং সর্ব পর্যায়ে কম্পিউটার নামক ঈমান নিয়ে জীবন পরিচালনা করেছে তাদের জন্যই এই Anti-Virus রমজান । যাদের ঈমান ছিলোনা, ঈমানের দাবী অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেনি তাদের জন্য এই রমজান নয় । বাকী ১১ মাস ঈমানের পথে চলতে গিয়ে যে ভূলগুলো হয়েছিল সেগুলো সংশোধনের জন্য এই রমজান । হ্যাঁ, তবে যদি কেউ নতুনভাবে ঈমান নামক কম্পিউটার/ডিভাইস কিনতে চায় তাহলে নিতে পারবে কিন্তু ঈদুল ফিতরের দিন বিক্রয় করা যাবেনা ।

অন্য কথায় যদি আমরা ধরি রমজান একটি বোনাস, তাহলে যাদের চাকুরী আছে তারাই তো বোনাস পাবে। আম জনতার জন্য তো বোনাস নয় । একজন মুদি দোকানদার যদি আপনাকে বলে-২টা কাপড় কাঁচা সাবান কিনলে মাখা সাবান ফ্রি । এর মানে এটা নয় যে, আপনি মূলটা না কিনে ফ্রি টা পাবেন। সুতরাং যারা মূল ঈমান অনুযায়ী সারা বছর চলার চেষ্টা করে তাদের জন্য এই বোনাস রমজান ।

উল্লেখ্য যে, রমজান তো ফরজ এটা সবার পালন করা কর্তব্য । তাই সবাইকে পালন করতে হবে । কিন্তু এটা তো একটা প্রশিক্ষণ । এ অনুযায়ী বাকী সময় আপনাকে জীবন পরিচালনা করতে হবে,এই সময়ে যে ভুলগুলো হবে তা সংশোধনের জন্য ১১ মাস পর আবারও Anti-Virus দেয়া হবে। এজন্যই আল্লাহ তায়ালারমজান দিয়েছেন । আমরা দুনিয়ার নিয়মে যা দেখি তা হল-কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার মানে বাকী জীবন এই প্রশিক্ষণ কে কাজে লাগানো । যেমন ধরা যাক সেনাবাহিনীতে চাকুরী পেয়ে যারা ট্রেনিং করেন অনেক কষ্ট করেন । তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, যতদিন চাকুরী করবে ততদিন এই প্রশিক্ষন অনুযায়ী চলবে । এর বিপরীত হলে কমান্ডিং অফিসার তাকে শাস্তি প্রদান করবে অথবা চাকুরীও চলে যেতে পারে । সুতরাং আমি যা বুঝাতে চাইলাম তা হল কোন প্রশিক্ষণ নেওয়ার অর্থ হল সেটা অনুযায়ী পরবর্তীতে কাজ করা, ভুলে যাওয়া বা ছুঁড়ে ফেলা নয় ।

রমজান মাস একটি প্রশিক্ষণের মাস। এ মাসে আমরা যে শিক্ষা অর্জন করি, তা বাকী ১১টি মাস মেনে চলতে হবে। কিন্তু দেখা যায় উল্টো চিত্র। এ মাসে নামাজ পড়ে বাকী মাসগুলোতে খবর নাই। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, রমজানের সঠিক শিক্ষা অর্জিত হয় না অথবা গুরুত্ব জানা নাই ।

রমজান একটি পাওয়ার ব্যাংকের নাম। পাওয়ার ব্যাংক যেমন মোবাইল বা ডিভাইস কে রিচার্জ করে তেমনি রমজান মুসলমানদের ঈমানকে রিচার্জ করে দেয়। কারও যদি মোবাইলই না থাকে তাহলে পাওয়ার ব্যাংক প্রয়োজন নাই।

প্রকৃত ভয়ংকর চিত্র হল প্রথম ৭/৮ রমজান মসজিদ গুলোতে যে পরিমাণ মুসল্লী হয় আস্তে আস্তে দিন যত যায় কমতে থাকে। আবার ২৫ রমজানের পরে আবারও বাড়তে থাকে। ভাবখানা দেখে মনে হয় কয়েকদিন হাজিরা দিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে সব আদায় করে নিবে (নাউযুবিল্লাহ) ।

খুব কষ্ট লাগে যখন মৌসুমী মুসল্লিদের চাপে নিয়মিত মুসল্লিরা মসজিদে জায়গা পায় না। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় তারাই আসল নামাজী। অথচ ঈদের পরে তাদের খুজেঁ পাওয়া যায়না ।সার্বিক দিক দেখে মনেহয় রমজান একটি আনুষ্ঠানিকতার নাম।

তবে এজন্য আলেম সমাজও কম দায়ী নন । কেননা ইমাম সাহেব বা আলেমরা শুধু রমজানের ফজীলত বর্ণনা করেন । কোন আমল করলে কত সওয়াব.... !!রমজান কেন আসল, কাদের জন্য, এর প্রকৃত শিক্ষা কি ,বাকী ১১ মাস কিভাবে চলব ? এর কোন বাস্তব শিক্ষা আলোচনা করেন না । কারণ, যদি চাকুরী (ইমামতি) চলে যায় !! তাঁরা যদি কঠোর ভাবে এগুলো বলত তাহলে হয়ত মৌসুমী মুসল্লিরা কিছুটা লজ্জা পেয়ে হলেও নিয়মিত মুসল্লিতে পরিণত হত ।

পরিশেষে বলতে চাই,আসুন মৌসুমী মুসল্লী হয়ে ভাবসাব দেখিয়ে নয়- রমজানের আসল শিক্ষা গ্রহণ করে নিয়মিত মুসল্লিতে পরিণত হই এবং আল্লাহর দেয়া প্রকৃত তাকওয়া অর্জন করি, যা আমাদের কে জান্নাতে যেতে সহযোগিতা করবে। কেননা মুত্তাকীদের জন্যই জান্নাত তৈরী করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-“দৌড়াও তোমার রবের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে যা তৈরী করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য।” (সুরা ইমরান-১৩৩)। তিনি আরও বলেন- যারা মুত্তাকী তারা আল্লাহর কাছে সবচাইতে বেশী সম্মানিত (সূরা হুজরাত-১৩)।মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র মাহে রমজান মাসে রোজা পালনের মাধ্যমে আমাদের সত্যিকারের একজন মুত্তাকী হওয়ার তাওফিক দিন। (আমীন)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 

 

সংশ্লিষ্ট