শহীদ আব্দুল আজিজ

২৫ মার্চ ১৯৬৮ - ০২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ | ১৯

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

মানুষের মুক্তি আর অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে সমাজে আল্লাহর দ্বীনের কাজ আনজাম দিতে গিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এ যাবৎ অসংখ্য মানুষ নিজেদের জান কুরবান করেছেন, শহীদ আব্দুল আজিজ তাঁদের একজন। এ মহান মানুষটি বাংলাদেশে কুরআন ও হাদিসের পতাকাকে সমুন্নত করতে নিজের জান বিলিয়ে দিয়েছেন অকুণ্ঠভাবে, ইসলামী আন্দোলনের ভাইদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন।

ব্যক্তিগত পরিচয়
বাংলাদেশের চৌদ্দ কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ১৯তম শহীদ হলেন শহীদ আব্দুল আজিজ। তিনি নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার সাতজান গ্রামে ২৫ মার্চ, ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শহীদ আব্দুল আজিজ মা-বাবার বড় সন্তান। ৫ ভাই ও ১ বোন তাঁরা। বাবার নাম মোহাম্মদ মোবারক আলী।

শিক্ষাজীবন
নীলফামারী জেলার জলঢাকার গোলমুন্ডা দ্বি-মুখী উচ্চবিদ্যালয়ে মাধ্যমিক স্তরে লেখাপড়া করেন শহীদ আব্দুল আজিজ। তিনি এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ১৯৮৩ সালে এবং দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে রংপুর সরকারি বাণিজ্য ইনস্টিটিউট হতে প্রথম বিভাগে ডিপ্লোমা ইন-কমার্স-এ উত্তীর্ণ হন ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৬ সালে তিনি রংপুর কারমাইকেল সরকারি মহাবিদ্যালয়ে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। শাহাদাতের সময় সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

সাংগঠনিক জীবন
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথে শহীদের পরিচয় ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে। তিনি ১৯৮০ সালে সমর্থক হন। তখন থেকেই তিনি ইসলামকে সবুজ-শ্যামল এই বাংলার জমিনে প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি শুধু সমর্থক হয়েই বসে থাকেননি, নিজের মান উন্নয়নের পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনকে আরো গতিশীল করার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯৮১ সালে সংগঠনের কর্মী হন এবং ১৯৮৩ সালে সাথী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সাথী হওয়ার পরপরই ইসলামী ছাত্রশিবিরের সর্বোচ্চ সম্মানজনক স্তর ‘সদস্য’ হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৮৫ সালের ১৩ মে সংগঠনের সদস্য স্তরে উন্নীতও হন। শাহাদাতবরণের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি রংপুর শহর শাখার স্কুল বিভাগের উত্তর অঞ্চলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

শাহাদাত
শহীদ বলতেন, ‘রংপুরে ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ যেন আমি হই।’ আল্লাহ তাঁর এ আন্তরিকতাপূর্ণ দোয়া কবুল করেছেন। সত্যি সত্যি তিনি রংপুরে ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলেন, হাসিমুখে চলে গেলেন আল্লাহর কাছে, পেছনে ফেলে গেলেন চিন্তা-তৎপরতা-ত্যাগের স্মৃতিময় দিনগুলো। শাহাদাতকালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য এবং রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের নির্বাচিত মিলনায়তন সম্পাদক ছিলেন তিনি।

২৫ আগস্ট, ১৯৮৭; রংপুর কারমাইকেল কলেজ, ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ শান্ত-স্বাভাবিক। সকাল ১১টার দিকে আব্দুল আজিজসহ ছাত্র-সংসদের নেতৃবৃন্দ বাজেট অধিবেশন, মেডিক্যাল সেন্টার, কলেজ গেট নির্মাণ ও অন্যান্য ছাত্রসমস্যা নিয়ে কলেজ অধ্যক্ষের অফিস কক্ষে আলোচনারত ছিলেন। এ সময় বামপন্থী দাবিদার ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসীরা কোনো কারণ ছাড়াই অফিসের বাইরে হৈ-চৈ শুরু করে দেয়। কলেজ অধ্যক্ষ মিটিং স্থগিত করে বাইরে এসে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তারা শহীদ মিনারের দিকে চলে যায় এবং সলাপরামর্শ করে একটি মিছিল বের করে। নানা ধরনের সন্ত্রাসমূলক স্লোগান দিয়ে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু শিবিরকর্মীরা এ ধরনের উস্কানির মুখেও চরম ধৈর্য ধারণ করেন। এরই মাঝে জোহরের নামাজের আজান হয়ে গেলে শিবিরকর্মীরা মসজিদের দিকে অগ্রসর হন। মসজিদে যাবার সময় তাজুল, সবুর, মোশাররফ, জাহাঙ্গীর, জিন্নার নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা রামদা, হকিস্টিক, লাঠি নিয়ে পেছন থেকে আক্রমণ চালায়। খুনিরা আব্দুল আজিজকে কিরিচ, রামদা এবং চাবুকের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে পালিয়ে যায়।

আহত আজিজকে তাঁর বন্ধুরা রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালের শয্যায় কাটে যন্ত্রণাময় আটটি দিন। ২ সেপ্টেম্বর ভোররাত ৩টা ৪৫ মিনিটে অসুখ-শয্যায় পড়ে রইলো শুধু আব্দুল আজিজের দেহখানি, আব্দুল আজিজ পাড়ি জমালেন পরম বন্ধুর সান্নিধ্যে।

তিনি শপথ গ্রহণ করেছিলেন, “নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবকিছুই সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য।” আর তার বাস্তবায়ন করেও গেলেন তিনি।

পরিবারের প্রতিক্রিয়া
আব্দুল আজিজের শাহাদাতের খবর যখন ছড়িয়ে পড়ল ডিমলা উপজেলার সাতজান গ্রামে, তখন দরিদ্র কৃষক বাবা আর অসহায় মা প্রিয় সন্তান বিয়োগের বেদনায় একবারে মুষড়ে পড়লেন। বাবা-মায়ের কত স্বপ্ন ছিল আবদুল আজিজ এমএ পাস করে বড় চাকরি করবেন এবং তাদের দরিদ্র পরিবারে সুখ নেমে আসবে। তাদের সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। আব্দুল আজিজের ছোট ছোট ভাই-বোনদের অসহায় মুখ দেখে হতাশা, যন্ত্রণা ও কান্নায় ভেঙে গেল বাবা-মায়ের স্নেহাতুর বুক।

সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
প্রিয় ছাত্র বিয়োগের বেদনায় হতবাক হয়ে গেলেন কলেজের সম্মানিত অধ্যক্ষ ও শিক্ষকগণ। ডুকরে কেঁদে উঠল আবদুল আজিজের সহপাঠীরা, দলে দলে আসতে লাগল শত শত স্কুলছাত্র- আব্দুল আজিজ যাদেরকে দ্বীনের পথে ডাকতেন। ছুটে আসতে লাগল জুম্মাপাড়ার (যেখানে শহীদ আজিজ লজিং থাকতেন) সর্বস্তরের জনগণ। তারা সবাই ছুটে আসছিল এক নজরে তাদের প্রিয় আজিজ ভাইকে দেখার জন্য। তারা হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাল।

ইসলামের সুমহান আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য যেসব ত্যাগী ব্যক্তিত্ব নিজেদের মূল্যবান জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের মাঝে শহীদ আব্দুল আজিজের নাম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামী সংগঠনের ত্যাগী কর্মীরা শহীদের সহজ-সরল জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

একনজরে শহীদ আব্দুল আজিজ
নাম : মো: আব্দুল আজিজ
মায়ের নাম : মোছাম্মাৎ আছমা খাতুন
বাবার নাম : মো: মোবারক আলী
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- সাতজান, ডাকঘর- কাকরাবাজার, থানা- ডিমলা, জেলা- নীলফামারী
পরিবারের মোট সদস্য : ৯ জন
ভাই-বোনের সংখ্যা : ৭ ভাই, ১ বোন
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান : সবার বড়
জন্মতারিখ : ২৫ মার্চ, ১৯৬৮
সাংগঠনিক মান : সদস্য
সর্বশেষ দায়িত্ব : রংপুর শহর শাখার স্কুল বিভাগের উত্তর জোনের সভাপতি
আহত হওয়ার স্থান : রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মসজিদ প্রাঙ্গণ
আঘাতের ধরন : রামদা, হকিস্টিক, লাঠি
যাদের আঘাতে শহীদ : তাজুল, সবুর, মোশাররফ, জাহাঙ্গীর, জিন্নার নেতৃত্বে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসী বাহিনী
শাহাদাতের তারিখ ও সময় : ২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ , ভোর ৩টা ৪৫ মিনিট
শাহাদাতের স্থান : রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
সর্বশেষ পড়াশোনা : রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
বিষয় ও বর্ষ : হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ (সম্মান ১ম বর্ষ, পুরাতন)
সমর্থক ও কর্মী হওয়ার সময় : ১৯৮০, ১৯৮১ সাল
সাথী হওয়ার সময় : ১৯৮৩ সাল
সদস্য হওয়ার তারিখ : ১৯৮৫ সালের ১৩ মে

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আব্দুল আজিজ

পিতা

মোহাম্মদ মোবারক আলী

মাতা

মোছাম্মৎ আসমা খাতুন

জন্ম তারিখ

মার্চ ২৫, ১৯৬৮

ভাই বোন

৮ ভাই ১ বোনের মধ্যে সবার বড়

স্থায়ী ঠিকানা

সাতজান, কাকরাবাজার, ডিমলা, নীলফামারী

সাংগঠনিক মান

সদস্য

সর্বশেষ পড়ালেখা

হিসাব বিজ্ঞান ১ম বর্ষ, রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

শাহাদাতের স্থান

কারমাইকেল কলেজ মসজিদ প্রাঙ্গনে আহত হয়েছেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহদাত বরণ করেন


শহীদ আব্দুল আজিজ

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল আজিজ


শহীদ আব্দুল আজিজ

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল আজিজ