শহীদ মুহাম্মদ ইউসুফ

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ১০ মার্চ ১৯৯৪ | ৬৬

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

যুগ যুগ ধরেই আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। সকল প্রকার জুলুম নির্যাতন সহ্য করে, সর্বশেষ তাদের অমূল্য সম্পদ জীবনটাকেও বিলিয়ে দিয়েছেন, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। বাবা মায়ের ভালবাসার ছেলে; একমাত্র আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার জন্যই তাদের জীবনের এতবড় ত্যাগ স্বীকার। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ছিল তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। আর তাই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বাতিলপন্থীদের পাশবিক নির্যাতনের কবলে পরের প্রাণ দিতে হয়েছে সত্য পথের পথিকদের। তেমনই একজন মুজাহিদ শহীদ মুহাম্মদ ইউসুফ। যিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাঁর জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। যিনি ছিলেন বাগানের একমাত্র ফুল।

ব্যক্তিগত পরিচয়
চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার মধ্যে একটি পরিচিত গ্রাম দৌলতপুর। এই গ্রামের মীর আহমদ ও কুলসুমা বেগমের সাজানো ছোট্ট সংসার। একমাত্র ছেলে ইউসুফ ও কন্যা রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে সুন্দর চলছে তাদের সংসার। হেসে খেলে দিন কাটে ভাই বোন ইউসুফ ও রাবেয়ার। শাহাদাতের সময় ইউসুফ ছিলেন তরুণ।

শিক্ষাজীবন
একমাত্র ছেলে ইউসুফকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন বাবা মীর আহমদ। তাকে মানুষ করতে হবে। তাই তাকে ভর্তি করালেন বাবুনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। একে একে কেটে গেল পাঁচটি বছর। কৃতিত্বের সাথে ৫ম শ্রেণী থেকে উত্তীর্ণ হলেন এবিসি উচ্চবিদ্যালয়। ইতোমধ্যে বাবা মীর আহমদ চলে গেলেন পাকিস্তানে। সেখানে চাকরি করেন তিনি। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে তার দুটি সন্তান। দশ বছর পর তিনি যখন দেশে ফিরলেন। ততদিনে ইউসুফ বড় হয়ে ১৯৮৯ সালে এবিসি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ফটিকছড়ি ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছেন।

খুশিই হলেন মীর আহমদ। ১৯৯০ সালে কয়েকমাস বাড়িতে থেকে তিনি চলে গেলেন পাকিস্তানে। ইউসুফ কলেজে চলে গেলে বড় একা হয়ে যান তার মা কুলসুমা বেগম। ১৯৯১ সালে এইসএসসি পাস করে ভর্তি হলেন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী হাজী মুহামদ মহসিন কলেজে। প্রথমে তাঁর মা শহরে তাকে দিতেই চাইলেন না। ভয় আর শঙ্কা তাঁর মনে। তিনি মাকে বুঝাতে সক্ষম হলেন। মায়ের চেয়ে কে আর বেশি বুঝে সন্তানকে তাই আশ্বস্ত হলেন তিনি। সত্যিই তাঁর ছেলে কারো ক্ষতি করেনি। শাহাদাতের সময় হাজী মুহাম্মদ মুহসিন কলেজে ডিগ্রি পরীক্ষার্থী ছিলেন।

সাংগঠনিক জীবন
তিনি যখন এবিসি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়েন তখনই তিনি সত্য পথের সন্ধান পান। স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় মুরাদ নামের এক ছাত্রের সাথে তার পরিচয়ে হয়। তার ডাকেই সাড়া দিয়ে ইউসুফ ইসলামী ছাত্রশিবিরে সমর্থক হন। ধীরে ধীরে তিনি ছাত্রশিবিরে কর্মী হলেন। নিজের মেধা সৎচরিত্র ও এক আদর্শিক জীবন নিয়ে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যান। এসএসসি পরীক্ষার পূর্বেই তিনি সাথী হন।

শাহাদাতের ঘটনা
১০ই মার্চ ৯৪ শবে ক্বদরের দিন। সকলের মতো তিনিও এবাদত করে কাটালেন সারারাত। সেহেরি খাওয়ার জন্যে গেলেন চকবাজার সাইমুম হোটেলে। সারা চট্টগ্রামে তখন জাতীয়তাবাদী লেবাসধারী ছাত্রদল খুন, সন্ত্রাস, আর চাঁদাবাজিতে মত্ত। রোজা বা শবেক্বদরের মূল্য তাদের কাছে নাই। দেশের যেখানেই তাঁরা শিবিরকর্মী পাচ্ছে সেখানেই পাখির মত গুলি করে হত্যা করছে। একমাস আগেই তারা হত্যা করছে প্রিয় ভাই নূরুল আলমকে। ভাত খাচ্ছেন ইউসুফ এমনি সময়ে কয়েকজন ছাত্রদল ক্যাডার ঝাঁপিয়ে পড়ল হোটেল ম্যানেজারে উপর। ভীত সন্ত্রস্ত ইউসুফকে দেখে চিনতে পারে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। তিনি দ্রুত রান্না ঘরে ঢুকে পড়েন। সেখানেই তাঁর উপর গুলি ছোড়ে। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন তিনি। শহীদি মিছিলে যোগ দিলেন ইউসুফ। রমজান মাসে ১৯৯৪ সালে মাকে চিঠি লিখেছিলেন ঈদের দু’দিন আগে বাড়ি আসবেন। তিনি ঈদের দু’দিন আগে মায়ের কাছে পৌঁছলেন ঠিকই, কিন্তু জীবন্ত নয়, লাশ হয়ে।

ইউসুফকে হারিয়ে দিশেহারা হলেন কুলসুমা বেগম। কাকে তিনি আর আদর করবেন। নাড়িছেঁড়া ধন তাঁর। ঘাতক একটি বারও ভাবল না সেই একটি বাগানের একমাত্র ফুল। সেটি ঝরে পড়লে আর থাকবে কী? বিদেশে খবর পৌঁছলেও তার বাবা হজ্বের প্রস্তুতি নিয়ে বিদায় নিয়েছেন। তাঁকে শাহাদাতের খবর দেয়া হয়নি। হজ্ব থেকে ফিরে খবর পান। শুনেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। যার জন্য তার এত পরিশ্রম যাকে মুখে রাখবে বলে দেশ ত্যাগ, সেই আজ নেই। কি হবে আর চাকরি করে। দেশে ফিরে আসেন তিনি। এসে কবর ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। আর যাননি বিদেশে, পুত্রশোকে পাগলপ্রায়। সন্ত্রাসীরা ভেঙে দিয়েছে মীর আহমদের সমস্ত স্বপ্নকে। অনেক কষ্টে চলছে তার দিন।

অনেক কষ্টে একমাত্র মেয়েকে ডিগ্রি পাস করিয়েছেন। সেও কাঁদে তার ভাইটির জন্য। এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিবারটি আর সুন্দর হবে কি?

একনজরে শহীদ মুহাম্মদ ইউসুফ
নাম : মুহাম্মদ ইউসুফ
পিতার নাম : মীর আহমদ
মাতার নাম : কুলসুমা বেগম
সাংগঠনিক মান : সাথী
সর্বশেষ পড়াশোনা : বি.কম।
শিক্ষাজীবন : এসএসসি ১৯৮৯ সাল, এইস এসসি ১৯৯১ সাল। সর্বশেষ ডিগ্রি পরীক্ষার্থী ছিলেন।
আহত হওয়ার স্থান : চকবাজার সাইমুম হোটেল, চট্টগ্রাম
শহীদ হওয়ার স্থান : চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
আঘাতের ধরন : রাইফেলের গুলি
যাদের আঘাতের নিহত : ছাত্রদল
শহীদ হওয়ার তারিখ : ১০.০৩.১৯৯৪
যে শাখার শহীদ : চট্টগ্রাম মহানগরী
স্থায়ী ঠিকানা : দৌলতপুর ফটিকছড়ি
ভাই বোন : একভাই, একবোনের মাঝে তিনি ছিলেন বড়।
পিতা : জীবিত
পেশা : প্রবাসী।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ মুহাম্মদ ইউসুফ

পিতা

মীর আহমদ

মাতা

কুলসুমা বেগম

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

১ ভাই ১ বোন

স্থায়ী ঠিকানা

দৌলতপুর, ফটিকছড়ি

সাংগঠনিক মান

সাথী

সর্বশেষ পড়ালেখা

ডিগ্রী, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজ

শাহাদাতের স্থান

চকবাজারের সাইমুম হোটেলে গুলিবিদ্ধ হন, শাহদাত বরণ করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে।