শহীদ ইকবাল হোসেন

০১ অক্টোবর ১৯৬৭ - ০২ জুন ১৯৯২ | ৪৩

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

ইসলামী আন্দোলনের তাজা প্রাণ শহীদ ইকবাল হোসেন তাদেরই একজন। ঠাঁকুরগাঁও-এর শিবিরকর্মী ইকবাল হোসেনের মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা প্রতিটি মানব বিবেককে দংশন না করে পারে না। ২ জুন ১৯৯২ সালের কালো রাতে নাস্তিক্যবাদের এদেশেীয় এজেন্ট ছাত্র ইউনিয়নের দুর্র্বৃত্তরা তাকে পেশাচিক কায়দায় হত্যা করে। ইকবালের হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের পর সুনির্দিষ্টভাবে মামলা হয়েছে। কিন্তু আজো বিচারের বাণী আর শহীদের আত্মীয় স্বজনের আত্মা কেঁদে বেড়াচ্ছে।

শহীদের পরিচয়
ঠাকুরগাঁও জেলা সদরের দেবীপুর ইউনিয়নের কুমারপুকুর গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে জন্মগ্রহন করেন শহীদ ইকবাল হোসেন। তার মায়ের নাম মোছাঃ ফরিদা খাতুন, বাবার নাম মুহাম্মদ তরিকুল ইসলাম। শহীদ ইকবালের ৬ বছর বয়সেই মা মারা যান। সেই থেকে শহীদ ইকবাল হোসেন তার ছোট চাচা মুহাম্মদ রেজাউল করিম চাচী মোসাম্মৎ মনোয়ারা বেগমের কাছেই লালিত পালিত হন। ৮ ছেলে ১ মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পিতা মাতার ২য় সন্তান। শহীদ ইকবাল হোসেনের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১২ জন। ছোট থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত ও বুদ্ধিমান স্বভাবের।

শিক্ষাজীবন
মুন্সির হাট মুজাবর্নী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শহীদ ইকবাল হোসেন তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন মুন্সির হাট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে তিনি বোদা পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি (মানবিক) প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তার পর স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করার জন্য দিনাজপুর থেকে নিজ জেলা ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে বি. এ ভর্তি হন। শাহাদাতের সময় তিনি বি. এ ২য় বর্ষ পরীক্ষা দিচ্ছিলেন।

সাংগঠনিক পরিচয়
শহীদ ইকবাল সর্বপ্রথম সংগঠনের দাওয়াত পান তার চাচাত ভাই এর কাছ থেকে। পরবর্তীতে তিনি এসএসসি পাস করার পরে দিনাজপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ায় সেই খানেই সংগঠনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হয় এবং পরবর্তীতে সংগঠনের কর্মী ও সাথী হন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৯২ সালে সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আলিম- ইকবাল পরিষদে জি. এস পদে নির্বাচন করে অল্প ভোটে হেরে যান। তিনি ছিলেন সদা হাস্য-উজ্জ্বল প্রাণচঞ্চল একজন মানুষ। তিনি কারো সাথে রাগ করতে পারেন এটা কেউ বিশ্বাসই করত না। তিনি স্বীয় গুণাবলীতে শত্রুকেও সহজে আপন করে নিতেন। শহীদের কোন শত্রু থাকতে পারে এটা কেউ মেনেই নিত না তার আচরণের কারণে। তিনি সর্বশেষ ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

শাহাদাতের ঘটনা
পহেলা জুন ১৯৯২ শহীদ ইকবালের বিএ ২য় বর্ষের ইংরেজি পরীক্ষা ছিল পরীক্ষা দেয়ার পর রাতে তার শহরস্থ বাসা থেকে তার অসুস্থ দাদীর জন্য ঔষধ নিয়ে আনুমানিক রাত ১০টায় শহরস্থ সরকার পাড়ার বাসা থেকে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে মোটরসাইকেল যোগে রওয়ানা দেন। (শহর থেকে তার বাড়ি ১২ কিঃ মিঃ দূরে) যাওয়ার পূর্বে শহীদের চাচা তাকে এত রাতে যেতে নিষেধ করলেও তিনি উত্তরে- বলেন আল্লাহ্ আমার সাথে আছেন। 

সেদিন শহীদ ইকবাল শহরের বাসা থেকে বের হওয়ার পর নাস্তিক্যবাদের এদেশীয় এজেন্ট ছাত্র ইউনিয়নের দুর্বৃত্তরা তাকে অনুসরণ করে। কিছুদূর গিয়ে কচুবাড়ি বোর্ড অফিসের নিকটে ঘাতকচক্র তার গাড়ির গতি রোধ করে। ইকবাল সরল বিশ্বাসে গাড়ি থামালে দুর্বৃত্তরা তার উপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুবৃত্তের চক্রের হামলায় তার শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। এরপর দুর্বৃত্তরা সেখানে উপর্যুপরি হামলার পর তার বাহু বাঁশের সাথে বেঁধে ফেলে। এই অসহায় অবস্থায় দুবৃত্তরা তার পরনের শার্ট ছিঁড়ে বাঁশের সাথে গলা জড়িয়ে ফাঁস দেয়। মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে করতে ইকবাল দুনিয়ার সমস্ত মায়া ছেড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দুর্বৃত্তরা ইকবালের যনন্ত্রাদায়ক প্রাণ সংহার করে স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। পরদিন এলাকার লোকজন ইকবালকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। এ ধরণের বর্বর হত্যাকাণ্ডের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। একজন শিক্ষক হয়ে সমাজ সেবক হয়ে মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখতেন শহীদ ইকবাল হোসেন। কিন্তু সেই আবু লাহাব, আবু জেহেলের উত্তরসূরিরা তার সেই স্বপ্নকে পূরণ করার সুযোগ দেয়নি। তাকে চলে যেতে হয়েছে ঠাকুরগাঁও এর আর এক শহীদ, আব্দুল হামিদের পথ ধরে জান্নাতের পথে।

শাহাদাতের ঘটনা
তার শাহাদাতের খবর আন্দোলনের সাথীদের কাছে পৌঁছলে সকলে তাদের প্রিয় ইকবাল ভাইকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে যায় তার শাহাদাতের স্থানে এবং গোটা শহর তার খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

জানাজা ও দাফন
২ জুন বাদ আসর শহীদ ইকবালের জানাজা সম্পন্ন হয় মুন্সির হাটে এবং তাকে তার নিজ পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

বিশেষ ঘটনা
শহীদ ইকবাল যেই রাতে শহীদ হন সেই রাতেই তার ছোট চাচা যিনি নাকি ছোট থেকেই ইকবালকে প্রচন্ড ভাল বাসতেন স্নেহ করতেন, তিনি রাতে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিক স্বপ্নে দেখতে পান মোটরসাইকেলের পেছন থেকে কে যেন ইকবালকে শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা করছে এবং তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে হত্যা করেছে এবং বাঁশের সাথে বেঁধে রেখেছে। সকালে হত্যার খবর পাওয়ার পর তার চাচা যখন ইকবালকে দেখতে যান ঠিক স্বপ্নে যে, অবস্থায় দেখেছিলেন ঠিক সেই অবস্থায় ইকবালকে তার চাচা দেখতে পেয়েছেন।

শহীদের চাচার প্রতিক্রিয়া
শহীদ ইকবাল ছিল আমাদের পরিবারের সবচাইতে উত্তম চরিত্রের মানুষ। তাকে শিবির করতে নিষেধ করলে সে বলত আমার কিছুই হবে না আল্লাহ আমার সাথে আছেন।

গ্রামবাসীর প্রতিক্রিয়া
ইকবাল বেঁচে থাকলে গ্রামটা আরও সুন্দর হতে পারতো, সে ছিল উত্তম চরিত্রের এক মূর্ত প্রতীক। গ্রামবাসী মনে করেন এই সমাজের প্রতিটি মানুষ ইকবালের মত হতে পারলে সমাজ থেকে সকল দুঃখ দুর্দশা বিদায় নেবে।

একনজরে শহীদ ইকবাল হোসেন
নাম : মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন
পিতার নাম : মো. তরিকুল আলম
মাতার নাম : মোছা. ফরিদা খাতুন
ভাইবোন : ৮ ভাই ১ বোন
ভাই বোনদের মধ্যে অবস্থান: দ্বিতীয়
পরিবারের সদস্য সংখ্যা: ১২ জন
জন্ম:- ১৯৬৭ সাল অক্টোবর মাস
স্থায়ী ঠিকানা: কুমারপুকুর, ডাক : খলিসা কুরি, উপজেলা: ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা: ঠাকুরগাঁও
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ
সর্বশেষ পড়াশোনা: বি, এ পরীক্ষার্থী
সাংগঠনিক মান: সাথী
শাহাদাতের সময় দায়িত্ব: সরকারি কলেজ সেক্রেটারি
পেশাগত টার্গেট: শিক্ষকতা
শহীদ হওয়ার স্থান : ঠাকুরগাঁও কচুবাড়ি বোর্ড অফিসের নিকটে বাঁশঝাড়ে 
আঘাতের ধরন: শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়।
যাদের আঘাতে শহীদ হন: ছাত্র ইউনিয়ন সন্ত্রাসী।

“জীবনের চেয়ে দীপ্ত মৃত্যু তখনই জানি
শহীদি রক্তে হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানি।”
-ফররুখ আহমদ

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ ইকবাল হোসেন

পিতা

মোঃ তরিকুল আলম

মাতা

মোছাম্মৎ ফরিদা খাতুন

জন্ম তারিখ

অক্টোবর ১, ১৯৬৭

ভাই বোন

৮ ভাই ১ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

কুমারপুকুর, খালিসাকুরি, ঠাকুরগাঁও সদর, ঠাকুরগাঁও

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

বি এ, ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ

শাহাদাতের স্থান

ঠাকুরগাঁও কচুবাড়ি বোর্ড অফিস