শহীদ জসিম উদ্দিন মাহমুদ

১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ - ১৭ মার্চ ১৯৮৯ | ২৮

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

আল্লাহর সৃষ্টি সুন্দর এই পৃথিবীতে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। আল্লাহর অনুগত বান্দারা সব সময় চেষ্টা করেছেন সত্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে। অন্যদিকে মিথ্যার ধ্বজাধারীরা সত্যের সমুজ্জ্বল শিখাকে মুখের ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী তাদের সেই কু-চেষ্টা সব সময়ই ব্যর্থ হয়েছে। সত্যকে তারা নেভাতে পারেনি বরং তারা নিজেরাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সত্যের আলো এখন দূর হতে দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। সে সত্য-মিথ্যার লড়াইয়ের এক বিজয়ী সৈনিক শহীদ জসিম উদ্দীন মাহমুদ।

জন্ম-পরিচয়
শহীদের পুরো নাম এ কে এম জসিম উদ্দীন। ১৯৭৩ সালের জুন মাসের প্রথম দিকের কোনো এক শুভক্ষণে পৃথিবীতে আলো ছড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। চট্টগ্রাম জেলার কোতয়ালি থানার মিয়াখান নগর তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। পিতা ডা. এম এ খালেক একজন বিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। মাতা নুরজাহান বেগম একজন আদর্শ মাতা। পিতা-মাতার সান্নিধ্যে ৪ ভাই আর এক বোনের সবার বড় জসিম উদ্দীন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন। দুরন্ত চঞ্চলতায় বাল্যকাল অতিবাহিত হলেও দায়িত্ববোধসম্পন্ন হয়ে ওঠেন পরবর্তীতে।

শিক্ষাজীবন
শহীদ জসিম উদ্দিনের শিক্ষার হাতে খড়ি হয় নিজ গ্রামে। এরপর এএএস সিটি করপোরেশন উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী জসিম উদ্দীন ছোটবেলা থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকলাপের বাইরেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ইসলামী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ জসিম ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকতেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। এসএসসি পাস করার পর বাণিজ্য বিভাগে পড়ার মানসিকতা নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে ভর্তি হন। অত্যন্ত বিনয়ী স্বভাবের ছাত্র হিসেবে তিনি অল্প সময়েই জয় করে নেন ছাত্র-ছাত্রীসহ শিক্ষকদের মন। শাহাদাতের পূর্বে তিনি সাময়িক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। শাহাদাতের পর ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা যায় তিনি মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছেন। শাহাদাতকালে জসিম উদ্দীন মাহমুদ প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

শাহাদাত
ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিরলস কর্মী হিসেবে ধীরে ধীরে কলেজ প্রাঙ্গণে পরিচিতি লাভ করেন শহীদ। কিন্তু মানুষের শত্রু; ইসলামে শত্রুরা শহীদের এই জনপ্রিয়তা মেনে নিতে পারেনি। ১৯৮৯ সালের ২৭ মার্চ আসে সেই ভয়াল দিনটি। সরকারি কমার্স কলেজ শুধু বাংলাদেশ নয় উপমহাদেশের একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাঙ্গন। সুতরাং এ শিক্ষাঙ্গনে যারা পড়তে আসে তারাও মেধায় উত্তীর্ণ, তারা নিজেদের বিবেকের রায়ে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকেই তাদের নিজেদের সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু সত্যের দুশমন সেক্যুলার ছাত্রলীগের কাছে তা অসহনীয় ঠেকে। ফলে তারা নিরীহ ছাত্রদের ওপর বারবার আক্রমণ করতে থাকে। কিন্তু ছাত্রসমাজের প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে যায়।

তবে শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশ নস্যাতের জন্য তারা আরো প্রস্তুতি নিতে থাকে। এমনই এক পরিস্থিতিতে কলেজ প্রশাসন ছাত্র-সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করেন। ৩ এপ্রিল ১৯৮৯-এর নির্বাচনকে সামনে রেখে ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের নিজ নিজ প্রচারণায় কলেজ ক্যাম্পাস মুখরিত করে তুলেছিল। কিন্তু সত্যের বিরোধী এই সংগঠনটি তখনও নিজেদের প্যানেল ঠিক করতে পারেনি। ২৭ মার্চ ছিল প্যানেল জমা দেয়ার শেষ সময়। তাই তারা মরিয়া হয়ে ওঠে নির্বাচন বানচালের জন্য। কিন্তু ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রদের পক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনকে চাপ দিতে থাকে।

অবশেষে এল ২৭ মার্চ। সকাল থেকেই সাধারণ ছাত্রসহ ছাত্রশিবিরের কর্মীরা কলেজ ক্যাম্পাসে ভিড় জমাতে থাকে। সকাল ১০:৩০ মিনিটে ছাত্রশিবিরকে টার্গেট করে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু সন্ত্রাসী উসকানিমূলক শ্লোগান দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা শিবিরকর্মীদের ওপর হামলার জন্য উদ্যত হলে সম্মানিত শিক্ষকদের হস্তক্ষেপে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে অসংখ্য বহিরাগতসহ এসএমজি, কাটারাইফেল, বন্দুক, রিভলবারের মতো মারাত্মক সব আগ্নেয়াস্ত্রসহ বোমাবাজি করতে করতে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। শিবিরকর্মীদের ওপর অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে তারা।

তাদের আকস্মিক হামলায় শিবিরকর্মী ও সাধারণ ছাত্ররা হকচকিত হয়ে দিগ্বিদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলে গুলিবর্ষণের ঘটনা। শিবিরের ভিপি প্রার্থীসহ ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হন। ঘাতকের একটি বুলেট এসে শিবিরকর্মী জসিম উদ্দীন মাহমুদের বুক ভেদ করে যায়। বুলেটের আঘাত লাগে মাথায়ও। কালেমায়ে শাহাদাত ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়তে পড়তে দ্বীনের এই মুজাহিদ মাটিতে পড়ে যান। তাঁর ভেজা রক্তে রক্তিম হয়ে যায় ক্যাম্পাসের সবুজ মাঠ। হাসপাতালে নেয়ার পথে জসিম উদ্দীন মাহমুদ শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন।

দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই বর্বরোচিত হামলা চললেও পুলিশ ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার। পুলিশের সামনেই অস্ত্র উঁচিয়ে দুষ্কৃতকারীরা কলেজ আঙিনায় প্রবেশ করে। হত্যার পর পুলিশের সামনেই গাড়ি হাঁকিয়ে দুর্বৃত্তরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। ২৮ মার্চ শহীদ জসিম উদ্দীন মাহমুদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় লালদিঘী ময়দানে। এরপর চাকতাই তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।

শহীদ হওয়ার পূর্বের স্মরণীয় বাণী
“ইসলামী জাগরণের জন্য সর্বদা কাজ করে যাব।”

পিতার প্রত্যাশা
‘শহীদের অপূর্ণাঙ্গ লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে সবাইকে আরো বেশি আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। গণমাধ্যমের মাধ্যমে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরে শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজকে গতিশীল করতে হবে।’

একনজরে শহীদ জসিম উদ্দীন মাহমুদ
পূর্ণ নাম : এ কে এম জসিম উদ্দীন মাহমুদ
মায়ের নাম : নূরজাহান বেগম
বাবার নাম : ডা. মুহাম্মদ আব্দুল খালেক
জন্মতরিখ : ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
পরিবারের মোট সদস্য : ৬ জন, ৩ ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়
স্থায়ী ঠিকানা : হাফিজিয়া লেন, মিয়াখান নগর, বাকলিয়া, চট্টগ্রাম
সাংগঠনিক মান : কর্মী
সর্বশেষ পড়াশোনা : এইচএসসি
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ
জীবনের লক্ষ্য : সমাজসেবক হওয়া
আহত হওয়ার স্থান : কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম
আঘাতের ধরন : ব্রাশফায়ার
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রলীগ
শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ
শাহাদাতের তারিখ : ২৭ মার্চ, ১৯৮৯

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ জসিম উদ্দিন মাহমুদ

পিতা

ডাঃ মুহাম্মদ আবদুল খালেক

মাতা

নূরজাহান বেগম

জন্ম তারিখ

সেপ্টেম্বর ১৫, ১৯৭১

ভাই বোন

৩ ভাই ১ বোনের মধ্যে সবার বড়

স্থায়ী ঠিকানা

হাফিজিয়া লেন, মিয়াখান নগর, বাকলিয়া, চট্টগ্রাম

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

এইচ এস সি

শাহাদাতের স্থান

চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ