শহীদ মশিউর রহমান

১২ জানুয়ারি ২০১৬ - ১২ জানুয়ারি ২০১৬ | ১৫৫

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

“মা তোমার হাত-পা ধরি, মা, তুমি আমাকে বেহালাল খাবার খাওয়াবে না। মা বলেন, অঁই আল্লাহর অলি আছিল।”

শহীদের পরিচিতি
রংপুর মিঠাপুকুরের ইসলামপুর গ্রামের এক নবীন ইসলামী রেনেসাঁর রাহবার ছিলেন শহীদ মো: মশিউর রহমান। ১৯৯৭ সালে জন্ম নেয়া মাত্র ১৫ বছরের এই কিশোর ছিল পিতা-মাতার দুই সন্তানের মধ্যে প্রথম। দরিদ্র পিতা-মাতা কোন রকেমে সংসার চালানো ও সন্তানদের বড় করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। অনেক কষ্টে দুই সন্তানকে ভর্তি করেছিলেন স্কুলে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক অনেক বড় করে তুলবেন এই আশায়। শহীদ মশিউর পড়াশোনার পাশাপাশি দ্বীনি কাজেও ব্যস্ত ছিলেন। ওই দিকে টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে জোগাড় করা এবং ছোট ভাইকেও সহযোগিতা করতেন। এভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি দ্বীনি কাজের মাধ্যমে এলাকার মানুষের প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন। শাহাদাতকালীন সময়ে তিনি একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।

যেভাবে তিনি আল্লাহর ডাকে চলে গেলেন
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ঘটনাস্থল শহীদের নিজ বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার। বেশ কয়েক দিন আগে থেকে মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর কথিত মামলার রায় হওয়ার ঘোষণায় এলাকায় ব্যাপক গুঞ্জরণ চলছে। সেদিনের মিছিলের খবর পেয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত লোক দলবেঁধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেউ রিকশা, কেউ বাইসাইকেল, মোটরসাইকেলে আবার কেউবা নসিমনে করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তেমনি খবর পেয়ে শহীদ মশিউর রহমান বাইসাইকেলযোগে সকাল ৭টায় মিঠাপুকুর যান। সেখানে প্রায় ৫০ হাজার এলাকাবাসীর সাথে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন তিনি।

সালাতুজ জোহরের প্রায় আধা ঘণ্টা পর হাজার হাজার জনতার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ-বিজিবি নির্বিচারে শত শত রাউন্ড টিয়ার শেল ও গুলিবর্ষণ করতে থাকে। সাথে সরকারি দলের লোকেরা উসকানি দিতে থাকে। ঘটনাস্থলেই ৫ জন শহীদ হন, মশিউর রহমান তাদের একজন।

বেলা ২.৩০ মিনিটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এরপর তার লাশ তার সাথীরা পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। দরিদ্র পিতা-মাতা সেদিন আলুক্ষেতে কাজ করছিলেন, মা কিভাবে টের পেয়ে যান। অজ্ঞান হয়ে ক্ষেতেই লুটিয়ে পড়েন। ভ্যানে করে তাকে আনা হয় বাড়িতে; অপর দিকে মাগরিবের একটু আগে মশিউরের লাশ বাড়িতে নিয়ে এলে সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক প্রেক্ষাপট। অতঃপর নামাজের পর তার জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

শাহাদাতের পূর্বের বিভিন্ন ঘটনা

শহীদ মশিউর শাহাদাতের আগে মাঝে মাঝে বলতেন, “আমি শহীদ হবো শহীদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি।” দাদীকে বলতেন, “শহীদেরা মৃত্যুবরণ করে না, তারা জীবিত থাকে কিন্তু মানুষ তা বোঝে না।” শিক্ষককে বলতেন, “ভয় করে লাভ নেই, স্যার, দরকার হলে আমরা শহীদ হয়ে যাবো।” তিনি যেন জেনে বুঝেই শাহাদাতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মাকে বোঝাতেন “যদি মরি আমাকে পিঁপড়াও খাবে না।” পশু পাখি জানার আগে আপনি জানবেন, আম্মা। মা মোর্শেদা বেগম বলেন, আমি কখনও বাধা দেই নাই। আগের রাতে ‘হৃদয়ের সব আবেগ উজাড় করে মশিউর জনম দুঃখিনী মায়ের কাছে বললেন, “আম্মা আমার জন্য দোয়া করবেন, আর আমার জানের আপত্তি করবেন না।” ঘটনার দিন সকালে মনমরা আম্মার কাছে থেকে বিদায় নিলেন, “মা আমি গেলাম।” আর মা-টাও কেমন, গেরস্তা মুজিবুর তাকে বলেছিলেন, বাধা দিলে না- মায়ের উত্তর ‘বাধা দিলে তো জিহাদ করতে পারবে না।’ ৫-৬ দিন আগে হতে শহীদ মশিউর ‘ইন্নাল্লাহা মা সাবেরিন’ বারবার পড়তেন। যেন ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা এলে সর্বোচ্চ ধৈর্য ধরতে পারেন, এই জন্যই কি?

মির্জাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, ছেলেটি ষষ্ঠ থেকে এসএসসি পর্যন্ত আমাদের ছাত্র ছিল। আচার ব্যবহার কী বলবো ভাষা নেই। শাহাদাতের আগের দিন এক দোকানদারের পাওনা ৫০ টাকা খুব গুরুত্ব দিয়ে ফেরত দিয়েছিলেন।

সাইফুল ইসলাম, এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ক্যান্ডিডেট ছিলেন। তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘তার ১০-১১ বছরের ছেলেটি মশিউরের নাম শুনলেই হাউ মাউ করে কাঁদে সে প্রায়ই ওর সাথে দেখা করতো, কিশোরকণ্ঠ দিত। পিতামাতার চেয়েও মশিউরকে সে বেশি ভালবাসতো। আমরা এলাকার বিশাল কিছু হারালাম।’ শহীদ মশিউর রহমান অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। সংসারে সহযোগিতা করার জন্য তিনি মুরগি পালন করতেন। শাহাদাতের ৩-৪ দিন আগে ১ রিম কাগজ কিনে ছোট ভাইকে দিয়ে বলেছিলেন, তোমাকে মানুষ হতে হবে। বৃদ্ধা দাদীর নামাজের পূর্বে তায়াম্মুম করানো এমনকি তার পায়খানা পরিষ্কার পর্যন্ত করতেন। তিনি এতটা আমানতদার ছিলেন যে, বাবা পাশের পুকুরে গোসল করতে গিয়ে একটি মাছ ধরে আনেন। বাড়ি এসে মশিউর আম্মাকে বলেন, মাছ কোঠে পাইলো? সব জানার পর বলেন, “এ মাছ খাইলে পায়খানা খাওয়া হইবে।” প্রায় বলতেন, ‘মা তোমার হাত-পা ধরি মা, তুমি আমাকে বেহালাল খাবার খাওয়াবে না।’ মা তাই আজ কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘ছেলেটা আল্লাহর অলি আছিল। সারা বাংলাদেশ খুঁজে এমন ছেলে পাওয়া যাবে না।’ শাহাদাতের দিন দিবাগত রাতে মা কেঁদে কেঁদে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। শেষরাতে স্বপ্নে দেখেছেন মশিউর এসেছে আবেগ দিয়ে বলছে, আম্মা! আব্বা যেন নিয়মিত আমাজ পড়ে। দাদীকে তায়াম্মুম করে নামাজ পড়তে বলবেন। আর আাপনি কানছেন ক্যানো? আপনাকে না বলেছিলাম, “আম্মা আমার জন্য দোয়া করবেন, আর আমার জানের আপত্তি করবেন না, আমি ভাল আছি।”

ব্যক্তিগত প্রোফাইল

নাম : শহীদ মো: মশিউর রহমান

মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র
শাহাদাতের সময় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী এবং মিঠাপুকুর থানার সেক্রেটারি ছিলেন
জন্ম তারিখ : ১৯৯৭ সালে, বয়স : ১৬ বছর
আহত হওয়ার তারিখ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, আহতের ধরন ও পরবর্তী অবস্থা : পিঠে গুলিবিদ্ধ হন
শাহাদাতের তারিখ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ আনুমানিক বিকেল ৫টা
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : ইসলামপুর, ডাকঘর : দেউলপাড়া, ইউনিয়ন : ১৬ নং বৈরাতী, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর
পিতা : মো: আনোয়ার হোসেন (৪২), দিনমজুর
মাতা : মোর্শেদা বেগম (৩৫), গৃহিণী
ভাইবোনের বিবরণ : শহীদ মো: মশিউর রহমান, মো: মোস্তাফিজুর রহমান, ৮ম শ্রেণী, মির্জাপুর উচ্চবিদ্যালয়

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মশিউর রহমান

পিতা

মো: আনোয়ার হোসেন

মাতা

মোর্শেদা বেগম

জন্ম তারিখ

জানুয়ারি ১২, ২০১৬

ভাই বোন

২ভাই, বড়

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রাম : ইসলামপুর, ডাকঘর : দেউলপাড়া, ইউনিয়ন : ১৬ নং বৈরাতী, উপজেলা : মিঠাপুকুর, জেলা : রংপুর

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র

শাহাদাতের স্থান

মিঠাপুকুর


শহীদ মশিউর রহমান

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মশিউর রহমান


শহীদ মশিউর রহমান

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মশিউর রহমান