শহীদ মুহাম্মদ ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর

০১ জুন ১৯৮৭ - ২১ আগস্ট ২০০১ | ১১৫

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

সত্যের বিজয় নিশান উদ্দীপ্ত হবে, মিথ্যার গাত্রদাহ তীব্র হবে এটাই স্বাভাবিক। শত নির্যাতনের প্রাচীর ভেদ করে যুগে যুগে একদল সত্যের পতাকাবাহী সৈনিক থাকবেই। সেই সত্যদীপ্ত কাফেলার অকুতোভয় সৈনিক সুন্দর, নিষ্পাপ, দীপ্তমান হাস্যোজ্জ্বল চেহারার প্রিয় ভাইটির নাম ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর। যিনি আর কখনো আমাদেরকে বাতিলের বিরুদ্ধে হুংকারের জন্য জাগাবেন না। কিন্তু তার প্রতিধ্বনি জাগ্রত থাকবে চিরদিন। শহীদ ইব্রাহীম ছিলেন অসংখ্য ফুটন্ত গোলাপের মত সৌরভ বিলানো অনন্য এক নাম, হাজারো নক্ষত্রের মাঝে তেজোদীপ্ত একটি নক্ষত্র আর প্রাণবন্ত, আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান, চারিত্রিক বলিষ্ঠতা, জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ দ"ষ্টিভঙ্গি ও তীক্ষ্ম মেধা যা তরুণদেরকে বিমোহিত করেছিল। কিন্তু সেই আশার গোলাপটি আজ আমাদের মাঝে নেই। যার আকুতি ছিল-
হে আল্লাহ, আমাকে তুমি বুদ্ধি দাও,
হে আল্লাহ, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও,
হে আল্লাহ, আমাকে তুমি শান্তি দাও,
হে আল্লাহ, আমাকে তুমি বড় করে তোল।
ভোরের সুমধুর আযানের ধ্বনিতে প্রতিদিনের ন্যায় জেগে ওঠে আলকরা গুণবতীবাসী। ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। সুন্দর, নির্মল স্বাভাবিক পরিবেশ, স্বাভাবিক কার্য শুরু হওয়ার পূর্বেই গ্রামের জনপথ হঠাৎ থমকে যায় বাতিলের গুলির আওয়াজে। কাকডাকা ভোরের সাথে শামিল হয়েছিল মানুষের আর্তচিৎকার। ভারী হয়ে গিয়েছিল আলকরা গুণবতীর আকাশ বাতাস।

সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা
দিনটি ছিল ১৭ আগস্ট শুক্রবার। ইসলামবিরোধী শক্তি আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছিল কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার আলকরাতে। এতে নেতৃত্ব ও সহযোগী ছিল ১৯৯৬ সংসদ নির্বাচনের অস্ত্র-সন্ত্রাস ও কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে বিজয়ী সংসদ সদস্য ও হুইপ মুজিবুল হক মুজিব এবং সন্ত্রাসীদের গডফাদার ফেনীর জয়নাল হাজারীর গুণ্ডাবাহিনী। পঞ্চাশের অধিক সন্ত্রাসী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গুলি করে করতে গ্রামে প্রবেশ করে। জামায়াত শিবির অফিস ভাঙচুর, ৭টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বহু নিরীহ লোককে আহত করে এবং লুটপাট করতে থাকে। তাদের অতর্কিত হামলায় জাগ্রত গ্রামবাসীসহ শিবিরকর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রতিহত করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় ত্রিশজনের অধিক। এদের মধ্যে জসিম উদ্দিন, টিপু, কামাল হোসেন, নেছার, আবুল খায়ের, আবদুল হাই, আকবর সোহাগ, মাইনুদ্দীন, ইউনুস ও ইব্রাহীম গুরুতর আহত হন। তাদের মধ্যে মারাত্মক আহত ইব্রাহীমকে প্রথমে চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা পরে ঢাকার একটি কিনিকে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। কিন্তু ইব্রাহীমের অবস্থা ছিল খুবই আশঙ্কাজনক, তার চোখের পাশ দিয়ে গুলি মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছিল। দীর্ঘ পাঁচদিন অচেতন থাকার পর ২১ আগস মঙ্গলবার রাতে দুনিয়ার সকল মায়া ত্যাগ করে মহান প্রভুর নিকট চলে যান মু. ইব্রাহীম মঞ্জুর চৌধুরী।

রাত ৮টায় ইব্রাহীমের শাহাদাতের খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা, তার নিজ জেলা কুমিল্লাসহ সারাদেশে। হাসপাতালে সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। কেন্দ্রীয় সভাপতি নূরুল ইসলাম বুলবুলসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও রাজধানীর কর্মীরা ছুটে যান হাসপাতালে। বাঁধভাঙা কর্মীদের দাবিতে নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিলেন পরের দিন ঢাকায় জানাযা ও শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হবে এবং কুমিল্লার নেতৃবৃন্দও স্থানীয়ভাবে কর্মসূচী ঘোষণা করলেন।

পরের দিন সকাল থেকেই হাজার হাজার শোকবিহবল ছাত্র-জনতা শিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস চত্বরে জমায়েত হতে থাকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পোস্টমর্টেম শেষে দুপুর পৌনে ১টায় শহীদের কফিন পুরানা পল্টন পৌঁছে। এর পূর্বেই এক প্রতিবাদ মিছিল বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে শুরু হয়ে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিল যখন পুরানা পল্টন মোড় হয়ে বায়তুল মোকাররমের দিকে আসে তখন শহীদ ইব্রাহীমের লাশ সেখানে পৌঁছে। এ সময় এক মর্মস্পর্শী দ"শ্যের অবতারণা হয়। ভাই হারানোর বেদনায় শোকাহত হয়ে পড়ে সবাই। উপস্থিত জনতার আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। লামকে মিছিলর সামনে করে নিয়ে যাওয়া হয় বায়তুল মোকাররম মসজিদে। জোহর নামাজ শেষে নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে। প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজারো ছাত্র-জনতা বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটের নামাজে জানাযায় অংশ নেয়। জানাযার ইমামতি করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী।

জানাযা শেষে কফিন নিয়ে শিবির সভাপতি নূরুল ইসলাম বুলবুল নেতৃত্বে অন্যরা কুমিল্লার উদ্দেশে রওয়ানা হয় বিকাল সাড়ে ৪টায়। শত শত নেতাকর্মী শহীদের জানাযায় অংশ নেয়ার জন্য প্রখর রোদের মাঝে টাউন হল ময়দানে অপেক্ষা করতে থাকে। শহীদের কফিন উপস্থিত হলে কর্মীদের কান্নার রোল পড়ে যায়। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে বাদ আসর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। শহীদের ৩য় জানাযা অনুষ্ঠিত হয় চৌদ্দগ্রামে। এখানে হাজারো ছাত্র-জনতা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে জানাযায় অংশ নেয়। অতঃপর বিরাট গাড়ির বহর নিয়ে ৪র্থ জানাযা আলকরা ধোপাখিলা হাইস্কুলের মাঠে, ৫ম জানাযা গুণবতী কলেজ ময়দানে ও শেষ জানাযা নিজ গ্রাম ঝিকড়ায় অনুষ্ঠিত হওয়ার পর শহীদের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

শহীদ ইব্রাহীম ছিলেন অসহায় পিতার একমাত্র জীবিত ছেলে। ইতোপূর্বে ৬ ভাই নানা অসুখে মারা যান। শহীদের পিতা আবদুল কাদের সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে পাগলপ্রায় হয়ে যান। কী অপরাধে খুন করা হলো? ইব্রাহীম তো ছিল অমায়িক, ভদ্র, নম্র। নিয়মিত নামায আদায় করতো। ইসলামের জন্য নিবেদিত কর্মী যিনি ছোট হয়েও দায়িত্ব পালনে ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। পড়ার টেবিলে পাঠ্য বইয়ের সাথে সাথে কুরআন হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য থাকতো। সাথী শপথ নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারি ইব্রাহীমকে আর দেখা যাবে না নামাজ পড়ার জন্য ডাকতে। ইব্রাহীমকে হারানোর বেদনায় আজ চৌদ্দগ্রাম বাসীর ফরিয়াদে আল্লাহর আরশ যেন কাঁপছে। সন্ত্রাসের জনপদ চৌদ্দগ্রামে ইব্রাহীমের শাহাদাতের ঘটনা প্রথম নয়। এর আগে ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর সন্ত্রাসীরা আলকরা ইউনিয়নের সেক্রেটারি শিবিরের সাথী তৌহিদুল ইসলামকে খোঁজ করে। বাড়িতে নেই বললে সন্ত্রাসীরা তৌহিদের পিতা সুরুজ মিয়াকে গুলিকরে বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। হিংস্র পশু হায়েনার দল গুলিবিদ্ধ সুরুজ মিয়াকে রামদা এবং কিরিচ দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। সন্ত্রাসীদের নির্মম অত্যাচারে ঘটনা¯'লেই শাহাদাত বরণ করেন হাজী সুরুজ মিয়া। পুত্র না পেয়ে পিতা হত্যার ঘটনা চৌদ্দগ্রামসহ বাংলাদেশের মানুষকে হতবাক করেছে। এখানেই শেষ নয়, হাজী সুরুজ মিয়ার রক্তের দাগ না শুকাতেই ২৬ অক্টোবর দিনদুপুরে গুণবতী ডিগি কলেজে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন শিবিরকর্মী মোহাম্মদ শাহাবউদ্দিন। সেদিন শাহাব উদ্দিনের পিতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন; আমার ছেলের কোন দোষ ছিল না। সে শুধু ইসলামের কথা বলতো। এজন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে।

একনজরে শহীদ মু. ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর
নাম : মু. ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর
পিতার নাম : মোহাম্মদ আবদুল কাদের
মাতা : জাহানারা বেগম
জন্ম : ১ জুলাই ১৯৮৭
সাংগঠনিক মান : কর্মী
দায়িত্ব : উপশাখা বায়তুলমাল সম্পাদক
সর্বশেষ পড়াশোনা : নবম শ্রেণী
সর্বশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : গুণবতী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়
আহত হওয়ার স্থান : নিজ গ্রাম
শহীদ হওয়ার স্থান : ঢাকার একটি ক্লিনিক
অঘাতের ধরন : গুলি
যাদের আঘাতে শহীদ : আাওয়ামী সন্ত্রাসী হাজারী ও হুইপ মুজিব বাহিনী
শহীদ হওয়ার তারিখ : ২১.০৮.২০০১
যে শাখার শহীদ : কুমিল্লা জেলা
স্থায়ী ঠিকানা : ঝিকড্ডা চৌধুরী বাড়ি (পশ্চিম পাড়া), গুণবতী, চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা
ভাই বোনদের সংখ্যা : ১ ভাই ২ বোন (তিনি মেঝ)
কবর যেখানে : গ্রামের বাড়িতে গোরস্থান
যে শাখার শহীদ: কুমিল্লা জেলা দক্ষিণ
শখ : বই পড়া
মায়ের প্রতিক্রিয়া
খুবই ভালো ছেলে ছিল। ব্যবহার ছিল কোমল। নামাজের সময় বাড়ির সবাইকে নিয়ে জামাতে নামাজ পড়তে।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুহাম্মদ ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর

পিতা

মোহাম্মদ আবদুল কাদের

মাতা

জাহানারা বেগম

জন্ম তারিখ

জুন ১, ১৯৮৭

ভাই বোন

১ ভাই ২ বোন (তিনি মেঝ)

স্থায়ী ঠিকানা

ঝিকড্ডা চৌধুরী বাড়ি (পশ্চিম পাড়া), গুণবতী, চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

নবম শ্রেণী, গুণবতী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়

শাহাদাতের স্থান

ঢাকার একটি ক্লিনিক


শহীদ মুহাম্মদ ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর


শহীদ মুহাম্মদ ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ ইব্রাহীম চৌধুরী মঞ্জুর