সোমবার, ০১ মে ২০১৭

সংগৃহীত

ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা

বছর ঘুরে আসে পয়লা মে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটা শ্রমিক দিবস হিসেবে পরিচিত। শ্রমজীবী মানুষের প্রেরণা ও আবেগের দিন এই পয়লা মে। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে আত্মাহুতি দান করেছিলেন শ্রমিকরা। তাদের রক্তাক্ত স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৮৯০ সাল থেকে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দুনিয়ার প্রতিটি দেশে মে মাসের ১ তারিখ নানা আয়োজনে পালন করা হচ্ছে শ্রমিক দিবস। বাংলাদেশও এই দিবসটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে আসছে। সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সকল পর্যায়ে মে দিবস এখন গুরুত্বসহকারে পালিত হচ্ছে। মে দিবস এলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ঘর্মাক্ত মেহনতি মানুষের প্রতিচ্ছবি। আর এই মেহনতি মানুষের অধিকারের প্রশ্নটিও সাথে সাথে উঠে আসে এই ঐতিহাসিক দিনে। তবে এই দিবসের তাৎপর্য অনেক। এর পেছনে রয়েছে একটি রক্তস্নাত ইতিহাস।

প্রেক্ষাপট : মে দিবস
আজ থেকে ১২৬ বছর আগের কথা। তখন বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের সীমা ছিল না। মালিকেরা নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দরিদ্র মানুষের শ্রম কিনে নিতেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাড়ভাঙা শ্রম দিয়েও শ্রমিক তার ন্যায্য মূল্য পেতেন না। মালিকেরা উপযুক্ত মজুরি তো দিতেনই না, বরং তারা শ্রমিকের সুবিধা-অসুবিধা, মানবিক অধিকার ও দুঃখ-কষ্ট পর্যন্ত বুঝতে চাইতেন না। মালিকেরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিককে দাসদাসীর মতো মনে করতেন। আর তাদের সাথে পশুর মতো ব্যবহার করতেন। সুযোগ পেলেই মালিকেরা শ্রমিকের ওপর চালাতেন নানা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন। বলতে গেলে শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারও তখন রক্ষিত হতো না। মালিকেরা প্রায়শই কাজ ছাড়া শ্রমিকের কোনো কথা শুনতেন না। শ্রমিকের গায়ের ঘাম ও সীমাহীন শ্রমের বিনিময়ে মালিকের সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠত। অথচ তার ছিটেফোঁটাও শ্রমিকের ভাগ্যে জুটত না। পরিবার-পরিজন নিয়ে শ্রমিকের কাটত দুর্বিষহ জীবন। তখন শ্রমিকের জন্য কাজের নির্দিষ্ট সময় যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না মজুরির কোন নিয়ম-কানুন। ফলে শ্রমিকের শ্রমকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে মালিক অর্জন করতেন সীমাহীন সম্পদ।

এভাবে শোষণ-নিপীড়ন ও বঞ্চনাই শ্রমিকের ভাগ্যলিখন হয়ে দাঁড়াল। এভাবে মালিকের সীমাহীন অনাচার, অর্থলিপ্সা ও একপেশে নীতির ফলে শ্রমিকদের মনে জমতে শুরু করে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও দ্রোহ। ১২ ঘণ্টা কাজ করেও যখন শ্রমিকের সংসার চলত না, স্বজনের মুখে তিন বেলা খাবার তুলে দেয়া সম্ভব হতো না, তখন শ্রমিকেরা সুযোগ পেলেই প্রতিবাদী হওয়ার চেষ্টা চালাতেন। তবে এ রকম বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ প্রায়শই মালিকের পশুতুল্য ও আগ্রাসী হামলায় হতো ক্ষতবিক্ষত। এমতাবস্থায় জীবনের আশঙ্কা যেমন ছিল, তেমনি শ্রমের সুযোগও হাতছাড়া হতো। ফলে শ্রমিকেরা আরো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতেন। এভাবে চলল বেশ কয়েক যুগ। এমতাবস্থায় আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর প্রথমবারের মতো প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজের দাবি তুললেন। তবে এতে তেমন কাজ হলো না। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবি তো মানলই না, বরং তারা শক্ত অবস্থান নিলো। ফলে এক সময় শ্রমিকের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরণের আকার ধারণ করল। আর সেটা ঘটল আজকের তথাকথিত মানবাধিকার ও সভ্যতার অহঙ্কারী দেশ আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে। কাজের সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরির পরিমাণ বৃদ্ধি ও কাজের উন্নত পরিবেশ তৈরি করাসহ শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ১৮৮৬ সালের পয়লা মে হে মার্কেটের শিল্পশ্রমিকেরা ধর্মঘটের ডাক দিলেন।

 

এ ধর্মঘটে যোগ দেন ৩ লাখ শ্রমিক। তারা কলকারখানা বন্ধ রেখে নেমে এলেন রাজপথে। এতেও মালিকেরা নতি স্বীকার করলেন না। তারা শ্রমিকদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে পিছু হটানোর কৌশল গ্রহণ করলেন। এদিকে পুলিশও কঠোরহস্তে সে ধর্মঘট দমন করার জন্য শ্রমিকদের ওপর চড়াও হলো। পুলিশি অ্যাকশনের প্রতিবাদে ৩ মে ধর্মঘটী শ্রমিকেরা এক সমাবেশের ডাক দিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকেরা এসে এতে যোগ দেন। সেদিন হে মার্কেটের বিশাল সমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন শ্রমিক নেতা আগস্ট স্পিজ। এই সময় মালিকপক্ষের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা সমাবেশস্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে ঘটনাস্থলে একজন পুলিশ সদস্য মারা যায়। এতে বিক্ষুব্ধ পুলিশ বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ শ্রমিকদের ওপর। এতে মুহূর্তের মধ্যেই মারা যান ১১ জন শ্রমিক। এ সময় শ্রমিকদের ন্যায়ানুগ দাবিকে দাবিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে মালিকেরা আরো কঠোর হন। এদিকে শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত করার অপরাধে শ্রমিক নেতা আগস্টসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। শুধু তাই নয়, অভিযুক্তদের প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করে সরকার। তারপর ১৮৮৭ সালে সাজানো মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এর ফলস্বরূপ ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে আগস্ট স্পিজসহ ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামের এক শ্রমিক ফাঁসির আগের দিন কারাগারের ভেতর আত্মহত্যা করেন। আরেকজনের ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এত কিছুর পরও শ্রমিক আন্দোলন দাবিয়ে রাখা যায়নি। বরং সারা দুনিয়ায় শিকাগোর রক্তাক্ত ঘটনার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকায়ও এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাব ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত
শিকাগোর রক্তঝরা শ্রমিক আন্দোলন ক্রমেই সফল হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। মাত্র ৪ বছর পর ১৮৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে শিকাগোর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের জন্য এক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কংগ্রেসের সিদ্ধান্তবলে প্রতি বছর ১ মে ঐক্যবদ্ধভাবে পালনের ঘোষণা প্রদান করা হয়। এভাবেই শুরু হয় মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ফলে ১৮৯০ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমিকেরা ১ মে দিবসটি পালন করে আসছেন। শ্রমিকদের দাবি আদায়ের গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের ক্রমধারায় বিভিন্ন দেশে শ্রমিকেরা আরো ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন। ফলে ১৯২০ সালে রেল, চা বাগান ও স্টিমার শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও সংহতি ব্রিটিশদের কাঁপিয়ে তোলে। এ সময় গড়ে ওঠে ট্রেড ইউনিয়ন। তারাও মে দিবস পালনের চেষ্টা চালায়। তবে বিভিন্ন দেশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকার কারণে গোপনে চলতে থাকে মে দিবস। কিন্তু যেসব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু ছিল সেসব দেশে মে দিবস বেশ আয়োজনের সাথেই পালিত হতে থাকে। সময়ের পরিবর্তনে মে দিবস এখন সারা দুনিয়ায় সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। মে দিবসের ঐতিহাসিক প্রেরণায় কলকারখানা, অফিস-আদালতসহ সকল কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা এখন উজ্জীবিত। যে উদ্দেশ্যে শ্রমিকেরা আন্দোলন করে জীবন দিয়েছিলেন সেই কাক্সিক্ষত কাজের সময়সূচি এখন সকল কর্মক্ষেত্রে অনুসৃত হচ্ছে। মজুরি নির্ধারণের ব্যাপারেও সঠিক নিয়মনীতি আজকাল মানা হয়। তারপরও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা যে নেই তা বলা যাবে না।

বাংলাদেশে মে দিবস
শ্রমিক দিবসের প্রেরণা থেকে বাংলাদেশ মোটেও পিছিয়ে নেই। এ দেশে নারায়ণগঞ্জে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯৩৮ সালে। তখন ব্রিটিশ শাসনামল। তারপর পাকিস্তান আমলেও মে দিবস যথাযথ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পালিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালিত হয়। ঐ বছর সদ্য স্বাধীন দেশে পয়লা মে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। তারপর থেকে আজও পয়লা মে সরকারি ছুটির দিন বহাল আছে। এদিন শ্রমিক সংগঠনগুলো নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে। রাষ্ট্রের সরকারি দল ও বিরোধী দলসহ অন্যান্য বিভিন্ন সংগঠনও দিনটি পালন করে থাকে। এদিন দেশের সকল প্রচারমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় শ্রমিকদের পক্ষে সভা-সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়।

শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির সংগ্রাম ও ইসলাম
আমরা শ্রমিক আন্দোলনের যে ইতিহাস ও তার পূর্বাপর ঘটনাবলি এবং বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করলাম তা থেকে এমন কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়নি যে, ১৮৮৬ সালের পর সুদীর্ঘ একশত ছাব্বিশ বছর পর শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি মিলেছে। এমন কথাও হলফ করে বলা যাবে না যে, শ্রমিক তার অধিকার সত্যিকারার্থে ফিরে পেয়েছেন এবং তারা তাদের কাক্সিক্ষত মজুরি নিশ্চিত করতে পেরেছেন। কর্মক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টা শ্রমের হয়তো বা নিয়ম প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তবে এখনও শ্রমিক নিপীড়ন থামেনি এবং শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা ও শ্রমের মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অহরহ শ্রমিক বিক্ষোভ থেকে আমরা সহজেই এটা অনুধাবন করতে পারি। আমরা হলফ করেই বলতে পারি যে, দুনিয়ার কোথাও শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি এবং তাদের বাঁচার উন্নত পরিবেশ এখনও কাক্সিক্ষত মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে এ ক্ষেত্রে একমাত্র ইসলামই শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এখন থেকে দেড় হাজার বছর আগে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) শ্রমিকের মেহনতের কষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। সে জন্য তিনি যে ঐশ্বরিক বিধান চালু করেছিলেন তাতে শ্রমিক ও শ্রমের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর অমোঘ বাণী জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আজও সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে অতুলনীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ককে ভাই ভাই উল্লেখ করে তিনি তাদের অধিকার ও পাওনার ব্যাপারে যে উক্তি করেছিলেন তা অসাধারণ। মহানবী (সা) বলেছেন, ‘মজুর-শ্রমিক ও ভৃত্যদের যথারীতি থাকা ও পোশাক দিতে হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন।’-বুখারী। মহানবী (সা) শ্রমিককে আপনজনের সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের আপনজন ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে যেমন ব্যবহার কর, তাদের সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করবে।’ একই কথা মহানবী (সা) আরেক হাদীসে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘তোমরা অধীনস্থদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে কোন রকমের কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জান না, তাদেরও তোমাদের মতো একটি হৃদয় আছে। ব্যথা দানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্টবোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন কর না।’-বুখারী।

শ্রমিকেরাও মানুষ। তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও মানবিক অধিকারের প্রতি লক্ষ রাখার বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে মহানবী (সা) বলেছেন, ‘মজুরদের সাধ্যের অতীত কোন কাজ করতে তাদের বাধ্য করবে না। অগত্যা যদি তা করাতে হয় তবে নিজে সাহায্য কর।’ (বুখারী) মালিকের প্রতি শ্রমিককে তার অধিকার নিশ্চিত না করার পরিণাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহানবী (সা) কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি কঠিন অভিযোগ উপস্থাপন করব-যে ব্যক্তি আমার কাউকেও কিছু দান করার ওয়াদা করে প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করল, কোন মুক্ত স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করে যে তার মূল্য আদায় করল এবং যে ব্যক্তি অন্যকে নিজের কাজে নিযুক্ত করে পুরোপুরি কাজ আদায় করে নিলো, কিন্তু তার মজুরি দিলো না-ওরাই সেই তিনজন।’ (মিশকাত) শ্রমিকের প্রতি মালিক যাতে সহনশীল থাকে এবং তার ভুলত্রুটি ক্ষমার মতো মহৎ মনের অধিকারী হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে আল্লাহর নবী (সা) এক হাদীসে বলেছেন, ‘মজুর চাকরদের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা মহত্ত্বের লক্ষণ।’ মহানবী (সা) আরো বলেছেন, ‘অসদাচরণকারী মালিক বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ শ্রমিকের মজুরি আদায়ের ব্যাপারে মহানবী (সা) এর অতি পরিচিত এবং বিখ্যাত একটি উক্তি সবার জানা। তিনি বলেছেন, ‘মজুরকে তার গায়ের ঘাম শুকাবার আগেই মজুরি পরিশোধ করে দাও।’ শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মহানবী (সা) এর এই বাণী শ্রমিকের মর্যাদার বিষয়টিকে আরো বেশি মহীয়ান করেছে। এভাবে ইসলাম শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার যে গ্যারান্টি দিয়েছে, তা দুনিয়ার আর কোনো মতবাদ বা দর্শন দেয়নি। আধুনিক বিশ্বের পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী রাষ্ট্র দর্শনের কোনটাই শ্রমিকের প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদার ন্যূনতম সমাধান দিতে পারেনি। ফলে এখনও শ্রমিক-মজুররা নিষ্পেষিত হচ্ছে। মালিকের অসদাচরণ, কম শ্রমমূল্য প্রদান, অনপযুক্ত কর্ম পরিবেশ প্রদানসহ নানা বৈষম্য শ্রমিকের দুর্দশা ও মানবেতর জীবনযাপনের কারণ হয়ে আছে।

পরিশেষে মে দিবসের প্রাক্কালে আমরা বলতে চাই, নানা আয়োজনে প্রতি বছর শ্রমিক দিবস পালন করার মধ্যে শ্রমিকের প্রকৃত কোনো মুক্তি নেই। যে অধিকারের জন্য শ্রমিকরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন শিকাগোর রাজপথে, তা বাস্তবে এখনও অর্জিত হয়নি। আজও শ্রমিকেরা পায়নি তাদের কাজের উন্নত পরিবেশ, পায়নি ভালোভাবে বেঁচে থাকার মতো মজুরি কাঠামো এবং স্বাভাবিক ও কাক্সিক্ষত জীবনের নিশ্চয়তা। মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে শ্রমিকের প্রতি মালিকের সহনশীল মনোভাব থাকতে হবে। শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আলোকে তাকে কাজ দিতে হবে। শ্রমিককে মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য তার মজুরি সেভাবে নির্ধারণ করতে হবে। মালিককে অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, তার নিজের স্বজনরা যে রকম জীবনযাপন করবে, তার অধীনস্থ শ্রমিকরাও সে রকম জীবনের নিশ্চয়তা পাবে। মালিক-শ্রমিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে ইসলাম যে শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে, তাকে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা গেলে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা অবশ্যই সুরক্ষিত হবে ইনশাআল্লাহ।

সংশ্লিষ্ট