শহীদ আব্দুল হামিদ

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ১১ মার্চ ১৯৮২ | ২

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের ইতিহাস পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে। শাশ্বত সত্য ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য আল্লাহর একান্ত প্রিয় নির্ভীক সিপাহসালারগণ যুগ যুগ ধরে সদা-সর্বদা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। অপরদিকে মিথ্যার ধারক-বাহক বলে পরিচিত যারা, সত্য যাদের অন্তরে তীরের ন্যায় বিঁধে, তারা সব সময়ই এই শাশ্বত সত্যের টুঁটি চেপে ধরে রাখতে চেয়েছে। নিভিয়ে দিতে চেয়েছে আল্লাহর দ্বীনের উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণ।


সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায় রাসূলের (সা) যুগে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস অনন্য। সেই ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় একদিকে যেমন উত্তাল সাগরের মতো প্রতিবন্ধকতার অন্যদিকে নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং বঞ্চিত মানুষের পক্ষ থেকে অনন্য প্রতিরোধের। এই ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল হযরত সুমাইয়া (রা)-এর শাহাদাতের মাধ্যমে। পরবর্তীতে কালের সন্ধিক্ষণে যুগ থেকে যুগান্তরে মহান রাব্বুল আলামিনের অগুনতি অকুতোভয় সৈনিক শাহাদাতের রক্তপিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের ধারাকে গৌরবোজ্জ্বল করে রেখেছেন। শহীদ আব্দুল হামিদ ছিলেন পরম করুণাময়ের এমন এক অকুতোভয় সৈনিক, যিনি শাহাদাতের স্বর্ণসিঁড়ি বেয়ে জান্নাতের ফুল হয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের বাগিচায় ফুটে রয়েছেন। আমরা জানি বাগানের মালিক তার প্রয়োজনে বাগান থেকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ফুলটি পছন্দ করে তুলে নেন। মহান আল্লাহও তাঁর দুনিয়ার বাগানের মধ্য থেকে তাঁর পছন্দমত শ্রেষ্ঠ ফুল হিসেবে শহীদ আব্দুল হামিদ ভাইকে উঠিয়ে নিয়েছেন। 

একজন আব্দুল হামিদের বেড়ে ওঠা
ঠাকুরগাঁও জেলা সদরের সৈয়দপুর নামক নিভৃত পল্লীতে জন্ম হয়েছিলো শহীদ আব্দুল হামিদের। পিতা নাসির উদ্দিন আর মাতা হামিদা বেগমের একান্ত স্নেহ ভালোবাসায় গড়ে উঠছিলেন ধীরে ধীরে। পরিবারে সাত ভাই-বোনের মাঝে তাঁর অবস্থান ছিল সবার বড়। তাই শহীদ আব্দুল হামিদকে নিয়ে পিতা-মাতার চোখে-মুখে ছিল একরাশ সোনালি স্বপ্ন।

বাবা-মায়ের সেই স্বপ্নসাধ বুকে নিয়েই পাঠশালায় পাড়ি জমিয়েছিলেন শহীদ আব্দুল হামিদ। লেখাপড়া শিখবে, চাকরি করবে, বড় হয়ে পিতা-মাতার মুখে হাসি ফোটাবে এমন একটি আশার ভেলায় চড়ে সামনের পানে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন কিশোর আব্দুল হামিদ। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও সে আশায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি তাঁর। সীমাহীন প্রতিকূলতার মাঝেও স্বপ্নের তরী বেয়ে এলাকার দানারহাট মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং জয়পুর আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে আলিম, ফাজিল ও কামিল পাস করেন। একই সাথে তিনি জয়পুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাসও করেন। তাঁর জ্ঞান আহরণের অদম্যস্পৃহা এখানেই থেমে থাকেনি। তাই উচ্চশিক্ষার জগতে পাড়ি জমাতে আসেন রাজশাহীতে। শুরু হয় নতুন জীবনের এক নব অধ্যায়ের। ভর্তি হলেন রাজশাহী সরকারি কলেজের আরবি বিভাগে।

বন্ধুর পথের যাত্রী হলেন আব্দুল হামিদ
পূর্ব থেকেই ইসলামী আন্দোলনের প্রতি শহীদ আব্দুল হামিদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা ছিল সীমাহীন। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নিতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংগ্রামী কাফেলায় নিজেকে শরিক করেন। তিনি জানতেন এ পথে রয়েছে চরম প্রতিবন্ধকতা। রয়েছে কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ। তবুও “ইসলামী আন্দোলন ঈমানের অপরিহার্য দাবি” ঈমানের এ দাবিকে মেটাতে সব কিছু কুরবানি করার মানসিকতা নিয়েই এগিয়ে এসেছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিপ্লবী কাফেলায়। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ভোগ-বিলাসের মায়া-মমতা জড়ানো এ পৃথিবীর চোরাবালিতে না ডুবে মহান রাব্বুল আলামিনের রাস্তায় নিজের জীবন কুরবানি করার মধ্যেই রয়েছে সবচেয়ে বড় সফলতা। আর সে জন্যই রাব্বুল আলামিন তাঁর এ অব্যক্ত আকুতি কবুল করে নিয়ে তাঁকে জান্নাতের বাগানে স্থান করে দিয়েছেন।


অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিবেশীর সেবায় আব্দুল হামিদ
শহীদ আব্দুল হামিদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন এক প্রতিবাদীকণ্ঠ। এলাকার কোনো মানুষকে কোনো অন্যায় করতে দেখলে বলিষ্ঠকণ্ঠে প্রতিবাদ করতেন এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকার পরমার্শ দিতেন। চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে তিনি তাঁর জীবন সাজিয়েছিলেন এক অনন্য আদর্শ হিসেবে। প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে শহীদ আব্দুল হামিদ ছিলেন সর্বদা সচেতন। সেজন্য প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা গরিব ছিল তাদেরকে সামর্থ্যানুযায়ী টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। রোগ-শোক, বিপদাপদে সবসময় খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করতেন এবং রোগীদের চিকিৎসার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কার্পণ্য করতেন না।

ইসলামী আদর্শের উজ্জ্বল প্রতীক শহীদ আব্দুল হামিদ
শহীদ আব্দুল হামিদ ইসলামী আদর্শের উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে তাঁর প্রাত্যহিক আচরণ, চালচলন, কথাবার্তায় ইসলামের সুমহান শান্তির অকপট দীপ্তিতে ভাস্বর ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই শহীদ আব্দুল হামিদ মহান প্রভুর কাছে সঁপে দিয়েছিলেন নিজেকে। ইসলামী অনুশাসনের প্রতি প্রবল ঝোঁক ও আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়েছে শৈশব থেকেই। আদর্শ মুমিনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি হিসাবে পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালেই নিয়মিত নামাজ পড়তেন। শুধু তাই নয়, বাড়ির সবাইকে এবং পাড়া-প্রতিবেশী ও সহপাঠীদের সবাইকে নামাজ পড়ার জন্য আহ্বান জানাতেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর চোখে-মুখে ছিল ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সোনালি স্বপ্ন। সে জন্য ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় তিনি বক্তব্য রাখতেন।


ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণকর্মী শহীদ আব্দুল হামিদ ইসলামের জন্য কাজ করে সবসময় মানসিক প্রশান্তি লাভ করতেন। কৈশোরেই তিনি ইসলামী জলসার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা সংগ্রহ করতেন। গ্রামের মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য গ্রামে ইবতেদায়ি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখনও সে মাদ্রাসা আছে। মাদ্রাসার নাম সৈয়দপুর শহীদিয়া মাদ্রাসা। তাঁর স্মৃতিতে সৈয়দপুরে একটি শহীদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শহীদ আব্দুল হামিদ স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে তাঁর জীবন ছিল সামগ্রিকভাবেই প্রশ্নহীন। স্বাভাবিক চাহিদা হিসেবে যখন যা জুটতো তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন, এক্ষেত্রে কখনো বাড়াবাড়ি করেননি। তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবন পছন্দ করতেন।

উন্নত ও মননশীল রুচিবোধসম্পন্ন্ ব্যক্তি হিসেবে জীবনকে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে চলাফেরা করার চেষ্টা করতেন। তিনি তাঁর কক্ষকে এবং পড়ার টেবিল সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতেন। বাড়িতে তিনি ফল-ফুলের গাছ লাগিয়ে বাড়ির সৌন্দর্য রক্ষার চেষ্টা করতেন। এ ব্যাপারে পাড়া-প্রতিবেশীকেও উদ্বুদ্ধ করতেন। আল্লাহর একান্ত বান্দা হিসেবে শহীদ আব্দুল হামিদ ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই তাঁর চরিত্রকে উন্নত ও মাধুর্যপূর্ণ করে তুলেছিলেন। পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি সব সময় পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিধান করতেন। জীবনে কোনো দিন দাড়ি কাটেননি। বলা যায় যে, তাগুতি সমাজের ছোঁয়া তাঁকে বিন্দুমাত্রও টলাতে পারেনি। সেজন্য এলাকার সুধীজন ও সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ছোট ভাইদের প্রতি তাগিদ দেয়া ছিল তাঁর নিত্যনতুন ঘটনা। সৈয়দপুর ছিল চোর-ডাকাতের ভয়ে ভীত একটি এলাকা। আব্দুল হামিদ দুর্দান্ত সাহসিকতার সাথে চোর-ডাকাত থেকে নিজ গ্রামকে মুক্ত রাখার চেষ্টা চালান। ছোট ভাইদের ঘুমপাড়িয়ে সবার পরে তিনি ঘুমাতেন। ইসলামী আন্দোলনের জন্য তাঁর আত্মত্যাগ সমাজ, তাঁর পরিবার ও পিতা-মাতার গর্ব হিসেবে মর্যাদা পেয়েছেন। তাঁর শাহাদাতের পর তাঁর কথা যখনই তাঁর পিতার মনে পড়ত তখনই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। এর মাত্র তিন বছর ব্যবধানে সেই পিতাও পরপারে পাড়ি জমান। শহীদের মেজ ভাই একবার তাঁর আব্বাকে স্বপ্নে দেখেছিলেন এবং কথা হয়েছিল। তাঁর আব্বা বলেছিলেন, ‘আমি তোমার বড় ভাইয়ের জন্যই কবরে খুব শান্তিতে আছি। শহীদের পিতা হিসেবে মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে সম্মানিত করেছেন, এ সুরত তাঁরই ইঙ্গিত বহন করে।’


শাহাদাতের প্রেক্ষাপট
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ, বৃহস্পতিবার। সত্য আদর্শের ঝাণ্ডাবাহী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত সংবর্ধনার আয়োজন করতে যাচ্ছিল। নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ইসলামী আন্দোলনের সুমহান দাওয়াত তুলে ধরে ইসলামী আন্দোলনকে এ ক্যাম্পাসে তথা রাজশাহীতে আরো বেগবান করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। আগের দিন বুধবার থেকেই শুরু হয়েছিল প্রচার ও অন্যান্য আয়োজন। কিন্তু সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ধ্বজাধারী বলে পরিচিত জাসদ-মৈত্রী, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা শিবিরের এ নবীন-বরণ বানচাল করার এক হীন ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকে। প্রচারকার্যে আগের দিন ছাত্র ইউনিয়নের দুষ্কৃতকারী হেলালের নেতৃত্বে বাধা প্রদান করা হয়। তারা নিরীহ শিবিরকর্মীদের হাত থেকে দস্যুর মতো প্রচারপত্র কেড়ে নেয় ও প্রচারকার্য চালাতে নিষেধ করে। প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের স্বার্থেই শিবিরকর্মীরা ঘটনা সম্পূর্ণ এড়িয়ে অসীম ধৈর্যের পরিচয় দেন। তাঁরা ধৈর্য আর সহনশীলতার পরিচয় দিলেও বর্বরতায় নেশাগ্রস্ত খুনিরা থেমে থাকেনি। সন্ত্রাসীরা শিবিরের কর্মসূচিকে শুধু বানচালই নয় বরং শিবিরের রক্তে মতিহারকে রঞ্জিত করার নীলনকশা এঁটে বসল। নবাগত সংবর্ধনার দিন সকাল থেকেই প্রোগ্রামের প্রস্তুতি চলছিল। শত শত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ও শিবিরকর্মী চারদিক থেকে ছুটে আসছে প্রোগ্রামস্থলে। ছাত্রশিবির আজ তাদের আদর্শের কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র, জনতা, শিক্ষক ও কর্মচারীর কর্ণকুহরে পৌঁছাবে। 

এমনই একটি সুযোগের অপেক্ষা করছিল সন্ত্রাসীরা। একদিকে ছাত্র-জনতার ঢল নামছে প্রোগ্রামস্থলে আর ঠিক তার বিপরীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে অবস্থান করছে সশস্ত্র অবস্থায় দুর্বৃত্তরা। ঘটনার দিন হিংস্র এ হায়েনাদের প্রস্তুতি ছিল রীতিমতো যুদ্ধাবস্থার। হাতে তাদের রামদা, বল্লম, লাঠি ও হকিস্টিক। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। শিবিরের প্রোগ্রাম তারা হতে দেবে না। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ (ফ. চু.), ছাত্রলীগ (যু. গ.), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ অন্যান্য সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত সংগ্রাম পরিষদ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে গোলযোগ সৃষ্টি করে সংঘর্ষ বাধানোর চেষ্টা করতে লাগল। তাদের শত উসকানি সত্ত্বেও শিবিরকর্মীরা সেদিন অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন।


উদ্ভূত পরিস্থিতি উপলব্ধি করে ইসলামপ্রিয় সাথীরা প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন সকল প্রকার হৈ-হাঙ্গামা পরিহার করে প্রোগ্রাম সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত করতে। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। সন্ত্রাসীরা দৃঢ়পতিজ্ঞ, আজ মতিহার চত্বরকে সত্যের আলোকবাহী নিরীহ শিবিরকর্মীদের রক্তে রঞ্জিত করবে। এক ফুঁৎকারেই নিভিয়ে দেবে সত্যের আলোকবাহী মশাল।


কী ঘটেছিল সেদিন
সেদিন সকালেই মতিহার চত্বরে শত শত নবাগত শিক্ষার্থী হাজির হয়েছিল। শুরু হচ্ছিল নবাগতদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। ইতোমধ্যেই বাইরে থেকে কয়েকটি বাস বোঝাই করে পাঁচ-ছয়শত বহিরাগত গুণ্ডা এসে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করল। যখন সন্ত্রাসীরা বুঝতে পারলো তাদের হৈ-হাঙ্গামার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে চলেছে, তখন তারা হিংস্র হায়েনার মতো কালক্ষেপণ না করে যৌথভাবে প্রথমে কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছে উপস্থিত নিরীহ শিবিরকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং পরবর্তীতে আবার প্রোগ্রামস্থলে। সন্ত্রাসীরা শিবিরকর্মীদেরকে চারপাশ থেকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরল। খুনের উন্মত্ততায় রামদা, বল্লম, লোহার রড, ছোরা হাতে সন্ত্রাসীরা দৌড়ে চলল প্রোগ্রামস্থলে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় চারদিক থেকে ঘেরাও করে নিরস্ত্র শিবিরকর্মীদের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ চালাল। প্রোগ্রাম পণ্ড হলো। গোটা ক্যাম্পাসে শুরু হলো মাতম। মতিহারের সবুজ চত্বর শিবিরকর্মীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠল। গগনবিদারী চিৎকার করে অনেকেই প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে চলল দিগ্বিদিক 


শহীদি মিছিলে শরিক হলেন আব্দুল হামিদ
শিবিরকর্মীদের ওপর চারদিক থেকে ইট-পাথর বৃষ্টির মতো পড়তে লাগল। আত্মরক্ষার জন্য অনেকেই মেইন গেটের কাছে বিএনসিসি ভবনে ঢুকে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিল। কিন্তু নরঘাতকরা তাতেও ক্ষান্ত হয়নি। সন্ত্রাসীরা বিএনসিসি ক্যান্টিনে আশ্রয়গ্রহণকারী শিবিরকর্মীদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করে রাখে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা দরজা ভাঙতে চাইলে আব্দুল হামিদ ভাই বলেন, ‘এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদ, ভাঙার দরকার নেই, আমিই খুলে দিচ্ছি।’ এক এক করে টেনে-হিঁচড়ে বের করে চেঙ্গিসীয় ও হালাকু খানের কায়দায় নৃশংসভাবে হামলা চালায় পিশাচরা। বেধড়ক ছুরিকাঘাত, লোহার রড আর হকিস্টিকের আঘাতে গোটা কক্ষ নিরস্ত্র-নিরীহ শিবিরকর্মীর রক্তে ভিজে গেল। দয়া হলো না তাদের দিলে যে, কেন মারছি এদের! এরাও তো আমাদের মতো মানুষ। এদের আসলে কী অপরাধ! পাষণ্ডরা গোটা বিএনসিসি অফিস কসাইখানায় পরিণত করল। রক্তের ছোপ টেবিল-চেয়ার, মেঝে ও দেয়ালে লাগল। তারা সেখানে শহীদ আব্দুল হামিদ ভাইকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে নিয়ে অবর্ণনীয়ভাবে মাথা, নাক ও মুখে একের পর এক আঘাত করতে থাকে আর বলতে থাকে, বল শালা! আর শিবির করবি কি না? শিবির না করলে তোকে ছেড়ে দেব। খুনিদের কথা শুনে আব্দুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমি যে সত্য পেয়েছি, আমি যে আলো পেয়েছি, ইসলামের পথ পেয়েছি, তা থেকে আমি দূরে থাকতে পারব না।’ এমতাবস্থায় হাত দিয়ে মাথা ঠেকাতে গেলে তাঁর সম্পূর্ণ হাত নিজের রক্তেই রঞ্জিত হয়ে যায়। এ অবস্থাতেই আব্দুল হামিদ মৃত্যুর আগে শেষ অবলম্বন হিসেবে বিএনসিসি’র দেয়াল হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি হায়েনাদের উপর্যুপরি আক্রমণের শিকার হয়ে সেখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা ইটের ওপর মাথা রেখে আরেকটি ইটের আঘাতে তার মাথা চূর্ণ করে দেয়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাত ৯টায় হাসপাতাল থেকে ঘোষণা এলো আহত আব্দুল হামিদ এই নশ্বর জগতের সব মায়ামমতা ত্যাগ করে শহীদের মিছিলে শামিল হয়েছেন। কান্নায় ভেঙে পড়লেন সকল কর্মী আর শুভাকাক্সক্ষী। আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে পড়ল তাদের কান্নায়। প্রকৃতি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সবার প্রিয় ব্যক্তি আব্দুল হামিদকে হারিয়ে।


শোকার্ত হৃদয়ে বিদায় দেয়া হলো শহীদ আব্দুল হামিদকে
শহীদ হওয়ার পরদিন ১২ মার্চ, শুক্রবার শত সহস্র শোকার্ত মানুষ রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে উপস্থিত হলেন শহীদ আব্দুল হামিদকে একনজর দেখে চিরবিদায় জানানোর জন্য। সহস্র মানুষের উপস্থিতিতে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হলো। চোখের পানিতে, শোকার্ত হৃদয়ে শহীদ আব্দুল হামিদকে চিরদিনের জন্য কবরে শায়িত করা হলো। জানাজার আগে শোকার্ত কর্মী ও জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব মাওলানা মুহাম্মদ আবু তাহের। আহত হওয়ার সংবাদ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায় রাত এগারটায়। পরদিন মামা ও মেজ ভাই শহীদকে দেখতে রাজশাহী যান। তাঁকে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে, এ সংবাদ নিয়ে তাঁরা গ্রামে ফেরেন। বাড়িতে লাশ পৌঁছালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় দর্শনার্থীদের ভিড় এত বেশি ছিল যে জুমার নামাজ আদায় করে শেষবারের মতো তাঁর দ্যুতিময় মুখটি দেখতে পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাঁর সুনাম সুখ্যাতি কী পরিমাণ ছড়িয়ে পড়েছিল তা এ অবস্থা থেকে সহজেই অনুমেয়। বেলা চারটার দিকে শহীদকে নিয়ে যাওয়া হয় কবরস্থানে। পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।


শুরু হলো প্রতিবাদের ঝড়
এ রকম আদিম হিংস্রতা আর অন্যায়ের প্রতিবাদে ফেটেপড়া রাজশাহীর আপামর ছাত্র-জনতা বিকেলের দিকে মিছিল বের করলেন। শাহাদাতের এ খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়ল। এদিন দেশব্যাপী পালন করা হলো প্রতিবাদ দিবস। মসজিদে মসজিদে শহীদের মাগফিরাত কামনায় অনুষ্ঠিত হলো দোয়ার মাহফিল। দেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বাদ জুমা অনুষ্ঠিত হলো গায়েবানা জানাজা। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার এক বিশাল প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হলো। ঢাকার রাজপথে শুরু হলো প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল। শ্লোগান উঠতে থাকল চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরের বিশাল মিছিল থেকে। চারদিক থেকে শুরু হলো প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের এক প্রবল ঝড়।


বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া
একই ঘটনায় একে একে তিনজন ভাই শাহাদাত বরণ করলেন, ঝরে গেল তিনটি ফুটন্ত ফুল। ১৩ মার্চ তারিখের পত্রপত্রিকায় এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রায় সব ক’টি রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন এবং বুদ্ধিজীবী মহল বিবৃতি দিলেন। অধিকাংশ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হলো এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা উল্লেখ করে। পত্রিকার পাতায়, মিছিলে, প্রতিবাদ সভায় সর্বত্র হত্যাকাণ্ডের জন্য বিশেষভাবে দায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মোসলেম হুদার অপসারণের দাবি ওঠে। ঘটনার দিন এ ব্যক্তির একটি মাত্র আদেশের অভাবে পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেনি, বাধা দিতে পারেনি দুষ্কৃতকারীদের।


আজও স্বপ্ন দেখেন শহীদের মা
শহীদের মা হামিদা বেগমের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার সাথে তো আমার প্রায়ই কথা হয়।’ একদিন বাড়ির পাশের গাছের ডাল ভেঙে হামিদা বেগমের পায়ে পড়লে পা ফুলে যায়। ব্যথায় কষ্ট পেতে থাকেন। ঠিক সে সময় শহীদ আব্দুল হামিদ এসে বললেন, ‘মা, এভাবে কষ্ট করছেন কেন?’ ঘটনা জেনে তিনি পায়ে তিনটি ফুঁ দেন। পরদিন থেকে পা আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়। এভাবেই আরেক দিন স্বপ্নে এসে তাঁর প্রিয় বাবা কতদিন আগে মারা গেছে এবং ভাইদের কে কী অবস্থায় আছে তা জানতে চান।


ঠিক এভাবেই একদিন স্বপ্নে মাকে নানীর বাড়ি বেড়িয়ে নিয়ে আসেন। মায়ের শারীরিক খোঁজ-খবরের সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজনদের কে বেঁচে আছে আর কে মারা গেছে তা জানতে চান। এমনিভাবে আরো একদিন স্বপ্নে আব্দুল হামিদ এলে মা তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ? তিনি বললেন, আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

আরেকদিন তাঁর মা স্বপ্ন দেখলেন, বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েকজন যুবক যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে আব্দুল হামিদও রয়েছেন।
শহীদের মা হামিদা বেগম তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে আরোও বলেন, বড় ছেলে আব্দুল হামিদের কথা মনে পড়লে এখনো খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কত আদরের ছেলে ছিল সে! ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে আমি নিজের ছেলের মতো মনে করি। তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আব্দুল হামিদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ তারা সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে নিতে যেন আন্তরিক প্রচেষ্টা চালায়।


শাহাদাতের পূর্বে শহীদের কথা
গুণ্ডাবাহিনী যখন তাঁকে উপর্যুপরি আঘাত করছিল আর বলছিল, বল শালা আর শিবির করবি কি না, শিবির না করলে তোকে ছেড়ে দেব। তখন খুনিদের কথা শুনে শহীদ আব্দুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমি যে সত্য পেয়েছি, আমি যে আলো পেয়েছি, ইসলামের পথ পেয়েছি, তা থেকে আমি দূরে থাকতে পারবো না।’


সন্তানহারা পিতা-মাতার অবস্থা
শাহাদাতের পূর্বে তাঁর পিতা-মাতা দু’জনই সুস্থভাবে, সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করছিলেন। পুত্রশোককে ভুলতে না পেরে তিন বছর পর শহীদের শ্রদ্ধেয় পিতা জনাব নাসির উদ্দিন ইন্তেকাল করেন। আর জনমদুঃখী মাতা হামিদা বেগম সন্তানহারা ব্যথা নিয়ে এখনো দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।
শহীদের ছোটভাই, শিক্ষক ও প্রতিবেশীর প্রতিক্রিয়া


ছোটভাই ফয়জুর রহমান বলেন, আব্দুল হামিদের উত্তরসূরিদের কাছে আশা করি তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ ত্বরান্বিত করবে। এভাবেই ঢাকাসহ সারাদেশে ইসলামের সুশীতল বাতাস বইবে। প্রতিকূল সংস্কৃতি বিরাজমান থাকায় কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক পরামর্শ দেন। ভাইয়ের কথা মনে পড়লে ইসলামের পথে তিনি শহীদ হয়েছেন মনে করে নিজেকে সান্ত্বনা দেন।
আব্দুল হামিদের মাদ্রাসার শিক্ষক আবুল হুদা মোহাম্মদ আবদুল হাদী বলেন, সে খুব ভাল ছিল। তাঁর আচার-আচরণ, শিক্ষকদের সাথে তাঁর ব্যবহার ছিল অতুলনীয়। জুনিয়র-সিনিয়র সবার সাথে তাঁর আচরণ ছিল অনুকরণীয়। সে তো শাহাদাত বরণ করেছে।


প্রতিবেশী শফিউর রহমান বলেন, সে খুব ভালো ছেলে ছিল। আচার-আচরণ, মানুষের সাথে তাঁর ব্যবহার ছিল চমৎকার। তাঁর মেজভাই, ছোটভাই, পাড়া-প্রতিবেশীদের একটাই মাত্র প্রত্যাশা, শহীদ আব্দুল হামিদের উত্তরসূরিরা যেন তাঁর রেখে যাওয়া আন্দোলনের অসমাপ্ত কাজ সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে যথাযথ প্রচেষ্টা চালায়।

 

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ আব্দুল হামিদ

পিতা

মোঃ নাসির উদ্দিন

মাতা

মোছাম্মাৎ হামিদা বেগম

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৭ জন

স্থায়ী ঠিকানা

ঠাকুরগাঁও জেলার সৈয়দপুরে

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

আরবী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


শহীদ আব্দুল হামিদ

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল হামিদ


শহীদ আব্দুল হামিদ

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আব্দুল হামিদ