শহীদ মু. আতিকুল ইসলাম (দুলাল)

৩১ জানুয়ারি ১৯৭১ - ১৮ জুলাই ১৯৯২ | ৪৮

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

নিষ্ঠুর জোড়াখুনের প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে রাজধানীসহ গ্রামগঞ্জে। প্রতিটি বিবেকবান মানুষ জোড়া খুনের ঘটনায় নির্বাক হয়ে পড়ে। শোকের ছায়া নেমে আসে সর্বত্র। বিস্ময়কর যে, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরও বিএনপি ও অন্যান্য সংগঠনগুলো লাশের রাজনীতির খেলায় মেতে ওঠে। ১৯৯২ সালের ১৮ জুলাই চিরবিদায় নেন শহীদ আতিকুল ইসলাম দুলাল। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সত্যের সৈনিক।

প্রাথমিক পরিচয়
১৯৭১ সাল শহীদ আতিকুল ইসলমা দুলাল দক্ষিণ ইসলামপুর, সদর মুন্সিগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম আলী মিয়া। ১২ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ২য়।

শিক্ষাজীবন
প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন শহীদ আতিকুল ইসলাম দুলাল। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন মুন্সিগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ে। শহীদ হবার পূর্ব পর্যন্ত এই উচ্চবিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিলেন।

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
ঐ দিন ছিল জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর চত্বর জামায়াতে ইসলামী আহত ঐতিহাসিক জনসমাবেশ। স্মরণকালে বৃহত্তম এই সমাবেশ রীতিমতো জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। দৈনিক বাংলা মোড় থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত এই বিশাল চত্বর লোকে লোকারণ্য ছিল। গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানোর পরও কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। যে এক অভাবনীয় দৃশ্য। মনে হয়েছিল রাজধানীতে মানুষের ঢল নেমেছে। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর দৈনিক বাংলা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত যেমন লোক লোকে ভরে গিয়েছিল এ দৃশ্য তাকেও তার মানায়। এর সাথে সাথে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর। গোলাম আযমের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে ইত্যাদি গগণবিদারী শ্লোগান ফ্যাসিস্ট গণআদালতীদের ভিত কাঁপিয়ে তুলেছিল। তথাকথিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি জামায়াতের সমাবেশ পন্ড করার কুমতলবে উস্কানিমূলকভাবে পালা সমাবেশের আহ্বান করেছিল। সমাবেশে আসার সময় জনতার উপর বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে ককটেল নিক্ষেপ ও বোমা হামলা চালানো হয়। তারা চেয়েছিল যে কোনভাবে হাঙ্গামা বাধিয়া সমাবেশ পন্ড করে দেয়। কিন্তু সমাবেশে আগত ছাত্র-জনতার পরম ধৈর্যের মুখে তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। সমাবেশে শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হয় মাগরিবের পূর্বে। এ দিকে হাজারো ষড়যন্ত্রের মুখে জামায়াতের জনসমাবেশের ঐতিহাসিক সফলতা ও বিপুলসংখ্যক জনসমাগম দেখে ঘাতক কমিটির দুর্বৃত্তদের মাথা ঘোরপাক খেতে থাকে। দুর্বৃত্তরা খুনের নেশায় উন্মাদ বনে যায়।

শাহাদাতের ঘটনা
১৮ ই জুলাই ১৯৯২ সালে মাগরিব নামাজের পর ঢাকার আশপাশ থেকে আগত ছাত্র-জনতা বাসে চড়ে পায়ে হেঁটে ফিরে যাচ্ছিল। মুন্সিগঞ্জ থেকে আগত জামায়াত শিবিরে কর্মীরা বাসে উঠার জন্য মতিঝিলের দিকে যাচ্ছিল। তাদের বাসটি রাখা ছিল জনতা ব্যাংক ও বাংলার বাণী পত্রিকার সম্মুখস্থ রাস্তায় । নির্র্মূল কমিটির ১৫/২০ জন সশস্ত্র খুনি পূর্ব থেকে ওঁৎ পেতেছিল খুনের নেশায়। জামায়াত শিবির কর্মীরা যখন বাসে উঠছিল ঠিক তখন ঘাপটি মেরে থাকা দুর্বৃত্তরা বোমা হামলা ও স্টেনগানের ব্রাশফায়ার করে। মুহূর্তের মধ্যে বিস্তর এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ ও বোমার আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন শিবিরকর্মী আতিকুল ইসলাম দুলাল (২২) ও সাইজুদ্দীন (১৪)। দুর্বৃত্তরা বোমা হামলা ও ব্রাশফায়ারে পর লাঠি রড- হকিস্টিক দিয়ে নির্দয়ভাবে পিটায়। ঘাতকদের আঘাতে শহীদ দুলালের মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এরপর খুনিরা তার বুকের উপর উঠে পিষতে থাকে। এতে তার জিহ্বা বের হয়ে পড়ে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেয়ার পথে তিনি শাহাদাতের কোলে ঢলে পড়েন। দুর্বৃত্তচক্রের ঐ জঘন্য হামলায় অন্তত : ৫০ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে মনিরুজ্জামান মুন্না ও শাহ আলমের অবস্থা ছিল গুরুতর।

শহীদের জানাযা ও দাফন
১৯ জুলাই ১৯৯২ তারিখ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিহত সাইজুদ্দীন ও দুলালকে তাদের কর্মী বলে দাবি করে। কয়েকজন মন্ত্রী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে লাশ ছিনিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইজুদ্দীন ও দুলালকে তার দলীয় কর্মীর ধুয়া তুলে লাশ শিবিরকে ফেরত দিতে অস্বীকার করে। পরে অবশ্য শহীদের আত্মীয়স্বজন তাদের ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী বলে পরিচয় দিলে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয় এবং ধীরে ধীর হাসপাতাল ত্যাগ করে চলে যায়।

দুই শহীদের লাশের কফিন বেলা আড়াইটার দিকে বায়তুল মোকাররম উত্তর চত্বরে নিয়ে আসা হয়। জোহরে নামাজের পর জানাযার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। বিএনপির ষড়যন্ত্রের কারণে লাশ হাতে পেতে দেরি হয়েছিল। শোকাহত হাজার হাজার ছাত্রজনতা জানাযার জন্যে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে থাকে। শহীদের পবিত্র চেহারা একনজর দেখার জন্য জনতা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে লাশ দেখানো বন্ধ করে দিতে হয়। এরপর জানাযার পূর্বে শহীদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও সংসদীয় দলের নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, ইসলমাী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল হামিদ হোসাইন আজাদ প্রমুখ। এরপর দুই শহীদের সুবিশাল জানাযায় ইমামতি করেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। জানাযার দৃশ্য ছিল অভাবনীয়। হাউস বিল্ডিং ফিন্যান্স কর্পোরেশন থেকে দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত কোথায়ও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। জানাযার পর দুই শহীদের কফিন জনতা সায়েদাবাদ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে।

শহীদের কফিন সামনে নিয়ে হাজার হাজার লোকের কলেমায়ে শাহাদাত উচ্চস্বরে পড়তে পড়তে রাজপথ অতিক্রমের দৃশ্য ছিল অপূর্ব। দুপাশের জনতা তখন নির্বাক হয়ে মিছিলের দৃশ্য অবলোকন করে। বহুতল ভবনগুলো জানালা-করিডোর দিয়ে সুবিশাল অথচ সুশৃংখল মিছিলটি দেখে বিস্ময়বোধ করে। মিছিলটি প্রহর রোদের মধ্যে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট থেকে শুরু হয় মতিঝিল টিকাটুলী হাটখোলা হয়ে সায়েদাবাদ গিয়ে সমাপ্ত হয়। ইতঃপূর্বে কারো লাশ নিয়ে এত বিশাল ও দীর্ঘ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়নি। এরপর শিবির সভাপতি জনাব ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে গাড়িযোগে শহীদের লাশ মুনসীগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। পথিমধ্যে শিবির সভাপতি শহীদ সাইজুদ্দীনের লাশ নিয়ে প্রথমে তার গ্রামের বাড়ি যান। শহীদ দুলালে লাশ নিয়ে যান জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য মওলানা আব্দুল গাফফার। শহীদের লাশ স্ব স্ব গ্রামে পৌঁছলে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয।

একনজরে শহীদ মু. আতিকুল ইসলাম দুলাল
নাম : শহীদ আতিকুল ইসলাম দুলাল
পিতা : মরহুম মোহাম্মদ আলী মিয়া কোম্পানী
মাতা : মোছাম্মৎ হালিমা খাতুন
ঠিকানা : দক্ষিণ ইসলামপুর, সদর, মুন্সিগঞ্জ
জন্মতারিখ : ১৯৭১ সাল
ভাইবোন : ৬ ভাই ৬ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ২য়
শ্রেণী : ১০ম (মানবিক শাখা)
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : মুন্সিগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়
কততম শহীদ : ৪৮তম
শহীদ হওয়ার স্থান : শিল্প ব্যাংক ভবনের সামনে মতিঝিল
আঘাতের ধরন : ব্রাশ ফায়ারে বুক ও মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
যাদের হাতে : ঘাদানিক কমিটির সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের
শাহাদাতের তারিখ্ : ১৮ জুলাই ১৯৮২
সাংগঠনিক মান : কর্মী
যে শাখার শহীদ : ঢাকা মহানগরী পূর্ব

বৈশিষ্ট্য
তিনি প্রতিদিন আসরের নামাযের পর মায়ের অনুমতি নিয়ে দাওয়াতি কাজে বের হতেন। কেউ দাওয়াতি কাজ করার জন্য নিষেধ করলে তিনি বলতেন; ‘প্রয়োজনে শহীদ হয়ে যাবো’।

মায়ের প্রতিক্রিয়া
আমার সন্তানদের মাঝে ও সব কাজে আমার অনুমতি নিয়ে বের হত। বাড়ি বাড়ি দাওয়াতি কাজে বের হওয়ার সময়ও ও আমার কাছ থেকে অনুমতি নিতে ভুলতো না।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মু. আতিকুল ইসলাম (দুলাল)

পিতা

মোহাম্মদ আলী মিয়া কোম্পানী

মাতা

মোছাম্মৎ হালিমা খাতুন

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ৩১, ১৯৭১

ভাই বোন

৬ ভাই ৬ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

দক্ষিণ ইসলামপুর, সদর, মুন্সিগঞ্জ

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

১০ শ্রেনী, মুন্সিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

শিল্পব্যংক ভবনের সামনে, মতিঝিল