শহীদ মুহাম্মদ মুহসীন কবির

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ৩১ অক্টোবর ১৯৯৮ | ৯৭

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের তৌহিদী জনতার দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর রক্তঝরা আন্দোলনের ফসল। এ বিদ্যাপীঠকে তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করার জন্যে শুরু থেকেই ইসলামবিদ্বেষী ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি হাজারো ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেছে। শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ইসলামবিরোধী, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল আদর্শ পরিপন্থী নিয়োগ দান করে সেই ষড়যন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান থেকে এ বিদ্যাপীঠে মুক্তিকামী ছাত্রজনতার হৃদয়ের স্পন্দন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রজনতার প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা পালন করে আসছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বীনি চরিত্র ধ্বংসের জন্যে ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পরিকল্পিত সন্ত্রাসের নেশায় মেতে উঠে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই তার প্রতিষ্ঠার ২৩ বছর অতিক্রম করেছে। এ স্বল্প সময়ে খোদাদ্রোহী শক্তির পরিকল্পিত সন্ত্রাসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ইঞ্চি সবুজ জমিন রক্ত লালে রঞ্জিত হয়েছে। ৫ জন মেধাবী ছাত্রের শাহাদাতের নজরানা পেশ, অসংখ্য ছাত্রের বুলেটবিদ্ধ দেহ নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গোনা, হাত, পা, চক্ষু হারানোর বেদনাসহ ক্যাম্পাসের সবুজ জমিনের উপর শহীদি রক্তের ছোপ আজো অতীতের বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া নারকীয় তাণ্ডবতার নৃশংস ঘটনার নীরব সাক্ষী। ৩১ অক্টোবর ’৯৮ ছিলো ইতিহাসের আরেক ভয়াবহ কালো অধ্যায়। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যোগসাজশে আওয়ামী ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস দখলের অভিপ্রায়ে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। নির্বিচারে গুলিবর্ষণে শহীদ হন শিবির নেতা আল মামুন ও মুহসিন কবির। একদিকে পুলিশী তাণ্ডবতা অন্যদিকে আওয়ামী ছাত্রলীগের শত শত রাউন্ড গুলিবর্ষণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস দ্বীনের পতাকাবাহী শিবির কর্মীদের রক্তে রঞ্জিত হয়।

ঘটনার সূত্রপাত
১৯৯৫ সালের ২৮ এপ্রিলের এক ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় গেফতার করা হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি এ.ডি.এম ইউনুস ও আসাদুজ্জামানকে। ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার জন্যে এটা ছিলো ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গভীর ঘৃণ্য নীলনকশা। এরূপ পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে বিশ্ববিদালয় সংগঠন সকল দায়িত্বশীল ভাইকে সতর্কভাবে চলাফেরা জন্য পরামর্শ দেন। এ দিকে ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া শহর থেকে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে পূর্ব থেকে ওঁৎ পেতে থাকা পুলিশ গ্রেফতার করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মুহাম্মদ নজরুল ইসলামকে। গ্রেপ্তারের সংবাদ মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ শহরসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেফতারের প্রতিবাদে ৩১ অক্টোবর ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ, পরদিন ১ নভেম্বর ক্যাম্পাসে সর্বাত্মক ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ঘোষিত কর্মসূচি মোতাবেক ৩১ অক্টোবর বেলা ১১ টায় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকে খণ্ড খণ্ড প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়। গগণবিদারী প্রতিবাদী শ্লোগানে প্রকম্পিত হলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

প্রতিবাদ মিছিল শেষ করে ক্যাম্পাস করিডোরে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে পূর্ব ঘোষিত ১ নভেম্বরের ছাত্র ধর্মঘটের কর্মসূচি সফল করার জন্য আহবান জানানো হয়। এ দিকে ছাত্রলীগের হায়েনার ধর্মঘটের বিপক্ষে উত্তেজনাকর শ্লোগান দিয়ে ক্যাম্পাস উত্তপ্ত করে তোলে। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী মিছিল শিবির কর্মীদের অবস্থান বরাবর চক্কর দিতে থাকে। এ পরিস্থিতিতেও নেতৃবৃন্দের নির্দেশে শিবির কর্মীরা সীমাহীন ধৈর্যের পরিচয় দেয়। খুনের নেশায় উন্মাদ ছাত্রলীগ হায়েনারা শিবির নেতা মোয়াজ্জেমের উপর হামলা করে বসে। মারাত্মকভাবে আহত মোয়াজ্জেম ভাইকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে যায় শিবিরকর্মীরা। এক পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো সন্ত্রাসীরা। শতাধিক বহিরাগত সন্ত্রাসীসহ আওয়ামী ছাত্রলীগ হাযেনারা প্রশাসন ভবনস্থ সম্মুখ চত্বরে পুলিশের সহযোগিতায় অবস্থান নেয়। বেলা আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ শিবিরকর্মীদের অনুষদ ভবন ও ক্যাম্পাস থেকে জোরপূর্বক হলের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে। শহীদি কাফেলার বিশাল মিছিল সবুজ চত্বরের সামনে দিয়ে সাদ্দাম হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে ছাত্রলীগ ও পুলিশ যৌথভাবে মিছিলের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। আওয়ামী কর্মীদের মতো পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রলীগ হায়েনাদের নৃশংস গুলিবর্ষণে মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শিবির নেতা আল মামুন, নাজিমুদ্দীন এমদাদুল্লাহসহ আরো অনেকে।

মারাত্মকভাবে বুকে গুলিবিদ্ধ শিবির নেতা আল মামুনকে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন ভোরে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে শাহাদাত বরণ করেন আল মামুন। ছাত্রলীগ ও পুলিশের নৃশংসতা এখানেই থেমে থাকেনি। ভয়াবহতা ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুলিশ নিরীহ শিবির কর্মীদের উপর বেপরোয়া লাটিচার্জ ও গ্যাস সেল নিক্ষেপ করে সাদ্দাম হলের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। সাদ্দাম হল দখলের ব্যর্থ অভিলাষে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা পুলিশের সহযোগিতায় হলের সামনে অবস্থানরত নিরীহ শিবিরকর্মীর উপর শত শত রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। পুলিশ ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের যৌথ গুলিবর্ষণে এক পৈশাচিক ও নজিরবিহীন দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রায় কয়েক ঘন্টাব্যাপী চলতে থাকে এ তাণ্ডবলীলা। শহীদ মুহসিন কবিরসহ নিরীহ ছাত্রদের করুণ আর্তচিৎকারে হল গেইটে সৃষ্টি হয় এক করুণ পরিস্থিতির। খুনিদের গুলির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় প্রিয় ভাই মুহসিনের বুকের পাঁজর। তাৎক্ষণিকভাবে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নেয়ার পর শহীদের সাথীদেরকে শোক সাগরে ভাসিয়ে মুহসিন কবির শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন।

আওয়ামী শাসনামলে ইসলমী বিশ্ববিদ্যালয় শিবির হারিয়েছে প্রখর মেধাবী, শিবির নেতা আমিনুর রহমান, আল মামুন, মুহসিন কবির ও রফিকুল ইসলামকে। চিরদিনের জন্য চক্ষু হারালেন শিবির নেতা মামুনুর রশীদ। হায়েনাদের বুলেটের নির্মম আঘাতে ক্ষত বিক্ষত দেহ নিয়ে ক্যাম্পাসে পদচারণা করছেন অসংখ্যা নিরপরাধ শিবির কর্মীরা। ’৯৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ’৯৯ সালের এ পর্যন্ত সীমাহীন জুলুম নির্যাতনের শিকার ইবির হাজারো ছাত্র-জনতার প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। পুলিশ প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে খুনি চক্রের গোপন আঁতাত আজ দিবালোকের মত পরিষ্কার। আজও গ্রেফতার করা হয়নি একজন খুনিকেও। অথচ খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে দম্ভ সহকারে। পাঁচজন শহীদের খুনিদের সাথে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যৌথ বৈঠক দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সচেতন সদস্যরা রীতিমত হতবাক। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। ইবির প্রতি ইঞ্চি সবুজ জমিন শহীদের সাথীদের রক্তে রঞ্জিত।

শহীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে বজ্র কঠোর শপথে আবদ্ধ হাজারো শিবিরকর্মী। পাঁচজন শহীদের রক্তস্নাত আর অসংখ্য ভাইয়ের সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে তিলে তিলে গড়া এ ক্যাম্পাসের প্রতি ইঞ্চি সবুজ জমিনকে প্রতিনিয়ত আমরা দ্বীনের জন্য উর্বর করবোই। চিরদিন সমুন্নত রাখবোই পতপত করে উড়তে থাকা শহীদের রক্তমাখা দ্বীনের পতাকাটিকে। হাজারো ষড়যন্ত্র মাড়িয়ে কদম কদম করে ইবির ক্যাম্পাসে শহীদের সাথীদের পথচলা। অসংখ্যা ষড়যন্ত্র, হাজারো রাউন্ড গুলি, হাত, পা, চক্ষু হারানোর নীরব দৃশ্যসহ কোন কিছুই শহীদের সাথীদের পথ চলা থামাতে পারেনি। বরঞ্চ সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মত ক্রমশ বেগমান হচ্ছে এ শহীদি কাফেলা। হাজারো শিবির কর্মীর মুখে নারায়ে তাকবির ধ্বনি হয় উচ্চারিত। প্রকম্পিত শ্লোগানে বাতিলের ভিত কেঁপে ওঠে। ক্যাম্পাস থেকে পালাতে উদ্যত হয় আবু জেহেল, আবু লাহাব আর নমরুদের উত্তরসূরিরা। শহীদ আমিন, মামুন, মুহসিন, আল মামুন ও রফিকুল ইসলামের দেখানো শাহাদাতের তামান্না নিয়ে দাওয়াতি কাজে মশগুল শহীদের সাথীরা। তাঁদের রেখে যাওয়া জিম্মাদারি পালনই শিবির কর্মীদের একমাত্র ব্রত।

তাইতো দাওয়াতি কাজের এ পেরেশানিকে নিয়ে পথ চলতে দেখা যায় আল মামুন ও মুহসিন কবিরের উত্তরসূরিদের। খুনি, জালিম চক্রের শেষ নিশানা মোছা অবধি শহীদের সাথীদের এ মিশন এক মুহূর্তের জন্যও থামবে না। শহীদ আল মামুন ও মুহসিন কবিরের রক্তের বিনিময়ে অজস্র তরুণ যারা এ কাফেলায় শামিল হয়ে তাঁদের রেখে যাওয়া দায়িত্ব পালনে ব্যাকুল তারাও আজ নতুন শপথে বলীয়ান। খুনি জালিমদের মৃত্যুঘন্টা বাজবেই মোদের হাতে। আমীর হামজা, হানযালা, খাব্বাব-খোবায়েব, বেলালের উত্তরসূরি মামুন, আমিন, মুহসিন, ও রফিক। তাদের পথ বেয়ে আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি আমাদের চূড়ান্ত মঞ্জিলের দিকে। পৃথিবীর কোন শক্তি বিন্দু পরিমাণ টলাতে পারবে না আমাদের চলার মনজিল থেকে। শাহাদাতের তামান্না বুকে ধারণ করে আমরা ছুটছি ঐ জান্নাতের দিকে যা আমাদের চলার শেষ মনজিল। আমাদের নির্ভীক পথ চলা থামবে না কোনদিন। বাধার পাহাড় মাড়িয়ে এগিয়ে যাবই প্রতিদিন।

একনজরে শহীদ মুহসিন কবির
নাম : মুহাম্মদ মুহসিন কবির
পিতার নাম : মোহাম্মদ নেছার উদ্দিন
সাংগঠনিক মান : কর্মী
শিক্ষাজীবন : ঝিনাইদহের পিটিআই প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৯২ সালে ঝিনাইদহ সরকারি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৫ সালে ঝিনাইদহ কেসি কলেজ থেকে এইচএসসি প্রথম বিভাগে পাস করেন। সর্বশেষ পড়াশোনা করেন, ইসলামের ইতিহাস (১ম বর্ষ), সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
আহত হওয়ার স্থান : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সবুজ চত্বর
শহীদ হওয়ার স্থান : ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল
আঘাতের ধরন : গুলি
যাদের আঘাতে নিহত : আওয়ামী ছাত্রলীগ
শহীদ হওয়ার তারিখ : ৩১.১০.১৯৯৮
যে শাখার শহীদ : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুহাম্মদ মুহসীন কবির

পিতা

মোহাম্মদ নেছার উদ্দিন

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

স্থায়ী ঠিকানা

ঝিনাইদহ

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ইসলামের ইতিহাস (১ম বর্ষ), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

শাহাদাতের স্থান

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল


শহীদ মুহাম্মদ মুহসীন কবির

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ মুহসীন কবির


শহীদ মুহাম্মদ মুহসীন কবির

ছবি অ্যালবাম: শহীদ মুহাম্মদ মুহসীন কবির