শহীদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ২৩ অক্টোবর ১৯৯৫ | ৭৬

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিধারায় একটি জীবনের আত্মাহুতি নয় অসংখ্য শহীদের রক্তস্নাত এ সবুজ মাটি সিক্ত হয়ে আছে আপন ঐতিহ্যকে বুকে নিয়ে আওলাদে রাসূল (সা) সাইয়েদ মাদানীর (র:) খুনও বাংলার মাটিকে করেছে সিক্ত। ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবদুল মালেকের সালাতে জানাযা পড়াতে গিয়ে যিনি তামান্না করেছিলেন শাহাদাতের। সেই থেকে শুরু হয় বাংলার মাটিতে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনে অসংখ্য শহীদ নজরানা পেশ আল্লাহর দরবারে। শোহাদায়ে কেরামের মিছিলে ব্যতিক্রমধর্মী একটি জীবন, একটি নাম শহীদের আনোয়ার হোসেইন। কয়েক বছরে ব্যবধানে যিনি আনলেন স্বীয় জীবন বৈপ্লবিক পরিবর্তন, গড়ে তুললেন সার্থক জীবন। পান করলেন শাহাদাতের অমিয় সুধা।

সাতকানিয়া সরকারি কলেজের ক্যাম্পাস সে শহীদি খুনে লাল হলো, যা ছিল সাতকানিয়া ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকণ্ড। তৎকালীন সরকারি দলের ছাত্র মস্তানদের সুপরিকল্পিত হামলার শিকার হয়েছিলেন তিনি। সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতেই ঘটল ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।

শিক্ষাজীবন
শহীদ আনোয়ার হোসাইন তার নিজ গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্ক্ষিা জীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম জেলাধীন লোহাগাড়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রসায় তার স্নেহময়ী মাতার একান্ত আকাঙ্ক্ষায়, তার মামা মাস্টার আব্দুল আলিম ছিদ্দিকীর তত্ত্বাবধানে ভর্তি হন। মাদরাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ বর্তমান বায়তুশ শরফ সাতকানিয়া আদর্শ মাদরাসার অধ্যক্ষ হযরত মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান নোমানীর হাতে পিতা-মাতা তাদের আদরের দুলালকে তুলে দেন। সেই থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়ালেখা করে যান। তিনি ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তিলাভসহ ছাত্রজীবনে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। একই মাদ্রাসা থেকে তিনি ১৯৯১ সালে দাখিল ও ১৯৯৩ সালে কৃতিত্বের সাথে আলিম পাস করেন।

১৯৯৫ সালে একই মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। শাহাদাতের কয়েক মাস পর তার কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল প্রকাশিত হলে সকলের কান্নার আওয়াজে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল, সকলে মুখে একটি কথা শহীদ আনোয়ার আজ বেঁচে থাকলে এ রেজাল্ট তাকে কতই না আনন্দ দিতো অবশ্য তিনি শাহাদাতের সর্বোচ্চ রেজাল্ট নিয়ে তার মহান রবের দরবার জান্নাতের পরীক্ষায় থাকাকালীন সময়ে তিনি উচ্চশিক্ষা হাসিলের নিমিত্তে সাতকানিয়া সরকারি কলেজে ডিগ্রি কাসে ভর্তি হন। বিএ ১ম বর্ষে থাকাকালীন সময়ে তিনি শাহাদাতের পিয়ালা হাতে নেন।

শহীদের আচরণ
শহীদ আনোয়ার হোসাইন সুন্দর আচরণের যেন এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। তিনি ছিলেন অনুপম চরিত্রে অধিকারী। তার জীবন ছিল পরিচ্ছন্ন। দাওয়াতি চরিত্রে প্রায় সব ক'টি গুণেরই সমাবেশ ছিল তার মাঝে। সর্বদা হাসিমুখে অম্লান বদনে তিনি মিশতেন সর্ব পর্যায়ের জনতার সাথে। যিনি একবার তার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তিনি কখনো তার কথা ভুলতে পারবেন না। তিনি সর্বাবস্থায় মিষ্টভাষী ও সদালাপী ছিলেন। কোন শিক্ষক, ছাত্র বা এলাকাবাসী কারো মনে আঘাত দিয়েছেন এমন নজির নেই। সকলের প্রিয়পাত্র ছিলেন শহীদ আনোয়ার, তার অনুপ্রেরণায় তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রগণ ইসলামী আন্দোলনের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে চরিত্রবান হওয়ার সবক নিত।

দ্বীনি আন্দোলনের অংশগ্রহণ ও কর্মতৎপরতা
শহীদ আনোয়ার হোসাইন খুব ছোট বয়স থেকেই ধার্মিক ছিলেন, ইসলামী পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই তিনি ছিলেন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট। লোহাগাড়া সিনিয়র মাদ্রসায় থাকাকালে জুনিয়র শ্রেণীসমূহে অধ্যয়নরত অবস্থা তিনি ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তি হন। কালক্রমে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। তার প্রাণপ্রিয় সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরে নিজকে নিয়োজিত করেন। তিনি বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সংগঠনের গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। দাখিল স্তরে থাকাকালীন তিনি সংগঠনের সাথী পদ লাভ করেন। লোহাগাড়া মাদরাসা শাখার পাঠাগার, অফিস, সেক্রেটারি আবার কখনো ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাথী শাখার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যথাক্রমে শিশু বিভাগ, স্কুল বিভাগ, মাদরাসা বিভাগ, কলেজ অঙ্গন শাখাসমুরেহ ইনচার্জ, অফিস, পাঠাগার ও বায়তুলমাল ইত্যাদি। উল্লেখ্য, তিনি দীর্ঘ আট বছর সচেতন দায়িত্বশীল হিসেবে লোহাগাড়া ময়দানে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। লোহাগাড়া থাকাকালীন তিনি শিবিরের সদস্য প্রার্থী হন। অতঃপর সংগঠনের প্রয়োজনে তিনি সাতকানিয়ায় স্থানান্তরিরত হন এবং শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সেখানকার অফিস সম্পাদক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

শাহাদাতের তামান্না
শহীদ আনোয়ার প্রায় সময় শাহদাতের তামান্না আকাঙ্ক্ষা করতেন। প্রায় সময স্বীয় সহপাঠীদের বলতেন, এখানে কি আর আসবো? তোমরা আমার জন্য দোয়া করবে.....। তিনি এক সময় তার প্রিয় নেতা ইসলামী ছাত্রশিবিরের চবি সভাপতিকে লক্ষ্য করে বলেন, রহিমুল্লাহ ভাই, আমি শহীদ হয়ে যাবো। শাহাদাতের কিছুদিন আগে তার স্নেহময়ী জননীকে লক্ষ্য করে বলেন, আপনি আমার মৃত্যুর ভয় কেন করেন? আপনি কি বায়তুশ শরফের পীর সাহেবের স্ত্রীর চেয়ে বেশি দামি? . (অর্থাৎ ওনার ছেলে হাফেজ আব্দুল রহিমও শহীন হন)

শহীদ আনোয়ার কি তার শাহাদাতের সময়সীমা জানতেন? তিনি তার প্রাণপ্রিয় নেতা শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতিকে সাতকানিয়া কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে আসার দাওয়াত করেছিলেন। প্রস্তাবিত তারিখটি ছিল ২৫ অক্টোবর। কেন্দ্রীয় সভাপতি ঠিকই আসলেন ২৫ অক্টোবরে আর তা ছিল শহীদ স্মরণে ছাত্রজমায়েত। নবীনবরণ আর হলো না। আসলেই শাহাদাতের ব্যাপারটি কি তার জানা ছিল। যে দিন তিনি আহত হলেন সেদিন সকালে পরিচ্ছন্ন জামা পরে কলেজে যাওয়ার পথে জনৈক সাথীকে চা খাওয়ানোর পর বললেন, দোয়া করবেন। এটা যে সর্বশেষ সাক্ষাৎ ছিল তা কি তার সাথীরা বুঝেছে?

শহীদ পরিবারের প্রতিক্রিয়া
শহীদ আনোয়ারের গর্বিত পিতামাতা শোকে মুহ্যমান হলেও তাদের প্রিয় ছেলে আল্লাহর রাহে কুরবান হওয়ার কারণে তারা ছিলেন গৌরবান্বিত। শহীদের গর্বিত পিতা বলেন, আমি আমার ছেলেকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দিয়েছি। প্রয়োজনে আমার আরো তিন সন্তানকে এ পথে কোরবানি দেব। তিনি শহীদের স্নেহময়ী আম্মার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, তুমি তো শহীদের মা, তোমার কান্নার কোন প্রয়োজন নেই। শহীদের গর্বিত পিতা আরো বলেন খুনিদের বিচার আল্লাহ করবেন, আমার ছেলে কোন অপরাধ করেনি, সে কোন সন্ত্রাস করেনি, সে ছাত্রদের আল্লাহর পথে ডেকেছে, আমার ছেলেকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করল, আমার ছেলেকে দ্বীনি ইলম হাসিলের পথে দিয়েছিলাম এ অবস্থা তার শাহাদাত বরণে আমি গর্বিত।

শহীদ জননী বলেন, আমার ছেলেকে কেন তারা মেরেছে? আমার ছেলে কি কোন দোষ করেছে ? যখন উত্তর দেয়া হল, যে, আপনার ছেলের কোন অপরাধ নেই, তিনি তো ইসলামের পথে ডাকতেন, তখন তিনি বললেন, তাহলে এ অপরাধ হলে আমি আল্লাহর শোকর জানাই।

তিনি আরো বলেন, আমি মাদরাসায় দেয়ার সময় আমার ছেলেকে বলেছিলাম বাছা! তুমি কারো মনে কষ্ট দিও না, এমন অমল কর যাতে লোকেরা তোমাকে স্মরণ করে। তিনি বলেন, এখন আমার ছেলে কি এভাবে সকলে স্মরণীয় হয়ে রইল। শহীদের পিতা-মাতার বক্তব্য দ্বারা জানা গেল তিনি নিশ্চয়ই মকবুল শহীদ, তাই মহান আল্লাহ এদেরকে এতবেশি ধৈর্য দিয়েছেন।

একনজরে শহীদ পরিচিতি
নাম : মুহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন
পিতার নাম : আমীর হামজা
সাংগঠনিক মান : সদস্য প্রার্থী
দায়িত্ব : সাতকানিয়া সাথী শাখার অফিস সম্পাদক
সর্বশেষ পড়াশুনা : ফাজিল পাস, বিএ এম বর্ষ
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : সাতকানিয়া সরকারি কলেজ, লোহাগাড়া সিনিয়র মাদরাসা
আহত হওয়ার স্থান : সাতকানিয়া কলেজ ক্যাম্পাস, ২১ অক্টোবর দুপুর ১২টা
শহীদ হওয়ার স্থান : চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল
আঘাতের ধরন: পাথরের আঘাতে মাথার খুলি দুপাশে থেঁতলে দেয়া হয়। 
যাদের আঘাতে নিহত : ছাত্রদল
শহীদ হওয়ার তারিখ :২৩.১০.১৯৯৫
যে শাখার শহীদ : সাতকানিয়া শহর সাথী শাখা, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম; উত্তর রামপুর, পো: রামপুর, থানা: সাতকানিয়া, জেলা চট্টগ্রাম
ভাই বোন : ৩ ভাই ২ বোন
ভাইদের মাঝে অবস্থান : ১ম
ভাইবোনদের মাঝে অবস্থান : ২য়

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন

পিতা

মুহাম্মদ আমীর হোসাইন

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৩ ভাই ২ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

গ্রামঃ উত্তর রামপুর, পোঃ রামপুর, থানাঃ সাতকানিয়া, জেলা- চট্টগ্রাম

সাংগঠনিক মান

সদস্য প্রার্থী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ফাজিল, লোহাগাড়া সিনিয়র মাদরাসা। বিএ, ১ম বর্ষ, সাতকানিয়া সরকারি কলেজ।

শাহাদাতের স্থান

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল


শহীদ আনোয়ার হোসাইন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আনোয়ার হোসাইন


শহীদ আনোয়ার হোসাইন

ছবি অ্যালবাম: শহীদ আনোয়ার হোসাইন