শহীদ বাকীউল্লাহ

১২ জুন ১৯৬৫ - ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ | ১৫

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

“মা আমার জন্য কাঁদবেন না, ইচ্ছা করলেই তো শহীদ হওয়া যায় না, আর আমি যদি ইসলামের জন্য শহীদ হই তাহলে দেখবেন হাজার হাজার ইসলামী আন্দোলনের কর্মী আমার লাশ নিয়ে আপনার কাছে আসবে। আপনি শহীদের মা হবেন, এতো আপনার জন্য গৌরবের বিষয়। এক বাকীকে হারিয়ে আপনি হাজার হাজার বাকীকে আপনার সন্তান হিসেবে পাবেন।” আল্লাহর প্রিয় বান্দা শহীদ বাকীউল্লাহ শাহাদাতের মাত্র একদিন আগে বাড়ি থেকে আসার সময় তাঁর মায়ের সাথে শেষ কথা হিসেবে এ কথাগুলোই বলেছিলেন। আর আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দার এ কথাগুলোকে কবুলও করে নিয়েছিলেন।

পড়ালেখা ও সাংগঠনিক দায়িত্ব
১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। শহীদ বাকীউল্লাহ তখন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শক্তি কৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ১ম পর্বের ছাত্র। থাকতেন নজরুল ছাত্রাবাসে। আল্লাহর পথে নিষ্ঠাবান ও কঠোর পরিশ্রমী ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী বাকীউল্লাহ তখন ঐ ছাত্রাবাসের প্রচার সম্পাদক এবং মসজিদ কমিটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছিলেন।

শহীদের দায়িত্বানুভূতি
ক’দিন পর কলেজ খুলবে। প্রথম বর্ষের নতুন ছাত্ররা আসছে। সবার আগে নতুনদের মাঝে দাওয়াতি কাজ করতে হবে। এজন্য সাংগঠনিক ছুটি পেরোতে না পেরোতেই ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছিলেন শহীদ। তিনি সব সময় সংগঠনের প্রয়োজনে সঠিক সময়েই ময়দানে হাজির হতেন। দুই-একটি শিক্ষাশিবিরের খাদ্য বিভাগের ব্যবস্থাপনার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন; যেখানে তিনি যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।

ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে সম্পর্ক
কলেজের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী সবার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল সম্মান আর মর্যাদার।

মিতব্যয়িতা
বাড়ির অবস্থা সচ্ছল থাকার পরও প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা খরচ করতেন না। বাড়ি থেকে পাঠানো টাকা বাঁচিয়ে তিনি ইসলামী ব্যাংকে জমা করেছিলেন। এ টাকার জাকাত দিতে হবে কি না তিনি আব্বার কাছে একবার জানতে চেয়েছিলেন।

শাহাদাত
জাফর জাহাঙ্গীর ও বাকীউল্লাহকে লক্ষ্য করে স্টেনগান থেকে অনবরত গুলি ছোঁড়ে সন্ত্রাসীরা। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় জাফর জাহাঙ্গীর ও বাকীউল্লাহর সতেজ দেহ। তাঁদের রক্তের স্রোতে তিনতলার মেঝে ভেসে যায়। তখন সমস্ত এলাকা জুড়ে নেমে আসে আতঙ্ক ও নীরবতা। টগবগে দুই তরুণের জীবন প্রদীপ ঘটনাস্থলেই নিভে যায়। মহান আল্লাহর দরবারে তাঁরা হাজির হন শাহাদাতের মর্যাদা নিয়ে। দুর্বৃত্তরা খুনের উন্মাদনা চরিতার্থ করার পর অস্ত্র উঁচিয়ে পালিয়ে যায়। বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে দুই শিবির নেতার শাহাদাতের খবর। শিবিরকর্মীরা তাদের সতীর্থদের হারানোর ব্যথায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এক ঘণ্টার বেশি সময় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চললেও পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।

জানাজা আদায় করতে পারল না শহীদের সঙ্গীরা
ঘটনাস্থলেই গুমোট নিস্তব্ধতা নেমে এলে পুলিশ এসে দুই বীর শহীদের লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তৎকালীন জালেম সরকার তাঁদের লাশ কাউকে দেখার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। শহীদের সাথীরা তাদের প্রিয় ভাইকে সামনে নিয়ে জানাজা আদায় করতে পারেননি। বরিশালের মুলাদীতে শহীদ বাকীউল্লাহর লাশ পিতার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ব্রাশফায়ার আর গুলির আঘাতে শহীদের লাশ চেনা যাচ্ছিল না। লাশ বিকৃত হওয়ায় কেউ দেখতে পারেনি।

প্রতিবাদের ঝড়
এই নিষ্ঠুর জোড়া খুনের পর দেশব্যাপী নেমে আসে শোকের কালোছায়া। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শহীদের অনুগামীরা নেমে আসেন রাজপথে। ১৫ তারিখ রাজধানীতে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বিনা উসকানিতে কাঁদুনে গ্যাস শেল ফাটায় ও ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। জালেমের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের লাঠির আঘাতে শিবিরের তৎকালীন অফিস সম্পাদক (পরে কেন্দ্রীয় সভাপতি) আমিনুল ইসলাম মুকুল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলামসহ অনেকে আহত হন। বৃহত্তর চট্টগ্রামে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে। কক্সবাজারে হরতাল পালনের সময় পুলিশ বিনা উসকানিতে শিবিরের মিছিলের ওপর চড়াও হলে সংঘর্ষে অনেকে আহত হয়। পুলিশ মিছিলের ওপর ১৫ রাউন্ড গুলি ও অন্তত একশ’ টিয়ার গ্যাস শেল নিক্ষেপ করে। শামসুল আলম (১৮) ও জসীম উদ্দিন (২৪) মাথায় গুলিবিদ্ধ হন।

শাহাদাতের পর পিতার বক্তব্য
শাহাদাত বরণ করার পর শহীদের বন্ধুদের উদ্দেশে তাঁর পিতার বক্তব্য, “বাবা বাকী আমাদের খুব আদরের ধন ছিল, সে আমার আদর্শ সন্তান ছিল। যাক আজ বাকীর শাহাদাতের কারণে আল্লাহ তোমাদের সাথে আমার পরিচয়ের সুযোগ দিলেন। বাকী তো শহীদ হয়েছে, তোমরাই আমার বাকী। দোয়া করি তোমরা যাতে জাফর-বাকীর রেখে যাওয়া আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পারো।”

শহীদ হওয়ার পূর্বে স্মরণীয় বাণী
শহীদ বাকীউল্লাহ শাহাদাতবরণের পূর্বদিন বাড়ি থেকে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান। তিনি নিজ হাতে কবরস্থানে একটা আমের ডাল পুঁতেছিলেন। অলৌকিকভাবে সেটা থেকে একটি আমগাছ হয়ে যায়। শাহাদাতের আগের দিন বাড়ি থেকে যাবার সময় চাচাতো ভাই আমির হোসেনকে বলেছিলেন, “ভাই আমি যদি কোনোদিন মারা যাই তবে আমাকে এ অলৌকিক আমগাছের নিচে মাটি দিও।” তাঁকে আমগাছটির নিচেই মাটি দেয়া হয়।

শাহাদাতের আগের দিন বর্তমান জামায়াতের উপজেলা আমীর কাসির আহমেদ লঞ্চে চাঁদপুর পর্যন্ত তাঁর সহযাত্রী ছিলেন। সে সময় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রশিবিরের প্রচুর নেতাকর্মী আহত হচ্ছিলেন। এ বিষয়ে শহীদ বাকী ভাই বলেন, “একটি বড় বিল্ডিংয়ের জন্য একটি মজবুত ফাউন্ডেশন লাগে। আর ফাউন্ডেশন তৈরি করতে শক্ত ইটও লাগে, আধলা ইটও লাগে। তেমনি এখন যাঁরা আহত হচ্ছেন, শহীদ হচ্ছেন তাঁরা মূলত সংগঠনের জন্য একটি মজবুত ফাউন্ডেশন তৈরি করছেন। কাসির আহমেদ আরো বলেন, ‘শহীদ বাকী ভাইয়ের নামাজের মধ্যে যে খুশু-খুজু, যে একাগ্রতা ছিল তা আমাকে মুগ্ধ করেছিল।’

শহীদের চিঠি
শহীদ হওয়ার আগে তাঁর ফুফাতো ভাইকে দেয়া চিঠিতে লিখেছিলেন, “কয়েকদিন আগে বাতিলের বোমার আঘাতে আমাদের এক ভাইয়ের পা জখম হয়েছে। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর কারণে আমরা কিছু করতে পারিনি। ময়দান খুবই উত্তপ্ত, দোয়া করবেন যাতে আল্লাহ আমাদের প্রতি রহম করেন।”

শহীদের কথা
শহীদ মাহফুজুল হক চৌধুরীর কফিন কাঁধে নিয়ে শহীদ বাকীউল্লাহ বলেছিলেন, “আল্লাহ! চট্টগ্রামে আরো শহীদের প্রয়োজন হলে আমাকে পরবর্তী শহীদ হিসেবে কবুল কর।”

শহীদের মায়ের বক্তব্য
শহীদ বাকীউল্লাহর শাহাদাতের পর তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশে শহীদের বৃদ্ধা মা বলেছিলেন, “বাবা তোমরা আমার বাকু, তোমরা মাঝে মাঝে আমাকে চিঠি দিও, তা হলে আমি মনে করব আমার বাকু চট্টগ্রাম থেকে আমার কাছে চিঠি দিয়েছে। আমি এক বাকীকে হারিয়ে তোমাদের মতো হাজার হাজার বাকীকে আমার সন্তান হিসেবে পেয়েছি। জাফর-বাকীর শাহাদাতের বিনিময়ে আল্লাহ যেন এই দেশে ইসলাম কায়েম করে দেন এই দোয়া করি।”

একনজরে শহীদ বাকীউল্লাহ
পূর্ণ নাম : মোহাম্মদ বাকীউল্লাহ
বাবার নাম : গোলাম রহমান হাওলাদার
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- রঙ্গা, ডাকঘর- কাওরিয়া বন্দর, থানা- হিজলা, জেলা- বরিশাল
জন্ম তারিখ : ১৯৬৫ সালের ১২ জুন
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান : ৫ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে ৪র্থ
পড়াশোনা : শক্তিকৌশল বিভাগের ৩য় বর্ষ ১ম পর্ব
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
সাংগঠনিক মান : কর্মী
দায়িত্ব : নজরুল হলের প্রচার সম্পাদক, ছাত্রাবাস মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি
শাহাদাতের তারিখ : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬
শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ১ নং হোস্টেলের তিনতলায়
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রসমাজ নামধারী গুণ্ডাদের হাতে
আঘাতের ধরন : গুলি

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ বাকীউল্লাহ

পিতা

গোলাম রহমান হাওলাদার

জন্ম তারিখ

জুন ১২, ১৯৬৫

ভাই বোন

৫ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে ৪র্থ

স্থায়ী ঠিকানা

রঙ্গা, কাওরিয়া বন্দর, হিজলা, বরিশাল।

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট

শাহাদাতের স্থান

চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট


শহীদ বাকীউল্লাহ

ছবি অ্যালবাম: শহীদ বাকীউল্লাহ


শহীদ বাকীউল্লাহ

ছবি অ্যালবাম: শহীদ বাকীউল্লাহ