মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল ২০১৭

ড. মোবারক হোসাইন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা বনাম চলমান রাজনীতি

বাংলাদেশের আপামর জনতা সবসময়ই অন্যায়-অত্যাচার ও নিপীড়নের বিপরীত স্রোতে গা ভাসাতেই বেশি পছন্দ করে। তাদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তারা সবসময় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিবোধ গড়ে তুলেছে। তারা কখনোই মাথা নোয়ায় নি, চির উন্নত শির, বীর বাঙ্গালী হিসেবে তাদের আত্মপরিচয়কে তারা শাণিত করেছে যুগে যুগে। যার প্রমাণ মেলে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৮০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামে। কিন্তু সেই গৌরবোজ্জল বীরপুরুষরা এখন দিনে দিনে হয়ে পড়েছে নতজানু, নিঃবীর্য প্রতিবাদহীন, অদৃষ্টে বিশ্বাসী এক পলায়নপর জাতি। একসময় যেসব রাজনীতিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র হরণকারী ও স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে তার পতন ঘটিয়ে দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিল। বর্তমানে হাসিনা-মেনন-সুরঞ্জিত-ইনু’র মতো সেসব শক্তিশালী রাজনীতিকরা সেই স্বৈরাচারের হাতেই আবার হাত মিলিয়ে ক্ষমতা দখল করে অন্ততপক্ষে এটা প্রমাণ করেছে যে তারা আপামর জনতা বা দেশের গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি, নিজেদের আখের গোছাতেই সে সময় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছে। তাদের মুখে প্রতিনিয়ত গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো কথা শুনা গেলেও ক্ষমতার মোহে পড়ে নিজেদের পকেট বাচাঁতে আজ নিজেরাই গণতন্ত্র নস্যাৎকারী স্বৈরাচারীর বগলে মাথা লুকিয়ে প্রতিনিয়ত গণতন্ত্রকে হরণ করছে। তাদের বুকে আজ আর সেই তেজ নেই। সেই বীরপুরুষরাই নতজানু হয়ে আজ ক্ষমতা পেয়ে নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছে। ক্ষমতার মোহ ও বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা আমাদেরকে একটি অধঃপতিত জাতিতে পরিণত করেছে। জাতির এ চেতনাগত অবক্ষয় শীঘ্রই আমাদের ঠেকানো দরকার। নচেৎ জাতি হিসেবে আমাদের স্বাধীন সত্ত্বাকে টিকিয়ে রাখা যাবেনা। আর অবজ্ঞা করা হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে।

ইতিহাসের পালাবদলে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে স্বদেশী কুচক্রী মহলের আঁতাতের মধ্যে দিয়ে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সেনাবাহিনী পরাজয়বরণ করে ঘরের শত্রু বিভীষণ মীরজাফর আলী খাঁ, উমি চাঁদ আর ঘোষেটি বেগমদের চক্রান্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সেনাপতি রোবার্ট ক্লাইভের কাছে। রাজা যায়, রাজা আসে; তাতে প্রজার কি! এটাই বাংলাদেশের সাধারণ জনতার জীবনে একটি চিরন্তন ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাই বিদেশী বেনিয়ার কাছে সিরাজের এ পরাজয়ে সাধারন মানুষের কোন মাথাব্যাথা ছিল না। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী সবসময়ই ছিলো জনবিচ্ছিন্ন এবং বর্তমানেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন্। আর এই জনবিচ্ছিন্নতাই আমাদেরকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের চরম পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশের মানুষ কখনোই পরাধীনতাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি, বশ্যতা স্বীকার করেনি বহিরাগত শক্তি কিংবা বহির্শক্তির সেবাদাস দেশীয় শোষক শ্রেনীর কাছে। তাই ইংরেজদেরকে আমাদের দেশ ছাড়তে হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বেশ নাজুক পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশী জনগন তাদের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব তথা জাতি হিসেবে স্বাধীন সত্তা লাভ না করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের অংশে পরিনত হয়। তারপর পাকিস্তানী শাসকদের বৈষম্যমূলক আচরন এবং স্বেচ্ছাচারীতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা আবার রুখে দাড়িয়েছে তীব্র গণ-আন্দোলন প্রতিরোধ আর আত্মদানের মধ্য দিয়েই তাদের ছিনিয়ে এনেছে আমাদের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। অবশেষে লাখো শহীদের আত্মদানে বাংলার স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য পুনরুদিত হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী ময়দান নামে পরিচিত। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় বাংলাদেশ- একটি স্বাধীন স্বার্বভেমৈ রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব জাতি হিসেবে আমাদের কতটুকু আছে তা আজ ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষনের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস সবার জানা থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে পারিনি। সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত আমাদের জীবন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ না করে আমরা জড়িয়ে পড়েছি জাতিকে বিভাজন করার তর্কে। নানা প্রচেষ্টায় স্বজ্ঞানে কিংবা অবচেতনভাবে। আর সেই হীন ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থতার পথে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি লাভের প্রতিযোগীতায় মেতে উঠেছে সমাজের শাসকদলের কর্তাব্যক্তিবর্গ। আমাদের এই বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত দারিদ্র পীড়িত বাংলাদেশে জাতির সামনে হাজারও সমস্যা ও সংকট। অর্থের সংকট, খাবারের সংকট, আবাসন সংকট, পোষাকের সংকট, ঔষধের সংকট, বিদ্যুৎ সংকট, গ্যাস সংকট, পানি সংকট, যানবাহন এবং যানজট সংকট, শিক্ষার সংকট, আর সর্বশেষ আমাদের চারিত্রিক সংকট। এতকিছু সংকটের পরেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সব সংকট সমস্যা নিয়ে দেশ পরিচালনাকারী শাসকদলীয় কর্তাব্যক্তিদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তাদের মাথাব্যাথা আজ শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধী ইস্যু নিয়ে।

১৯৭১ সালে যে বিষয়টির সমাধান হয়ে গেছে স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর আজ সেই যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে সামনে এনে পুরো জাতিকে দুই ভাগে বিভক্ত করার অপচেষ্টা চলছে। যুদ্ধাপরাধ বুলির পর তাদের নতুন আবিষ্কার মানবতাবিরোধী অপরাধ। সরকার যেখানে প্রতিটি পদে পদে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, গণতন্ত্র যেখানে আজ বিপন্ন, মানুষের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই, রাস্তায় বের হলে সে বাড়ীতে ফিরতে পারবে কিনা তার নেই কোন নিশ্চয়তা, নেই কোন স্বাধীনতা, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নেই কোন স্বাধীনতা, একের পর বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন চ্যানেল ও সংবাদপত্র, অন্যায়ভাবে গ্রেফতার ও রিমাণ্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে দেশের সুনামধন্য সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে, একদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপর চালানো হচ্ছে দমন-পীড়ন ও একের পর এক মামলা-নির্যাতন, অন্যদিকে নিজ দলের খুনের আসামীদের মামলা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে, যারা কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে পুনরায় দিনে-দুপুরে জনসম্মুখে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করছে, মেধাবীদের বাদ দিয়ে আদালত থেকে সুইপার কলোনী পর্যন্ত সর্বত্র চলছে দলীয়করণ ও নিয়োগ বাণিজ্য, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, বিদ্যুত পানির সমস্যাসহ নানা সংকটে দেশের মানুষের জীবন জীবিকা যেখানে দূর্বিসহ ঠিক সেই সময় এসব সমস্যার সমাধানের কথা বিবেচনা না করে শাসকদল আজ মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছে যুদ্ধাপরাধ ইস্যূ নিয়ে। জনগণের সমর্থন পেয়ে নির্বাচিত এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা নির্বাচিত সাংসদদের আজ যেখানে সংসদে গিয়ে দেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল সেখানে আজ তা তো হচ্ছেই না বরং প্রতি মিনিটে লাখ লাখ টাকা খরচ করে চলা সংসদে আজ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কুরুচীপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে কে কার চেয়ে বেশি বকতে পারে সেটা তাদের নেত্রীর সামনে জাহির করার চেষ্টা করছে।


আমার এই কথাগুলোর দ্বারা আমি একথা বুঝাতে চাচ্ছিনা যে আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই না। বরং আমিও চাই প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে শুধুমাত্র কোন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিচার করা হলে সেটাকে অবশ্যই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায় না এবং সেটা সমর্থনযোগ্যও নয়। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরেও আজ কে যুদ্ধাপরাধী, কে পাকিস্তানের গুপ্তচর, কে রাজাকার, কে মুক্তিযোদ্ধা এসব বিষয় সামনে এনে জাতিকে দ্বিধাবিভক্তিকে ফেলে দেয়া হচ্ছে। সরকার তথা আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বললেই অনেকে রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায় আর সরকার তথা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের পক্ষে কথা বলতে গেলেই আজ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলিল, জেড ফোর্সের প্রধান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, ও মাওলানা ভাসানীর মতো মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানের গুপ্তচর, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারসহ বিভিন্ন উপাধীতে ভূষিত করা হচ্ছে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর আজ মানুষ কি এসব কিছু দেখার জন্যই মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিল? দেশে আজ এখনও যেখানে শত শত মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে কোন সনদ বা স্বীকৃতি না পেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করে মারা যাচ্ছে অথবা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধে পক্ষের শক্তির দাবিদার পরিচয় দিয়ে বর্তমান সরকার সার্টিফিকেট সর্বস্ব মুক্তিযোদ্ধাদের নাতী-নাতনিদের চাকরি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আজ যদি আমাদের দেশ ও জাতির কর্ণধারেরা সংকটাপন্ন জাতির হাজারো সমস্যা একটি একটি সমাধানের জন্য উদ্যোগী হতেন, প্রচেষ্টা চালাতেন জনগনের দুর্ভোগ কমাতে তবে স্বাধীনতার এত বছর পরেও দিন দিন আমাদের সংকট অন্তত এত ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যেত না।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বর্তমানে এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে দেশেন রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে রাজনৈতিকপ্রতিহিংসার মাধ্যমে। আর সেই প্রতিহিংসার বলীর পাঠাঁ হচ্ছে দেশ ও দেশের অসহায় জনগন। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানোকেই রাজনীতির রাজপথে বিচরণের প্রধান লক্ষ্য মনে করে। তাই আমাদের দেশে রাজনীতি হয়ে ওঠে তোষণ, শোষণ আর ক্ষমতার অপব্যবহারের হাতিয়ার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও দার্শনিক তাৎপর্য কি, সেটা আমাদের অনুধাবন করা দরকার নির্মোমভাবে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধ চেতনাগত ব্যাখ্যা নয়, সে ব্যাখ্যা হওয়া চাই জ্ঞাননির্ভর, প্রজ্ঞাদীপ্ত ও জীবন বাস্তবতার আলোকে। পুরো জাতির কৃতিত্বকে খাটো করে, ব্যক্তি বিশেষের বা কোন দলের কীর্তি গাঁথাই কি আমাদের স্বাধিকার আর স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাস? সেই একদেশদর্শী চেতনাগত দারিদ্রের কারণেই প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম দিচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে। ফলে অপর দল কিংবা গোষ্ঠী তার বিপরীতে তৎপর থাকছে নতুন ও বিকল্প ইতিহাস খুজঁতে কিংবা বানাতে। আমাদের জাতীয় ইতিহাস বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে দলীয় হীনমন্যতার কারণে- আর সাধারণ মানুষ তা থেকে বিশ্বাস হারাচ্ছে। হারাচ্ছে শ্রদ্ধা জাতির প্রতি, নেতা-নেত্রীদের প্রতিও। জাতীয় প্রচার মাধ্যমে কিংবা জনসভাগুলোতে গলাবাজী আজ অন্ত:সার শূন্যতায় পরিণত হয়েছে। কি নগ্ন আর দুর্বিনীত মিথ্যাচার করছে আমাদের নেতা-নেত্রীরা।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক আদর্শ জাতির কাছে বড় করে তুলে ধরতে হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সুস্থ বিতর্ক হওয়া উচিত যে আমরা কোন ধরণের রাষ্ট্র চাই, তার জন্য কোন ধরণের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও পরিকাঠামোয় আমাদের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশ নিশ্চিত করা যায়। কিভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতির অবস্থানকে সুসংহত করা যায়- সেই বিতর্কই এখন সবার আগে করা দরকার। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় পারিপার্শ্বিক ও আন্তর্জাতিক আর্থ- সামাজিক ও আগ্রাসন এবং আধিপত্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে জাতিকে নিরাপত্তা কিভাবে দেয়া যেতে পারে, সেটাই হওয়া উচিত আমাদের রাজনৈতিক আদর্শের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের সবার সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে নতুন বাংলাদেশ। আমরা ভবিষ্যতে কি হতে চাই. সেটাই হওয়া উচিত আমাদের রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়।

একটি দেশের স্বাধীনতার অর্থ কেবল সেদেশের ভূ-খন্ডের উপর বসবাসকারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধ নয়। জাতি হিসেবে যখন অধিবাসীরা সংঘবদ্ধভাবে ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে জাতিসত্তার পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং মুক্ত জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, তখনই কেবল জাতি হিসেবে তাকে প্রকৃত স্বাধীন বলা চলে। বহু ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়ে কেনা আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা। চওড়া দামে কেনা এই স্বাধীনতাকে কত সস্তায় না আমরা বিকিয়ে দিচ্ছি। আমরা কি একটি হতাশাগ্রস্ত দু:খ বিলাসী জাতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছি? আমাদের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে, হবে-সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রতিটি জাতিই তাদের নিরাপত্তা, স্বার্থ,ও ভবিষ্যত নিয়ে সচেতন সেটা নিয়ে হাপিত্যাস কিংবা হাল ছেড়ে দিলে কি চলবে? কারণ অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা-এই সহজ সত্যটিকে আমাদের বুঝতে হবে। তাইতো আমরা দেখি আমাদের রাজনীতিবিদদের বিদেশী রাষ্ট্রদুতের দরজায় ধর্না দিতে।

অথচ তারাতো জনতার কাছে ধর্ণা দিচ্ছে না ভোটের সময় ব্যতিত। আমাদের রাজনীতিবিদরাই কি কেবল খারাপ, নাকি আমরাও খারাপ? তারাতো আমাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমরা তাদেরকে আমাদের নেতা হিসেবে নির্বাচিত করছি কিংবা মেনে নিচ্ছি বলতেই তারা আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বুদ্ধিবৃত্তির দীনতার কারণেই আমরা নিজেদের অসহায় ভাবি। আমাদেরকে যেভাবেই খাওয়ানো হচ্ছে, আমরা সেভাবেই খাচ্ছি এবং বমি করে দিচ্ছি। জ্ঞানীয় দ্বীপ্তিতে আলস্যকে ত্যাগ করে নিলর্জ্জ জ্ঞানপাপীদের খপ্পরে থেকে নিজেদের উদ্ধার করতে হবে।

দুষ্টের দমন আর শিষ্টের লালনের মাধ্যমেই একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন। আমরা হতাশ নই, আমরা আশাবাদী। আমাদের জাগরণের মাধ্যমেই আমাদের মুক্তির পথ। তাই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে আত্বিবিশ্বাস নিয়ে, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সকল অন্যায় অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে। অর্থনৈতিক, সামাজিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য আমাদের কে দলীয় ও মতাদর্শগত সংকীর্ণতা পরিহার করে উদার এবং আন্তরিকতার সাথে কর্মে ব্রতী হতে হবে। তবেই না আমাদের স্বাধীনতা দেশ ও জাতির কল্যাণের পথ প্রশস্থ করবে।

আমরা যদি ভাষা আন্দোলনের এই মাসে এবং স্বাধীনতা দিবসের পূর্বের মাসে এ বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যত অতি তাড়াতাড়ি আমাদের হাতের মুঠোয় এসে পরবে। হতাশা আর ব্যর্থতা নিয়ে হাপিত্যাস নয়, কর্ম ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক আমাদের জীবন, জাতীয় কল্যানের পথ হোক প্রশস্থ। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম একথা যেমন দিবালোকের ন্যায় সত্য তেমনি স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর আজ আমাদের এই প্রাণের মাতৃভূমিকে নিয়ে দেশ বিরোধী যেসব চুক্তি হচ্ছে, দেশকে বিদেশীদের কাছে বিকিয়ে দেয়ার যে চক্রান্ত চলছে, মুক্তিযুদ্ধের ধোঁয়া তুলে দেশের জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করার যে অপচেষ্টা চলছে, মুসলিম অধ্যূষিত এ বাঙ্গালী জাতির বাঙ্গালী সংস্কৃতির ওপর কিং খান কনসার্ট এর নাম করে যে বিদেশী অপসংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে এসবের জোড়ালো প্রতিবাদ যদি না করতে পারি তাহলে স্বাধীনতার এত বছর পরে আবার বাঙ্গালী জাতিকে আরেকটি যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করতে হবে একথাও র্নিদ্বিধায় বলা যায়। 

সেক্রেটারী জেনারেল, ইসলামী ছাত্রশিবির

সংশ্লিষ্ট