শহীদ শফিকুর রহমান শিমুল

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ০৬ অক্টোবর ২০০৩ | ১১৯

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

গোলাপের বাগানে র্সবাপেক্ষা সুন্দর গোলাপটি বাগানে অল্পদিন অবস্থান করে। কারণ সবার আর্কষন থাকে বাগানের সবচেযে সুন্দর গোলাপের প্রতি। অনুরূপ শফিকুর রহমান শিমুল ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির নামক গোলাব বাগানের র্সবাপেক্ষা সুন্দর। সদ্য ঝরে যাওয়া একটি প্রস্ফুটিত গোলাব। আল-কুরআনের ঘোষণা: অর্থ : তোমাদেও মধ্যে এমন একদল লোক অবশ্যই থাকতে হবে যারা মানব জাতিকে কল্যানের পথে আহবক্ষান করবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে অসৎ কাজে বাধা দিবে, তারাই হল সফলকাম। (সুরা আলে ইমরান ১০৪)

শহীদ শফিকুর রহমান শিমুল ছিল আল কুরআনের এই র্নিদেশ পালন কারী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী দলের আগমনী এক অকুতোভয় মুজাহীদ, প্রতিভাবান সংগঠক, অনলর্বষী বক্তা, সুন্দর গরনের, পরিশীলিত জীবনযাপনকারী, আর্কষণীয় ব্যক্তিত্বেও অধিকারী এক যুবক, যে গত ৬ই অক্টোবর দুপুরে লিখে গেল তার নাম সেই তালিকায়- যে তালিকায় নাম ইতিহাসের থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব। তাদের র্কম আর আর্কষনীয় গুনের কারনে যে নাম বাস্তবে আমাদের মাঝে না থাকলেও অবস্থান করে নিয়েছে কোটি মানুষের হৃদয়ে। যে নাম বিপ্লবের বাসনায় জাগিয়ে তোলে লক্ষ যুবুকের ঘুমন্ত অন্তরকে। যাদের পবিত্র রক্তের সুঘ্রানে দ্বীনের জন্য র্উবর হয় প্রতিটা প্রান্তর। এত মহান সৌভাগ্য আর র্মযদার অধিকারী তারাই হন আল্লাহ যাদের বিষেশভাবে কবুল করেন। শহীদদের র্মযদা সম্পকে আল্লাহ ঘোষণা করেন- অর্থ : আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছেন তাদেরকে মৃত বলো না। প্রকৃত পক্ষে তারা জীবিত এবং আল্লাহর নিকট থেকে রিযিক প্রাপ্ত। (সুরা আলে ইমরান-১৬৯)।

শহীদ শিমুল ছিল শাহাদাতের প্রেরনায় উজ্জীবিত এক প্রাণ। তার শাহাদত সম্পকে সে পুবেই জানতে পেরেছিল তাই তার ডায়েরীতে সে নিজে সুন্দর করে লিখে রেখেছিল

“এমন জীবন তুমি করিবে গঠন
মারিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন”


সত্যিই শহীদ শিমুল, বুলেটের আঘাতে তার সুন্দর চেহারা হয়েছিল ঝরঝরা কিন্তু প্রস্ফুটিত হয়েছিল রক্তাক্ত মুখে স্মিত হাসির রেখা। কবরে নামানোর র্পুবেও কফিন দিয়ে ঝড়ে পরছিল ফোটা ফোটা রক্ত যা দেখে হাজারো তৌহিদী জনতা অশ্রুসিক্ত নয়নে সাক্ষ্য দিয়েছিল-শিমুল আমির হাম্জা আর আবুল মালেকের উত্তরসুরি। সাহাদাতের প্রস্তুতি নিয়েই শিমুল পথ চলত সারাক্ষন। তাই গত ২রা অক্টোবও যখন কুষ্টিয়া পলিটেকনিক থেকে সবাইকে ছুটি দেওয়া হলো চলে যাওয়ার জন্য। তখন বেহেশতী সেই জবান থেকে ক্ষোভের স্বরে শিবিরের ভিপিকে লক্ষ্য করে বলেন “আপনারা কি যে করেন-প্রতিদিন আমি শহীদ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসি কিন্তু ফিরে যেতে হয়। ”শিমুল ভাই-এর হৃদয়ে সেই অদম্য বাসনা আল্লাহ কবুল করলেন গত ৬ই অক্টোবর কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট এর সবুজ চত্বরে।

সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা
সেদিন ছিল কুষ্টিয়া পলিটেকনিক কলেজ ২০০৩-০৪ সেকশনের প্রথম বর্ষে ছাত্র ভর্তির দ্বিতীয় অপেক্ষমান তালিকা টানানোর দিন। অবশ্য কুষ্টিয়া পলিটেকনিকের গত কয়েক বছর ইতিহাস হল একটা সন্ত্রাসী গ্রুপ কালো টাকা আর পেশি শক্তির বলে মেধাহীন সন্ত্রাসীদের ভর্তি করে থাকে আর হাতিয়ে নেয় লক্ষ লক্ষ অবৈধ টাকা। সাধারন ছাত্র ছাত্রীরা এই র্দুনীতির প্রতিবাদ প্রকাশ্যে করতে না পারলেও ২০০৩ সালের কলেজ সংসদ র্নিবাচনে তারা নিরব প্রতিবাদ করেছিল ব্যলটের মাধ্যমে। তারা বিপুল ভোটে বিজয়ী করে ছাত্রশিবির মনোনীত ভিপি প্রভিপিসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল পদে। তাই এবারের ভর্তির সকল অনিয়ম আর দুর্নীতি বন্ধের ব্যপারে আদর্শিক।

সংগঠন হিসাবে ছাত্রশিবির প্রথম থেকেই শক্ত ভূমিকা পালন করে। যে কারনে কলেজ প্রশাসন ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের সকল হুমকি উপেক্ষা করে গত ৬ই অক্টোবরে মেধা অনুযায়ী অপেক্ষমান তালিকা টানিয়ে দেয়। শিবির কর্মীরা যখন স্বাভাবিক ভাবে ভর্তি কাজে ব্যাস্ত তখন ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা জোরর্পুবক ছিরে ফেলে মেধাভিক্তিক টানানো তালিকা। হামলা চালায় কলেজ অধ্যক্ষের রুমে। তাদের দেওয়া তালিকা টানাতে অস্বীকার করলে, ভাংচুর করে অধ্যক্ষর কক্ষ। শারীরিক ভাবে র্নিযাতন করে অধ্যক্ষকে। এতেও ঐ সকল রক্ত পিপাসু খুনিদের রক্ত পিপাসা নিবারন হয়নি।এর পর তারা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তাদের এই দূর্নীতির প্রধান প্রতিবন্ধক ইসলামী ছাত্রশিবিরের নিরহ কর্মীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করতে থাকে নিরহ শিবিরের নেতা কর্মিদের লক্ষ্য করে। মুহুর্তের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শিবির নেতা শিমুল, মোস্তাক, জাহাঙ্গীর, হামজাসহ আরো অনেক। ক্ষনিকের মধ্যেই শিবির কর্মিদের ছোপ ছোপ রক্তে কালো পিচপথ হয়ে যায় লাল। আহতদের আর্তচিৎকারে আশে পাশের পরিবেশ হয়ে উঠে ভারী। কিছুক্ষন পুর্বেও যাদের সাথে ভাল কথা হলো তাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে ঐ খুনি চক্রেও হৃদয়ের একটু আঘাত লাগেনি। আহতদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলো। মাথার বাম পর্শে গুলিবিদ্ধ শিবির নেতা শিমুল ভাইকে জরুরী ভাবে অপারেশনথিয়েটারে নেওয়া হলে অল্প কিছুক্ষন পরই একজন চিকিৎসক চোখ মুছতে মুছতে কক্ষ থেকে বের হলেন। অপেক্ষমান শহীদের সাথীদের আর বুঝতে বাকি থাকলনা যে তাদের প্রিয় ভাই শফিকুর রহমান শিমুল শাহাদতের র্মযদা নিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাযিউন )। বিদ্যুৎ গতিতে সাহাদাতের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল চর্তুদিকে। আমি যখন ফোনে হাসপাতাল থেকে সংবাদ পাই আমার চেহারা দেখেই শহীদের শত শত সাথীদের কান্নার চিৎকার যেন আসমান ভেদ করে আরশে আযিমকে কাঁপিয়ে তুলছে। অনেকে তাদের প্রিয়োজন হারানোর বেদনায় র্মূছা গেলেন, লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। আমি নিজেকেই সংযোত করতে পারছিলামনা, কিভাবে অন্যদেরকে বুঝ দেব। কোন রকমে স্বাভাবিক হয়ে হাসপাতালে যেয়ে দেখি শহরের মধ্যে বিরাজ করছে এক নিস্তব্ধতা। হাসপালের গেটে অশ্রুসিক্ত চোখে অপেক্ষা করছে শত শত মানুষ শহীদের দেখার জন্য। এদিকে শহীদের হাজারো সাথীরা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। শহীদের খুনিদের গ্রেফতার আর শাস্তির দবিতে নারায়ে তাকবীরে শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠল শহরের চতুর্দিক।

শাহাদতের সংবাদ ঢাকায় অবস্থানরত ৩ ভাইকে জানানো হলে গভীর রাতে তারা এসে পৌছিল। বড় ভাই তার আদরের শিমুলকে কফিনের মধ্যে দেখে চিৎকার করে বলে উঠলেন, শিমুল তুমিনা আমাকে বইকিনে আনতে বলেছিলে, সেই বই আমি আজ কাকে পড়তে দেব বল! অপর দুই ভাই এর একই অবস্থা। আমরা যারা বুঝ দেওয়ার জন্য এলাম করুন পরিবেশ দেখে সকল ভাষাই হারিয়ে ফেললাম। অনেক শক্ত মন নিয়ে নিচে নেমে এসে বড় ভাই এর অবস্থা দেখে আর অশ্রু ধরে রাখতে পারলাম না। নিজে অসাভাবিক হয়ে পড়াতে বড় ভাইকে কিছু না বলেই ফিরে গেলাম। তার জানাযায় মুষুলধারে বৃষ্টির মধ্যে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়ে প্রমান করেছিল শহীদ শিমুলের রক্তে ভেজা এই ময়দান বাতিলের কাছে মাথা নত করবে না। কফিন বাড়িতে পৌছলে শহীদের গর্বিত মা একটি কথা বলেই জ্ঞান হারালেন, আমার প্রতিদিন কোরআন পড়া শিমুলকে কোন অপরাধে মারা হলো তোমরা জবাব দাও! উপস্থিত হাজার হাজার জনতার চোখে পানি ছাড়া মুখে কোন ভাষা ছিল না। এর জবাব তিনি কোথায় পাবেন, কারা দিবে এর জবাব! একটা মানুষ, অকালে একটা প্রতিভা ঝরে যাবে শুধু মাত্র ইসলামের সাথে সম্পর্ক থাকার কারনে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারনে! আর আমাদের মত যুবুকেরা নীরবে বসে থাকবে! না তা হতে পারে না। শহীদ শিমুলসহ ১১৯ জন শহীদের পিতা-মাতার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য আমাদেরকে বজ্রদীপ্ত শপথ নিতে হবে।

একনজরে শহীদ মুহাম্মদ শফিকুর রহমান শিমুল
নাম : মুহাম্মাদ শফিকুর রহমান শিমুল
পিতা : মুহাম্মাদ জহুরুল আলম
মাতা : সেলিনা বেগম
শিক্ষাগত যোগ্যতা : এস.এস.সি প্রথম বিভাগ ১৯৯৫ বিজ্ঞান, জিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এইচ.এস.সি দ্বিতীয় বিভাগ, ১৯৯৯ বানিজ্য, সম্মান ৩য় বর্ষ (একাউন্টিং), কুষ্টিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।
ভাই বোন : ৪ ভাই ১ বোন।
অবস্থান : সবার ছোট।
পেশা : আব্বুসহ বড় ৩ ভাই চাকরিজীবী, আম্মু গৃহিনী।
সাংগঠনিক মান : সাথী
আহত হওয়ার স্থান : কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সবুজ চত্বর
শাহাদতের সময় : ২-১২ মিনিট- সদর হাসপাতাল, কুষ্টিয়া।
যাদের আঘাতে শহীদ: ছাত্রদলের গুণ্ডাবাহিনী, বুলেটবিদ্ধ।
যে শাখার শহীদ : কুষ্টিয়া জেলা।
শহীদের স্মরণীয় বাণী : শহীদ হওয়ার পূর্বে নিজের ডায়েরীতে লিখেছিলেন;
‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’।

শাহাদাতে শহীদের মায়ের প্রতিক্রিয়া
শহীদের গর্বিত মা কফিন দেখে একটি কথা বলে জ্ঞান হারিয়েছিলেন; ‘প্রতিদিন কুরআন পড়া আমার শিমুলকে কোন অপরাধে হত্যা করা হলো জবাব দাও।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ শফিকুর রহমান শিমুল

পিতা

মুহাম্মাদ জহুরুল আলম

মাতা

সেলিনা বেগম

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

সবার ছোট

স্থায়ী ঠিকানা

কুষ্টিয়া শহরের যুগিয়া

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

সম্মান ৩য় বর্ষ (একাউন্টিং), কুষ্টিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।

শাহাদাতের স্থান

সদর হাসপাতাল, কুষ্টিয়া।


শহীদ শফিকুর রহমান শিমুল

ছবি অ্যালবাম: শহীদ শফিকুর রহমান শিমুল


শহীদ শফিকুর রহমান শিমুল

ছবি অ্যালবাম: শহীদ শফিকুর রহমান শিমুল