শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন

০৪ আগস্ট ১৯৭১ - ১২ জানুয়ারি ১৯৯৩ | ৫২

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

ইসলামের জন্য যুগ যুগান্তরে সাহসী মুজাহিদ ছিলেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন। দ্বীনের পথে তেমনি একজন সাহসী সৈনিক মোশাররফ হোসাইন। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা পিতার যোগ্যতম এক সন্তান। বাবা-চাচা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন দেশকে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী দলের ছাত্রসংগঠনের ফ্যাসিবাদী আচরণের নির্মম শিকার হন শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন।

পারিবারিক পরিচয়
শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার জয়পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বাবা কাজী সামছুল হুদা তার স্ত্রীকেসহ পরিবারকে সীমান্তের ওপারে ভারতের করিমাটিয়া রেখে দেশে চলে আসেন মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্যে। স্ত্রী হোসনে আরা তার একমাত্র কন্যা কাজী দিলারা আকতারকে নিয়ে ভারতে বসবাস করতে লাগলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই সামছুল হুদার পরিবারে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া, আদরের কন্যা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টা করে বাঁচানো গেল না দিলার আকতারকে। মেয়ের শোকে ভেঙে পড়ে মা হোসেনে আরা। ঠিক সে মুহূর্তে অমবস্যার কালো আঁধারের মাঝে দেখা গেলো পূর্ণমিার চাঁদ। ৪ আগস্ট ১৯৭১। পৃথিবীতে আসলেন কাজী মোশাররফ হোসাইন। যাকে পেয়ে মা হোসনে আরা বেগম মেয়ের শোক কিছুটা কম অনুভব করতে লাগলেন। কিন্তু না; হোসনে আরা বেগমের সে আনন্দ বেশি স্থায়ী হতে দেয়নি মুজিববাদী ছাত্রলীগ। একদিন মোশাররফের মত নিষ্পাপ উদীয়মান তরুণকেও মুজিববাদী হায়েনাদের নির্মম ব্রাশফায়ারে শিকার হতে হয়েছে।

শিক্ষাজীবন
শিক্ষার হাতে খড়ি পিতার কাছেই। ভর্তি করালেন শুভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি ক্লাসেই ১ম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন। ভর্তি হলেন জয়পুর সরোজিনী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত মেধার সাক্ষ্য রাখলেন আগের মতই। এসএসসি পাস করলেন ১ম বিভাগে। ভর্তি হলেন ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে। শরিক হলেন শহীদী কাফেলায়। এইচএসসি পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হলেন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে। গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলেন মোশাররফ হোসাইন। তিনি শুধু মেধাবী ছাত্রই ছিলেন না বরং সুবক্তা ছিলেন। তাইতো তার মুক্তিযোদ্ধা চাচা তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার জন্য নিয়ে যেতেন।

সাংগঠনিক জীবন
কাজী মোশাররফ হোসাইন সংগঠনের কর্মী ছিলেন। ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজে অধ্যায়নকালে সংগঠনে যোগ দেন। মেধাবী ছাত্র কাজী মোশাররফ হোসাইন পড়াশোনা ছাড়া অন্য সময়গুলো দাওয়াতি কাজে লাগাতেন। তার চরিত্র ছিল চুম্বকের মত আকর্ষণীয়। তিনি তার দাওয়াতি চরিত্র দিয়ে সহপাঠী বন্ধু বান্ধব সকলকে আকৃষ্ট করেছিলেন। শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি ইসলামী আন্দোলনের কাজ করতেন।

শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা
১২ জানুয়ারি ১৯৯৩ এর সকালবেলা কাজী মোশাররফ হোসাইন তাঁর রুমমেটদের শোনালেন এক দুঃস্বপ্নের কথা। ছাত্রলীগের গুন্ডারা তার বাবাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ হস্তান্তরে জন্য বিশ হাজার টাকা দাবি করে। হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। সারাদিন আনমনে কেটে যায় তার। বিকালে কখনও ফুটবল না খেললেও সেদিন ফুটবল খেলতে নামেন প্যারেড ময়দানে। অনেকের চেয়ে ভাল খেললেন তিনি। মনও কিছুটা হালাকা হয়েছে তার। মাগরিবের নামাজ পড়ে সরলেন পড়ার টেবিলে। কিছুক্ষণ পর খবর এলো শিবির কর্মী জিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। প্রতিবাদে মিছিল বের হল। মিছিলে যোগদান করলেন মোশাররফ। মিছিল চলছিল সিরাজউদদৌলা রোড হয়ে আন্দরকিল্লার দিকে। সামনের সারিতে দৃঢ়পদে চললেন কাজী মোশাররফ । মিছিল যখন দেওয়ান বাজার সাব এরিয়ায় পৌঁছল তখন গলির অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে ব্রাশফায়ার শুরু করল। বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হলো সামনে থাকা মোশাররফ, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পান করলেন শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা। আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন তিনি। অকালে ঝরে গেল একটি প্রাণ। প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে গেল একটি তাজা গোলাপ। ইসলামী জীবনব্যবস্থা কায়েমের পথে অগ্র পথিক হয়ে রইলেন আমাদের মাঝে। শহীদের মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেন সহপাঠী বন্ধু, শিক্ষক সবাই। তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. আব্দুস সবর প্রিয় ছাত্রের মৃত্যুতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শহীদের কফিন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে মা প্রশ্ন করেন কোন অপরাধে তার সন্তানকে জীবন দিতে হল। যদি তার ছেলে অপরাধ না করে তবে তাকে ফিরিয়ে দিতে। মা সন্তানকে ফিরে পাবেন না, সে জন্য ব্যথিত হৃদয়ে আজীবন কাটাবেন। ছেলে কিন্তু ব্যথিত নয়। কারণ তার তিনি জীবন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গল্প করছেন জান্নাতের সুবজ পাখিদের সাথে।

শহীদের চাচার বক্তব্য
শহীদের চাচা কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কেন সন্তান হত্যার বিচার পেলাম না। আমরা কি জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছিলাম সন্তান হারাবার জান্য? সন্ত্রাস মদদ দানের জন্য? হোসনে আরা আজো কাঁদেন পুত্রশোকে। কেউ তাকে দেখতে গেলে ছেলের মতই ভাববেন তাদেরকে। এক সন্তানকে হারিয়ে লক্ষ সন্তানের মাতা আর সামছুর হুদা লক্ষ ছেলের পিতা হলেন। শহীদ মোশাররফ তার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। জান্নাত থেকে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। দায়িত্ব আমাদের এ জমিনে কালেমার পাতাকা উড়াবার। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কষ্ট পাবেন, অভিযোগ করবেন আমাদের বিরুদ্ধে। আমাদের দাঁড়াতে হবে আখেরাতের কাঠগড়ায়।

একনজরে শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন
নাম: কাজী মোশাররফ হোসাইন
পিতার নাম : মাস্টার কাজী সামছুল হুদা
মাতার নাম : হোসনে আরা বেগম।
ভাইবোনদের সংখ্যা : ২ ভাই, ৩ বোন
ভাইবোনদের মাঝে অবস্থান : সবার বড়।
স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম- জয়পুর, পো: শুভপুর, থানা: ছাগলনাইয়া, জেলা: ফেনী।
জন্মতারিখ : ৪ আগস্ট ১৯৭১
শিক্ষাগত যোগ্যতা : অনার্স ২য় বর্ষ, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ
শহীদ হওয়ার তারিখ : ১২.০১.১৯৯৩ সাল (১১ তারিখ সন্ধ্যায় আহত)
শহীদ হওয়ার স্থান : দেওয়ান বাজার সাব এরিয়া, চট্টগ্রাম
কবরস্থান : নিজবাড়ির আঙিনা
যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম মহানগরী
সাংগঠনিক মান : কর্মী
যাদের হাতে শহীদ : মুজিববাদী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ কাজী মোশাররফ হোসাইন

পিতা

কাজী শামসুল হুদা

মাতা

হোসনে আরা বেগম

জন্ম তারিখ

আগস্ট ৪, ১৯৭১

ভাই বোন

২ ভাই ৩ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

জয়পুর, শুভপুর, ছাগলনাইয়া, ফেনী

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

অনার্স ২য় বর্ষ, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ

শাহাদাতের স্থান

দেওয়ান বাজার সাব এরিয়া চট্টগ্রাম।